শেষের পাতা
ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের সম্মান
ইউটিউবারের দুরভিসন্ধিমূলক ভাষ্য
শহীদুল্লাহ ফরায়জী
১৫ জুন ২০২৫, রবিবার
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘কিংস তৃতীয় চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড-২০২৫’ সম্মাননা গ্রহণ করেছেন। বৃহস্পতিবার (১২ই জুন) লন্ডনের সেন্ট জেমস প্যালেসে এক অনুষ্ঠানে বৃটিশ রাজা তৃতীয় চার্লস অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে এই অ্যাওয়ার্ড তুলে দেন। বিশ্বব্যাপী শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং পরিবেশ-প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আজীবন অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বৃটিশ রাজা তৃতীয় চার্লস বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে এই সম্মাননার জন্য মনোনীত করেন। ২০২৪ সালের জুন মাসে রাজা চার্লস প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপনের উদ্যাপন হিসেবে নতুন এই অ্যাওয়ার্ড প্রবর্তন করেন। অ্যাওয়ার্ডের প্রথম বিজয়ী ছিলেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন।
কিংস ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে ‘রাজা তৃতীয় চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড’ সম্পর্কে বলা হয়েছে, বিশেষ এই পুরস্কার এমন এক ব্যক্তিকে দেয়া হয়, যিনি ‘দ্য কিংস হারমনি’ দর্শনের প্রতি দীর্ঘমেয়াদে অসামান্য নিষ্ঠা দেখিয়েছেন এবং এটিকে সমর্থন দিয়েছেন। এ দর্শন সব ক্ষেত্রে টেকসই ব্যবস্থা ও প্রকৃতিকে অগ্রাধিকার দেয়ার ওপর গুরুত্ব দেয়।
অধ্যাপক ইউনূস সম্পর্কে ওয়েবসাইটে বলা হয়, তিনি সামাজিক ব্যবসার নীতি প্রচারে এবং টেকসই, সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল প্রকল্পগুলো উৎসাহিত করতে তার জীবন উৎসর্গ করেছেন। এটি বাংলাদেশ ও এর বাইরেও দারিদ্র্যবিমোচনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে।
নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এটি কেবল তার ব্যক্তিগত অর্জন নয় বরং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রেরও অর্জন।
কিন্তু এই গৌরবের মুহূর্তে আমাদের সমাজে কিছু অসুস্থ ও বিকৃত প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা গভীর উদ্বেগ ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
জনৈক একজন ইউটিউবার, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম ওয়েবসাইটে উল্লেখ নেই দাবি করে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ উত্থাপন করেন এবং এই বক্তব্য দেখে আরও কয়েকজন ইউটিউবার ভিডিও প্রকাশে নৈতিক কর্তব্য সম্পাদনে উৎসাহী হয়ে পড়েন। তাদের সমালোচনায় মনে হয় যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য সংস্থা ‘দ্য কিংস ফাউন্ডেশন’র ওয়েবসাইটে নাম উল্লেখ বা প্রকাশ করার দায়িত্ব যেন ডক্টর ইউনূসের বা বাংলাদেশ সরকারের।
কিন্তু উক্ত ইউটিউবারগণ একবারও মনে করেননি বিশ্বের এমন একজন সরকারপ্রধান কিংবা এমন একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ কী আছে, যারা রাজকীয় অনুষ্ঠানের কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়া তাদের নাম প্রকাশ করবে? উক্ত ইউটিউবার একটুও বিবেচনায় নেননি, যেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিক সাংবাদিক সম্মেলন করে ঘোষণা দিচ্ছেন এই অ্যাওয়ার্ডের। সরকারপ্রধানের সফরের কর্মসূচিতে বৃটেনের রাজার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎ এবং অ্যাওয়ার্ড গ্রহণের কথা বলা হচ্ছে এগুলো রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের অংশ। রাষ্ট্রীয় প্রটোকলে মনগড়া বা কল্পিত সফরসূচি প্রণয়ন করা যায় না।
একটি বিষয়ে প্রতারণার অভিযোগ আনার পূর্বেই সরকারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বা সফরসূচির বিষয়টি জেনে নিতে পারতেন।
ধরে নিলাম ইউটিউবার মনে করছেন এসব সংবাদ সরকারের প্রতারণামূলক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন এই ব্যাকুলতা? তিনি কী দুইদিন অপেক্ষা করতে পারতেন না? ড. ইউনূস যদি কিংস চার্লস তৃতীয় অ্যাওয়ার্ড সম্মাননা না পেতেন কিংবা রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে শূন্য হাতে ফিরতেন তখন কি রাষ্ট্রীয় প্রতারণার অভিযোগ উত্থাপন করা যেত না? অথচ তিনি তড়িঘড়ি করে ভিডিও প্রকাশ করলেন, যেন অসম্মান করার ঐতিহাসিক সুযোগটি হাতছাড়া হয়ে না যায়। অথচ সেই ‘অস্তিত্বহীন’ পদকটি এক বৈধ রাজা (তৃতীয় চার্লস) নিজ হাতে তুলে দিলেন, আন্তর্জাতিক মর্যাদাপূর্ণ এক রাজকীয় আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে।
যিনি ইউটিউবার তিনি নিশ্চয়ই জানতেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর মতো নোবেল বিজয়ী মানুষ ‘কিংস তৃতীয় চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড-২০২৫’ সম্মাননা না পেলে ঘোষণা দিতেন না। যেহেতু ওয়েবসাইটে নাম নেই সেহেতু এটাই সুযোগ তাকে অপমান ও অপদস্ত করার। সুযোগটির সদ্ব্যবহার করতে তড়িঘড়ি এপিসোড তৈরি করেছেন। যেন অপমান দেরিতে করলে সত্য চিরকালের জন্য আড়াল হয়ে যাবে। অতএব, সরকারি সফর শেষ হওয়ার আগেই চূড়ান্ত অপমানের স্থাপত্য নির্মাণ করে ফেলতে হবে। এই সুযোগ হাতছাড়া করলে বাঙালি জাতি বিশ্বের কাছে মর্যাদা হারাবে। এসব প্রতিক্রিয়াকে শুধু আবেগ দিয়ে নয়, তত্ত্ব ও দর্শনের আলোকে বিশ্লেষণ করা দরকার। কারণ, এ সংকট কেবল একটি ঘটনার প্রতিক্রিয়া নয় বরং আমাদের সমাজের গভীরে পুঞ্জীভূত হীনমন্যতার বহিঃপ্রকাশ।
বাংলাদেশে আজ একটি ধারাবাহিক ও দুঃখজনক অসুস্থ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যে কৃতী সন্তান বিশ্বে বিরল-দুর্লভ সম্মান পায়, তাকে দেশের ভেতরে যাচ্ছেতাই অপমান করা। যে-যত উচ্চতায় উঠবে, তত বেশি বিদ্রূপ এবং বিদ্বেষের প্রতিযোগিতায় তাকে মাটির তলানিতে ফেলে দিতে হবে।
অনেকেই আছেন ড. ইউনূসের মর্যাদা মাটিতে মিশিয়ে দিতে না পারলে যেন নিজেদের মর্যাদা সুরক্ষা পায় না। ড. ইউনূসের বিরোধিতা এবং অস্বীকৃতিই হয়ে উঠে তাদের আত্মপরিচয়ের মানদণ্ড। হীনমন্যতাই হয়ে উঠে অনেকের আত্মসম্মানের ঠিকানা। ড. ইউনূসের প্রতি এমন বিদ্বেষ, আসলে তার বিরুদ্ধাচারণ নয় নিজেদের ব্যর্থতা ও অতৃপ্তি ঢাকার অপচেষ্টা।
দার্শনিক আলফ্রেড অ্যাডলার ‘Inferiority Complex’ ধারণা দিয়ে বলেন- মানুষ যখন নিজের অপূর্ণতা স্বীকারে অক্ষম হয়, তখন সে অন্যের সম্মানকে অস্বীকার করে বাঁচতে চায়।’ যারা জীবনে কোনো উচ্চতা ছুঁতে পারেননি, তাদের একটি অংশ অন্যের উচ্চতাকে মেনে নিতে পারে না। মনোবিজ্ঞানে এটাকে বলে ‘Inferiority Complex’-এর External Projection অর্থাৎ, ‘আমি কিছু করতে পারিনি, তাই কেউ করলে সেটা মিথ্যা, সাজানো।’
হান্না আরেন্টের উক্তিকে মনে করিয়ে দেয় তথ্য ও মত বিভ্রান্তির পার্থক্য বিলুপ্ত হলে নাগরিক সচেতনতা এক ভয়ংকর বিপন্নতায় পড়ে। যারা ‘ওয়েবসাইটে নাম নেই’ বলে চূড়ান্ত অপমান করেন, তারা এই তথ্য-মিথ্যাজালের নির্মাতা ও শিকার উভয়ই। এই মনোভাব শুধু ব্যক্তি নয়, সমাজকেও বিষিয়ে তোলে। সন্দেহ, ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের মধ্যদিয়ে এক আত্মবিরোধী সংস্কৃতি গড়ে ওঠে- যেখানে গর্বের বদলে লজ্জা, সম্মানের বদলে কদর্যতা। আজকের কিছু ইউটিউবার বা অনলাইন বক্তা কেবল বিভ্রান্ত নন, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে সত্য আড়াল করে বিকৃতি ঘটাচ্ছেন। তারা ‘ওয়েবসাইটে নাম নেই’ এটা পরিবেশন করে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন। এর পেছনে আছে এক ধরনের সংকীর্ণতা, যেখানে সত্য জানার আগ্রহ নেই, আছে কেবল নিজস্ব ক্ষোভ আর ঈর্ষাকে প্রতিষ্ঠা করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। এটি এক রকম নৈতিক ব্যাধি যেখানে প্রমাণ নয়, অপমানই উদ্দেশ্য।
সম্মানপ্রাপ্তির যোগ্যতা অর্জনের জন্য বছরের পর বছর সাধনা, ত্যাগ, তিতিক্ষা ও সৃজনশীলতার অবদান লাগে। কিন্তু অপমান করতে লাগে না কিছুই শুধু একটা মোবাইল, ক্যামেরা আর ইন্টারনেট সংযোগই যথেষ্ট। জার্মান দার্শনিক নীৎশে বলেছিলেন ‘Those who cannot create, destroy’. ‘যারা সৃজন করতে অক্ষম, তারা ধ্বংস করে আনন্দ পায়।’
যেকোনো বিষয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু বিতর্ক যদি হয় ভিত্তিহীন, অসার, কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তবে তা শুধু ব্যক্তির মর্যাদাকেই ক্ষুণ্ন করে না, রাষ্ট্রের মর্যাদাকেও আঘাত করে। ড. ইউনূস বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রেরও প্রতিনিধি, তার প্রতি এই অপমান আসলে নিজেদের আত্ম-অপমান। কথা আছে নিজেকে সম্মান করো, সম্মানিতকে অপমান নয়। ড. ইউনূসের সম্মানিত হওয়া আমাদের জাতির জন্য একটি প্রাপ্তি।
বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়া বা ইউটিউবের যুগে যে-কেউ বিনা প্রমাণে যে-কাউকে অভিযুক্ত করতে পারে। তথ্যবর্জিত বিদ্বেষীরা সমাজের প্রতিচ্ছবি নয়, তারা সমাজের বিকার। মিথ্যাচারীরা সাহসের অভাবে সত্যের মুখোমুখি হতে পারে না, তাই গুজবের আশ্রয় নেয়। অসততার চূড়ান্ত রূপ হলো, যখন কেউ জানে সে মিথ্যা বলছে, তবুও জনমনে সন্দেহ ছড়ায়।
ড. ইউনূসকে ঘিরে যে-প্রতিক্রিয়াগুলো দেখা যাচ্ছে, তা প্রায়ই ‘সততার ছদ্মবেশে মূর্খতার’ চেহারা ধারণ করে। সত্যকে না জেনে রায় দেয়ার, এটা কোনো মতামতের স্বাধীনতা নয়, এটা এক ধরনের সামাজিক দায়িত্বহীনতা।
ড. ইউনূসের সম্মান জাতিরও সম্মান। আমাদের উচিত, সেই সম্মানকে উপলব্ধি করা, রক্ষা করা এবং গর্বিত হওয়া।
এটিকে অপমান নয়, উপলব্ধি ও অহংকারের জায়গায় রাখাই একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের নৈতিক কর্তব্য। যারা এ দায়িত্ব পালন করতে পারে না, তাদের উচিত শিক্ষা হলো বিবেক ও সত্যের কাছে দায়বদ্ধ থাকা, ইউটিউব অ্যালগরিদমের কাছে নয়।
অবশেষে দূরভিসন্ধিমূলক ভাষ্য মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পরও উক্ত ইউটিউবারদের কোনো অনুতাপ বা অনুশোচনা কিংবা লজ্জা হয় না! তাদের একটিবারের জন্যও বিবেকের দংশন হচ্ছে না!
আজ জাতিগতভাবে আমাদের প্রয়োজন তিনটি গুণাবলি:
১. সত্য যাচাইয়ের নৈতিকতা; ২. অর্জনকে শ্রদ্ধা করার সৌজন্য ও ৩. আত্মোন্নয়নের মনোভাব। যারা অপমানকে হাতিয়ার করে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকেন, তারা নিজেদেরকেই সমাজে অগ্রহণযোগ্য করে তোলেন।
লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
পাঠকের মতামত
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীই "স্টারমার" জানতেন তার দলের বা বিরোধীদলের অনেকের নামের যে তালিকা ড:ইউনুসের ঝোলার মধ্যে ছিল তা প্রকাশ পেলে তার নিজের চেয়ারই নড়বরে হবে তাই তিনি দেখা করেন নি তাছাড়া "টিউলিপ" Seductives তো আছেই?
প্রতিটি আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ড এর সাথে দেশের সম্মানের বিষয়টি জড়িত। এটা বোঝার জন্য তো ডক্টরেট ডিগ্রি প্রয়োজন হয় না। যার যা খুশি তা বলার নাম বাকস্বাধীনতা নয়।
মন্তব্যকারী mahmud, আপনি দেশের কি মংগল সাধন করছেন? হাসিনা পালানোর পরও হাসিনার দোসরগিরী ছাড়তে মন চায় না?
সত্য গোপন করতে গিয়েই সাধারণত আমরা গোলমাল বাঁধিয়ে ফেলি! প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের উল্টাপাল্টা বক্তব্য এবং অপতথ্য প্রদানের কারণে ঘটনার সূত্রপাত! বিষয়টির গুরুত্ব যথাযথ ভাবে প্রক্ষেপণ করতে পারলে, লেখক সাধুবাদ পেতে পারতেন। এখন মনে হচ্ছে ফরমায়েসী লেখা! ধন্যবাদ।
প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনুস অন্ধের দেশে চশমা বিক্রি
আপনার লেখাটি খুবই চমৎকার ভাবে ডক্টর মুহম্মদ ইউনূস স্যার এর ভাল বাসার রুপ প্রকাশ পেয়েছে। কিছু কুত্তা "BAL" আছে যেগুলো ঘেউ ঘেউ করবেই।
জনৈক বিখ্যাত ব্যক্তির সাথে স্টারমার সাক্ষাত না দিয়ে যে অপমান করেছে এই বিষয়ে লেখক কি বলবেন? আর এই এওয়ার্ডে দেশের কি উপকার সাধন হলো?