নির্বাচিত কলাম
কাওরান বাজারের চিঠি
সিদ্ধান্ত জামায়াতের, না আমীরের? মৃত্যুর আগে শাওন কি মা’কে খুঁজছিল?
সাজেদুল হক
৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, শনিবার
বাবায় রাইতে বাড়ি আইতে দেরি হইলে ফোন কইরা বলতো, আমি আইসা ডাক দিমু মা, তুমি যাইগা থাইকো। কই বাবায় তো এহনো আইলো না। বাবারে যদি আল্লায় ভালায় ভালায় নিয়া যাইতো তইলে মানতাম। আমার পুতে তো গুলি খাইয়া মরার কথা না। এডা কী হইলো? হায়রে খোদা! আমার পুতেরে জানি কেমনে মারছে। পুতে কী মরার আগে মায়রে খুঁজছে, কয়বার জানি ডাক দিছে মাগো...কইয়া।
২৮শে আগস্ট সকাল। মানবজমিন অনলাইনে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট চাঞ্চল্য তৈরি করে দ্রুত। সহকর্মী শাহনেওয়াজ বাবলু সূত্র মারফত হাতে পান একটি ভিডিও। যেখানে জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমানকে দলটির একটি ঘরোয়া আয়োজনে ভার্চ্যুয়ালি কথা বলতে দেখা যায়। বক্তব্যে তার বার্তা ছিল পরিষ্কার।
তাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, জোটের কারণে বিশেষত আন্তর্জাতিক পরিসরে বিএনপিকে নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এছাড়া, দেশে অনেক দলও জামায়াতের কারণে বিএনপি’র সঙ্গে ঐক্যে আগ্রহী নয়। গত নির্বাচনে জামায়াতকে পাস কাটিয়ে ঐক্যফ্রন্ট তৈরি করা হয়। সে সময় জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক দেয়ার পক্ষেও নারাজি ছিল দলের একটি অংশ। শেষ মুহূর্তে অবশ্য সিদ্ধান্ত বদল হয়। জামায়াতের বিএনপি জোট ত্যাগে আওয়ামী লীগের মধ্যে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান কমপক্ষে দুইদিন এ নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, বড় উইকেট পড়ে গেছে। জামায়াত বলেছে তারা বিএনপি’র সঙ্গে নেই। তবে আওয়ামী লীগের আরও কয়েক নেতার কথা হলো, বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক ভাঙার নয়। তারা এটিকে বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই দেখছেন। তবে জামায়াতের ব্যাপারে সরকারি দলের ভবিষ্যৎ কৌশল কি হয় তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে কৌতূহল রয়েছে। এর আগে হেফাজতকে নিয়ে আমরা সরকারের নানামুখী কৌশল দেখেছি। আমীর হিসেবে ডা. শফিকুর রহমান জামায়াতের সাবেক আমীরদের সঙ্গে তুলনীয় নন। স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের আমীরদের মধ্যে গোলাম আযম ছিলেন সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত। মতিউর রহমান নিজামীও কম আলোচিত ছিলেন না। সে তুলনায় ডা. শফিকুর রহমানকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কম। তাই বলে জামায়াতের মতো দলে আমীর সংগঠনের বাইরে গিয়ে কোনো বক্তব্য দেবেন- সেটি একেবারেই অসম্ভব। এ কলামের পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, গত ২৬শে জুন লিখেছিলাম, একা চলার সিদ্ধান্ত জামায়াতের। মূলত এরও আগে জামায়াত এ সিদ্ধান্ত নেয়। তবে দলটির কৌশল ছিল জোট ভাঙার কোনো দায় না নেয়া।
এটি অবশ্য কয়েকবছর ধরেই জামায়াতের কৌশল। বিএনপি’র অনেক নেতাই অনেক সময় প্রকাশ্যে জামায়াতের সমালোচনা করেছেন। এমনকি বিএনপি’র কোনো কোনো নেতা, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সরাসরি জামায়াতকে দায়ী করে থাকেন। কিন্তু জামায়াত কখনও প্রকাশ্যে এ ব্যাপারে বক্তব্য দেয়নি। তবে তারা জোটে এ বার্তা পরিষ্কার করে দেয় যে, জোট থেকে বাদ দিলে তাদের কোনো আপত্তি নেই। এরইমধ্যে কোনো জোটভুক্ত না হয়ে স্বতন্ত্র অবস্থানে রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নেয় জামায়াত। কেন এই সিদ্ধান্ত? জামায়াতের নীতি-নির্ধারণে ভূমিকা রাখা এক নেতা এ প্রসঙ্গে বলেন, জামায়াতের মূল্যায়ন হচ্ছে, বিএনপি-জামায়াত জোটতো কোনো আদর্শিক জোট নয়। এটি একটি নির্বাচনী জোট। এখন এ জোটের ব্যাপারে সবসময় শতভাগ অনড় থাকা জামায়াতের রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর হয়েছে। এছাড়া, বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপি’র বর্তমান নেতৃত্বের মনোভাব জামায়াতের ব্যাপারে এক নয়। এটিও একটি বড় কারণ। তবে এ নিয়ে জামায়াতে কিছুটা মতভেদও রয়েছে। বিশেষ করে কেউ কেউ মনে করেন, ভোটের রাজনীতিতে বিএনপি’র সঙ্গে সমঝোতা না করে নির্বাচন করলে জামায়াতের ভালো করার সম্ভাবনা নেই। এটি ১৯৯৬ সালেই প্রমাণিত হয়েছে। তাদের বক্তব্য, বিএনপি ও জামায়াতের ভোট একই ঘরানার। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতেও বিএনপি’র সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের পথ খোলা রেখেছে জামায়াত। যেমনটা দলটির আমীর ডা. শফিকুর রহমানও বলেছেন।
কী বলেছিলেন জামায়াত আমীর
ভার্চ্যুয়াল ওই বক্তব্যে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমরা এতোদিন একটা জোটের সঙ্গে ছিলাম। ছিলাম বলে আপনারা হয়তো ভাবছেন কিছু হয়ে গেছে নাকি? আমি বলি হয়ে গেছে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এটি একটি জোট ছিল। ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবর জোট তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। সেদিন বাংলাদেশ পথ হারিয়ে ছিল। সেটা আর ফিরে আসেনি। তিনি বলেন, বছরের পর বছর এই ধরনের অকার্যকর জোট চলতে পারে না। এই জোটের সঙ্গে বিভিন্ন দল যারা আছেন, বিশেষ করে প্রধান দলের (বিএনপি) এই জোটকে কার্যকর করার কোনো চিন্তা নাই। বিষয়টা আমাদের কাছে স্পষ্ট দিবালোকের মতো এবং তারা আমাদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন বাস্তবতা হচ্ছে- নিজস্ব অবস্থান থেকে আল্লাহ্র ওপর ভর করে পথ চলা। তবে হ্যাঁ জাতীয় স্বার্থে একই দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবো ইনশাআল্লাহ্। বিএনপি’র সঙ্গে জোট নিয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে জামায়াতের আমীর বলেন, আমরা তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছি, এর সঙ্গে তারা ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তারা আর কোনো জোট করবে না। এখন যার যার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করবো। যদি আল্লাহ্ আমাদের তৌফিক দান করেন তাহলে আমাদের আগামী দিনগুলোতে কঠিন প্রস্তুতি নিতে হবে এবং অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। দোয়া করেন, এসকল ত্যাগ যেন আল্লাহ্র দরবারে মঙ্গলজনক হয়। এ ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ্ পাক যেন আমাদের পবিত্র একটি দেশ দান করে। যে দেশটা কোরআনের আইনে পরিচালিত হবে।
রাজপথে ফের লাশ
‘বাবায় রাইতে বাড়ি আইতে দেরি হইলে ফোন কইরা বলতো, আমি আইসা ডাক দিমু মা, তুমি যাইগা থাইকো। কই বাবায় তো এহনো আইলো না। বাবারে যদি আল্লায় ভালায় ভালায় নিয়া যাইতো তইলে মানতাম। আমার পুতে তো গুলি খাইয়া মরার কথা না। এডা কী হইলো? হায়রে খোদা! আমার পুতেরে জানি কেমনে মারছে। পুতে কী মরার আগে মায়রে খুঁজছে, কয়বার জানি ডাক দিছে মাগো...কইয়া।’ নারায়ণগঞ্জে গুলিতে নিহত যুবদল কর্মী শাওন প্রধানের মা ফরিদা বেগমের এই বিলাপের চিত্র তুলে ধরেছে প্রথম আলো। ২০ বছর বয়সী এক যুবক। কিছুক্ষণ আগেও ছিল মিছিলের সম্মুখ সারিতে। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করেছে রাজপথ। হঠাৎ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ। গুলি, টিয়ারশেল। অকালে চলে গেল একটি প্রাণ। যার যায় সেই সবচেয়ে বেশি বুঝে। এক মা অপেক্ষা করে থাকবেন। কখন ছেলে আসবে। কিন্তু শাওন আর আসবে না। তার পরিবর্তে নতুন নাম পেয়েছে সে। লাশ। এরইমধ্যে গভীর রাতে বাড়িতে লাশ ফিরেছে, দাফন হয়েছে। তাকে নিয়ে রাজনীতিতে চাপানউতোর চলবে।

মিছিলের ছবি থাকার পরও বলা হবে, সে যুবদল কর্মী নয়। তার লাশ দাবি করে মিছিল হলো। হয়তো আরও হবে। অমুক নেতার আত্মীয় হলেই কি তাকে হত্যা জায়েজ হয়ে যায়। একটি প্রাণ, একটি জীবন। কোনো কিছুতেই তার ক্ষতিপূরণ হয় না। কিন্তু দুঃখজনক হলো- এসব হত্যার কোনো বিচার হয় না। কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না। এবারও হবে না। কোন পরিস্থিতিতে গুলি হলো কোনো তদন্ত হবে না! ভোলার পর নারায়ণগঞ্জ। বিরোধী দলের তিনজন কর্মীর লাশ পড়তে দেখলাম আমরা। একে ঠিক সরকার পতনের আন্দোলন বলা যায় না। বিক্ষোভ, সমাবেশের মতো মামুলি কর্মসূচি। গত কয়েকদিনে এসব কর্মসূচিতে টানা হামলার শিকার হচ্ছেন বিএনপি’র নেতাকর্মীরা। বেশির ভাগ জায়গাতেই সরকারি দলের সমর্থকরা অ্যাকশনে। বিএনপিকে দাঁড়াতেই দিতে চান না তারা। মারধর করছেন নির্বিচার। সরকারি দলের নেতারা ক’দিন ধরেই বলছিলেন খেলা হবে! এ কেমন খেলা! মানুষের জীবন নিয়ে। রাজনীতিতো মানুষকে নিয়েই। সে মানুষই যদি মারা যায় রাজনীতির জন্য। কি দাবি করবো! কোথায় দাবি করবো! বুঝতে পারি না।
লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, মানবজমিন
মন্তব্য করুন
নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন
নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত
বেহুদা প্যাঁচাল/ অর্থমন্ত্রীর এত বুদ্ধি!
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ বাংলাদেশের অর্থ পাচার, ভারতের আনন্দবাজার, ইউরোপের কালো তালিকা
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ নির্বাচন ঘিরে একই প্রশ্ন, আমেরিকা কি ম্যানেজ হয়ে যাবে?
আন্তর্জাতিক/ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নাইজেরিয়া ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ তত্ত্বাবধায়ক সরকার, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য এবং পশ্চিমাদের অবস্থান
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি, সরকারের নীরবতা, অ্যাকশনে অন্যরাও?

জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]