ঢাকা, ১৭ মে ২০২৫, শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৮ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

শেষের পাতা

বিপজ্জনক এক সীমান্ত নিয়ন্ত্রণরেখা

মানবজমিন ডেস্ক
১৭ মে ২০২৫, শনিবার
mzamin

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ৩,৩২৩ কি.মি. দীর্ঘ সীমান্ত পৃথিবীর অন্যতম সংঘাতপ্রবণ ও বিপজ্জনক সীমান্ত হিসেবে পরিচিত। এর মধ্যে ৭৪০ কিলোমিটার দীর্ঘলাইন অব কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণরেখা বিশেষভাবে সংবেদনশীল। এই নিয়ন্ত্রণরেখা কাশ্মীর উপত্যকাকে বিভক্ত করে রেখেছে। এই সীমান্তে বসবাস করছেন হাজারো মানুষ, যারা প্রতিনিয়ত যুদ্ধ আর শান্তির মাঝখানে টিকে থাকার লড়াই করছেন। সম্প্রতি  পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এই সীমান্ত অঞ্চল। দুই পক্ষই একে অপরের দিকে গোলাবর্ষণ শুরু করে, যার ফলে অনেক ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায় এবং বহু মানুষ প্রাণ হারান। কানাডা প্রবাসী পাকিস্তানি লেখক আনাম জাকারিয়া বিবিসিকে বলেন, নিয়ন্ত্রণরেখার পাশে থাকা পরিবারগুলো ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংঘাতময় সিদ্ধান্তের শিকার। প্রতিবার গোলাগুলি শুরু হলে হাজার হাজার মানুষ বাংকারে আশ্রয় নেন। তারা জীবিকা হারান। গবাদিপশুর ক্ষতি হয়। স্কুল-হাসপাতালসহ অবকাঠামো ধ্বংস হয়। তার মতে, এই সীমান্ত কেবল দুই দেশের মধ্যে বিভাজন রেখা নয়, এটি একটি ‘রক্তে আঁকা রেখা’- যেখানে কাশ্মীরিদের কণ্ঠ অনুপস্থিত। ১৯৪৯ সালের যুদ্ধের পর এই সীমান্ত প্রথমে ‘সিজফায়ার লাইন’ নামে পরিচিত ছিল, যা ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তির মাধ্যমে ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। যদিও ২০০৩ সালের যুদ্ধবিরতির পর কিছুটা শান্তি বিরাজ করছিল, কিন্তু ২০০৮ সালের পর আবারো সংঘাত বেড়ে যায়। 

২০২১ সালে দুই দেশ ফের একটি যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে পৌঁছায়, যার ফলে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় ছিল। কিন্তু পেহেলগামের ঘটনার পর সেই শান্তিচুক্তি পুনরায় ভেঙে পড়ে। ভারতের পক্ষ থেকে সিন্ধুর পানি চুক্তি স্থগিত করা হয় এবং পাকিস্তান পাল্টা হুমকি দেয় ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি থেকে সরে আসার। যদিও তারা এখনো তা কার্যকর করেনি। নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর সংঘর্ষের পেছনে উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের চেয়ে অনেক বেশি ভূমিকা রাখে স্থানীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হ্যাপিমন জ্যাকব বলেন, এই সংঘর্ষের অনেকগুলোই মাঠপর্যায়ের সেনা কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তে শুরু হয়, যা কেন্দ্রীয় অনুমোদনের অভাবেও হতে পারে। তিনি আরও বলেন, এই সংঘর্ষের সময় ১০৫ মি.মি. মর্টার, ১৩০ ও ১৫৫ মি.মি. কামান এবং অ্যান্টি-ট্যাংক গাইডেড মিসাইলের মতো ভারী অস্ত্র ব্যবহৃত হয়। অথচ এই বিপজ্জনক প্রবণতা নীতিনির্ধারক ও গবেষকদের দৃষ্টির বাইরে থেকে যায়। 

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে সীমান্তে লড়াইয়ের কারণে পাকিস্তান শাসিত অঞ্চলের প্রায় ২৭,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হন। বর্তমানে ফের সেই আতঙ্ক ফিরে এসেছে। একটি হোটেলের কর্মচারী বলেন, আজকাল রাতে কেউ লাইন অব কন্ট্রোলের দিকে মুখ করে ঘুমাতে চায় না। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, নিয়ন্ত্রণরেখাকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব আবার বিবেচনায় নেয়া উচিত। তবে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের অধ্যাপক সুমন্ত বসু বলেন, এই ধারণা সম্পূর্ণ অবাস্তব। ভারত কাশ্মীরকে নিজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখে, আর পাকিস্তানের জন্য এটি একটি পবিত্র স্থান। তাই দুই দেশের ঐকমত্যে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত, বিশেষ করে নিয়ন্ত্রণরেখা, এক ভয়াবহ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি যেখানে রাজনীতি, যুদ্ধ এবং মানবিক বিপর্যয়ের এক জটিল সমীকরণ বিদ্যমান। সামান্য উস্কানি কিংবা হামলা পুরো সীমান্ত অঞ্চলে আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে। কবে সেই আগুন নিভবে আর সাধারণ মানুষ শান্তির নিঃশ্বাস ফেলবে, সেই প্রশ্ন এখনো অনিশ্চিত।

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status