ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শিক্ষাঙ্গন

ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়েও তিন বছর ঢাবিতে অধ্যয়ন! যেসব কৌশল অবলম্বন করেছিলেন সাজেদ

হাসনাত মাহমুদ,বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার

(১ বছর আগে) ২৫ আগস্ট ২০২২, বৃহস্পতিবার, ৩:৪৪ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৩:৪৩ অপরাহ্ন

mzamin

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের জন্য মূল যে ধাপ-সেই স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হননি সাজেদ। তাতে কি! বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমের বিভিন্ন ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়ে প্রথম বর্ষ থেকেই নিয়মিত করে যান ক্লাস। তাও একদিন দুইদিন, এক মাস দুই মাস কিংবা একবছর নয়- টানা তিন বছর লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে ঢাবিতে পড়ে গ্রাজুয়েশন প্রায় শেষ করে ফেলেছিলেন এই তরুণ। তবে শেষ রক্ষা হল না। সহপাঠী শিক্ষকদের সন্দেহ হওয়ার পর তাকে জেরা করতেই বেরিয়ে আসে অবিশ্বাস্য এই তথ্য।

সাজেদুল কবির নামে এই তরুণ গত তিন বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ক্লাস করতেন। বেশ কিছুদিন ধরে সন্দেহ হওয়ার পর গতকাল তার ব্যাচের একটি ক্লাস টেস্ট চলাকালে ওই বিভাগের শিক্ষকদের জেরার মুখে সাজেদ স্বীকার করে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয়। ভুয়া শিক্ষার্থী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর সাজেদ নিজেই এ ঘটনায় স্বীকারোক্তি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী।

পরিচয় গোপন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নের অভিযোগে তাকে ইতিমধ্যেই পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে। গতকাল রাতে ক্যাম্পাসে এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সবাই হতবাক হয়ে যায়। এত এত প্রমাণাদি, কাগজপত্র, অনলাইন ডাটাবেজ থাকার পরেও কিভাবে একজন শিক্ষার্থী এতদিন এ ধরনের জালিয়াতি করে গেছে?- বেশির ভাগের মনেই এখন এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
এই বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতেই অবাক করা সব তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে। দারুণ সব কৌশলের আশ্রয় নিয়েই মূলত এতদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকে ছিলেন এই তরুণ।

ভর্তি বাতিল করা আরেকজনের পরিচয় ধারণ করেছিলেন সাজেদ
২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের সাথে ক্লাস করতেন অভিযুক্ত সাজেদ।

বিজ্ঞাপন
যারা বর্তমানে তৃতীয় বর্ষ-সিক্স সেমিস্টারে অধ্যয়নরত আছেন। ভর্তির পর এই ব্যাচ থেকে প্রথম বর্ষের শুরুতেই সাকিব নামে এক শিক্ষার্থী কানাডায় এমবিবিএস পড়াশোনা করতে চলে যান। ধূর্ত সাজেদ তার রোল (১৮২) ও নাম ব্যবহার করেই মূলত পুরোদস্তুর ওই বিভাগের শিক্ষার্থী বনে যান। সাজেদের সহপাঠী সূত্রে জানা যায়, মূল শিক্ষার্থী সাকিব তাদের কারো সাথে ভালোভাবে পরিচিত হওয়ার আগেই দেশের বাইরে চলে যান। বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথে সাকিবের এই অপরিচিত থাকার সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে সাজেদ। বিভাগের বিভিন্ন ক্লাস টেস্ট, এসাইনমেন্ট, টিউটোরিয়ালে সাকিবের রোল নাম্বার ও পরিচয় ব্যবহার করে তিন বছর কাটিয়ে দেয় সে।

সন্দেহ এড়াতে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিতেন না
দারুণ বিচক্ষণতার আশ্রয় নিয়েই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর কাটিয়ে দিয়েছেন সাজেদ তা তার নেয়া এই সিদ্ধান্ত থেকেই অনেকটা স্পষ্ট। বিভাগের অন্যান্য কার্যক্রমে উপস্থিত থাকলেও প্রতিটি সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষায় সে অংশ নিত না। মূলত ফাইনাল পরীক্ষাগুলোতে ছবিসহ নামের কাগজে স্বাক্ষর করতে হয় শিক্ষার্থীদের। পরীক্ষায় অংশ নিলে বিপদ বাড়তে পারে- এমন আশঙ্কা থেকেই সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা এড়িয়ে চলত সাজিদ। তার সহপাঠীরা এ বিষয়ে তাকে অনেকবার জিজ্ঞেসও করেছিল। প্রতিবার সাজেদ উত্তর দিত সে খুব দ্রুতই দেশের বাইরে চলে যাবে। তাই পরীক্ষাতে বসছে না।

ছিলেন দারুণ মিশুক, সহপাঠীদের বুঝতেই দেননি তিনি তাদের কেউ নন
এত বড় জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে তিনবছর পার করা সাজিদের হাবভাব ছিল আর দশটা শিক্ষার্থীর মতই একদম স্বাভাবিক। বিভাগের বন্ধুবান্ধবদের সাথে নিয়মিত ওঠাবসা ছিল তার। তার সহপাঠীদের ভাষ্য-রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে একসাথে একটি শিক্ষাবর্ষে ২০০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী ক্লাস করে। এর বাইরে আগের শিক্ষাবর্ষের অনেকে পুনঃভর্তি হয়েও ক্লাসে যোগ দেয়। যার ফলে সবার পক্ষে সবাইকে চেনা জানা সম্ভব নয়।

এর উপর বিভাগের বিভিন্ন কার্যক্রমে স্বাভাবিক ভাবেই অংশগ্রহণ করতো সাজেদ, যেমন একাধিক ব্যক্তির সাথে শ্যাডোতে এক্সামের কোর্স ম্যাটারিয়াল নেয়া, সূর্যসেনে হলের ক্যাফেটেরিয়ায় খেতে যাওয়া, সমাজবিজ্ঞান চত্ত্বরে অফটাইমে আড্ডা দেয়া ইত্যাদি। তাই আপাতদৃষ্টিতে তাকে অছাত্র বলে ভাবা যেত না বা চিহ্নিত করা যায় নি। করোনার দীর্ঘ বন্ধ পারস্পরিক চেনাজানায় সরাসরি আঘাত করেছে বলেও তাদের অভিমত। সহপাঠী সূত্রে আরও জানা যায় -সাজেদ কখনোই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে থাকেনি, ও নারায়ণগঞ্জে থাকতো এবং নিয়মিত বাসে যাতায়াত করত। হলে না থাকায় তার মিথ্যাচারটি তাদের পক্ষে ধরা আরো কঠিন হয়ে পড়ে।

প্রশাসনিক দপ্তর নামের তালিকা থেকে ভর্তি বাতিল করাদের নাম বাদ না দেওয়াই মূলত পোয়াবারো হয় সাজেদের
সাজেদের নাম পরিচয় গোপন করে ঢাবিতে তিন বছর অধ্যয়ন করা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা চলছে চারদিকে। দীর্ঘ সময় ধরে প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে একজন বহিরাগতের এই তুলকালাম কাণ্ড ঘটানোর পেছনে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের একাডেমিক  কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হয় প্রশাসনিক দপ্তর থেকে। শিক্ষার্থীদের কাছে এটি রেজিস্টার বিল্ডিং নামে পরিচিত। মূলত তাদের অবহেলার কারণেই সাজিদ এত দীর্ঘ সময় ধরে সহজে তার পরিচয় লুকাতে পেরেছে। অভিযুক্ত এই তরুণ যার ছদ্মবেশ ধারণ করেছিল-সেই সাকিব বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গেছেন ২০১৯ সালেই। অথচ রেজিস্টার বিল্ডিং থেকে বিভাগে সরবরাহ করা রোলকলের খাতায় এই তিন বছর পর্যন্ত তার নাম ও রোল নম্বর উল্লেখ ছিল। যার কারণে সাজিদের সাকিব ছদ্মবেশ ধারণ সন্দেহের বাইরে থেকে যায়। সাকিব ছাড়াও অন্য যারা প্রথম বর্ষে ঢাবি ছেড়ে গেছেন তাদের নামও রোল কলের খাতায় রয়েছে।

সম্প্রতি কয়েকজন সহপাঠীর সন্দেহই সর্বনাশ ডেকে আনে সাজেদের
খ্যাতনামা পরিচালক রাজকুমার হিরানির 'থি ইডিয়টস' মুভিটি আমরা প্রায় সবাই দেখেছি।  বলিউড ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় ও ব্যবসা সফল এই সিনেমাটিতে মূল অভিনয়ের ভূমিকায় থাকা নায়ক আমির খান মূলত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অন্য একজনের প্রক্সি দিয়ে পড়াশোনা করছিলেন। 'র‌্যাঞ্চোরদাশ' নামে সেই ব্যাক্তির ছদ্মধারণ করা আমির খান ধরা না পড়ে বেশ সফলতার সাথেই গ্রেজুয়েশন শেষ করতে পেরেছিলেন। প্রায় হতে হতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'র‌্যাঞ্চোরদাশ' হওয়া হলো না সাজেদের। তৃতীয় বর্ষের শেষ দিকে এসে তার কিছু সহপাঠীর সন্দেহই তার সর্বনাশ ডেকে আনে।

মূলত ২০১৮-১৯ সেশন ও বর্তমানে সিক্সথ সেমিস্টারে অধ্যয়নরত কিছু শিক্ষার্থীই তার ব্যাপারটা প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করে ও তারপর ক্লাসের সিআরদের মাধ্যমে এক শিক্ষককে বিষয়টি জানালে তিনি এর সমাধান করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদেরই একজন ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। যেখানে তিনি লিখেছেন -৫ম সেমিস্টারের একটি কোর্সের সেশনাল রেজাল্ট প্রকাশিত হয়। তখন মেডিক্যালে চলে যাওয়া একজনের  সেশনাল পরিক্ষার রেজাল্ট আসে। তার রোলের পাশে নম্বর দেখে প্রথমত আমাদের সহপাঠীদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। এর আগে এরকম কিছু ধরা পড়লে নিশ্চয়ই সবাই সেটা আমলে নিতো! তো প্রথমত আমরা সাস্পেক্ট করি যে, কেউ তো একজন আছে যে অন্যের নামে পরিক্ষা দিচ্ছে।

এরপর চলমান সিক্সথ সেমিস্টারের একটি কোর্সের ক্লাসটেস্ট শেষে সংশ্লিষ্ট কোর্স শিক্ষকের উপস্থিতিতে ৪ সিআরসহ ৭ জন সহপাঠী উত্তরপত্রগুলো গুছিয়ে দিচ্ছিলাম স্যারকে। তখন আমাদের বি সেকশনের সিআর জিসার চোখে পড়ে মেডিক্যালে চলে যাওয়া সেই ছাত্রের (সাকিব) রোল ও নাম সম্বলিত খাতাটি। সে আমাদেরকে ও উপস্থিত শিক্ষককে অবহিত করে। তারপর আমরা এটেনডেন্স শিট দেখে তার আশপাশে কে বসেছিল তা বের করি। তার সামনে বসা বন্ধুটি জানায়, তার নাম সাজিদ।এরপর আমরা তাকে হাতেনাতে ধরার অপেক্ষা করি।

আজ ২৪ আগস্ট একটি কোর্সের ক্লাস টেস্ট অনুষ্ঠিত হয়। পরিক্ষা শুরুর আগেই ছেলেটিকে জিসা দেখে এবং বাকি সিআরদেরকে ও শিক্ষক মামুন আল মোস্তফা স্যারকে অবহিত করে। পরিক্ষা শুরু হয় বেলা ১২ টায়। তার কিছুক্ষণ পর দুজন শিক্ষক ক্লাসে এসে পরিক্ষার হলে দায়িত্বরত শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
এর পরবর্তীতে তাকে প্রক্টরিয়াল টিমের কাছে সোপর্দ করা হয়। প্রক্টরিয়াল টিমের জিজ্ঞাসাবাদে ওই তরুণ বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন ছিল তার। ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা দিলেও চান্স পাননি। তবু প্রথম বর্ষ থেকে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে নিয়মিত ক্লাস করে আসছেন। পরে তাকে পুলিশে দেওয়া হয়।
পুরো ব্যাপারটি মোটামুটি পরিষ্কার হলেও এখনো নানা প্রশ্ন-অভিযোগ তুলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। ঢাবি কেন্দ্রিক বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে তারা এ বিষয়ে নিজেদের বিস্ময়, কৌতূহল ও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। তাদের কেউ কেউ বলছেন এত লম্বা সময় ধরে জালিয়াতি করে পার পাওয়ার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবহেলাই দায়ী। তাদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের ঠিকমত খোঁজখবর রাখেনা। অনেকের আবার প্রশ্ন- অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জেনেও সাজেদ কেন এ কাজ করতে গেল? এর পেছনে বিভাগ, অনুষদ, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ আছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখতে বলছেন অনেকে।
 

শিক্ষাঙ্গন থেকে আরও পড়ুন

   

শিক্ষাঙ্গন সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status