অনলাইন
রাজনীতিতে আলোচিত ইস্যুগুলোর সুরাহা কোন পথে?
মুনির হোসেন
১২ মে ২০২৫, সোমবার
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছু বিষয় আবারো আলোচনায় এসেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই জনগণের মাঝে এক ধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়- সাংবিধানিক সংস্কার, মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, রাজনৈতিক সহিংসতার বিচার এবং দীর্ঘদিন ধরে গৃহীত দমনমূলক নীতির অবসান। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ধৈর্যচ্যুতি, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ এবং সরকারের অভ্যন্তরীণ জটিলতা নতুন করে প্রশ্ন তুলছে- এই সংকটের সমাধান আদৌ সম্ভব কিনা। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণ ও জুলাই ঘোষণা নিয়ে এক ধরনের ঢিলেমি দেখা দিচ্ছে- যা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অধীনে ধারাবাহিক সংলাপ হলেও, তাতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য গড়ে ওঠেনি। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, নির্বাচনকালীন সরকার কাঠামো এবং জাতীয় গণপরিষদ গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে মতপার্থক্য প্রকট।
৫ই আগস্টের পর থেকেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণের দাবি ওঠে, কিন্তু নানা রাজনৈতিক সমীকরণে সরকার এখনো তা কার্যকর করতে পারেনি। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার মধ্যদিয়ে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা হলেও, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনায় বিষয়টি আবার আলোচনায় আসে। শুক্রবার দুপুরে যখন এ নিবন্ধ লেখা হচ্ছে তখনো আন্দোলনকারীরা যমুনার সামনে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে অবস্থান করছিলেন। অত্যন্ত সংবেদনশীল এলাকা যমুনার সামনে আগের দিন রাত থেকে ছাত্র-জনতার অবস্থানসহ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণে সরকারের ওপর যে চাপ বাড়ছে তা দৃশ্যমান।
অবশ্য আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি একটি স্পর্শকাতর ও জটিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। একদিকে দলটির বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগ ও দীর্ঘদিনের ক্ষমতার অপব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে; অন্যদিকে, এটিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ার হিসেবে দেখার প্রবণতাও রয়েছে। আইন কি এই নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করে? যদি করে, তবে সে আইনের প্রয়োগ কি রাজনৈতিক বিবেচনায় বন্ধ থাকবে? আবার, একটি প্রধান রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করলে দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা ও সংঘাতের ঝুঁকি কতোটা বাড়বে? এই সিদ্ধান্তে কৌশল, ন্যায়বিচার ও ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক কাঠামো-সবকিছুর ভারসাম্য রাখতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে কী করবে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার। কীভাবে হবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বন্দোবস্ত সে প্রশ্ন সামনে আসছে।
জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ যে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছে সেখান থেকে দলটির নিষিদ্ধের দাবি অমূলক নয়। কারণ দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে হত্যাযজ্ঞে মেতেছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। দলটির নিষেধাজ্ঞার দাবি নিয়ে বৃহস্পতিবার রাত থেকে কঠোর অবস্থানে রয়েছে ছাত্র-জনতা। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে তারা রাত থেকে সকাল পর্যন্ত অবস্থান নেন। শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে মিছিল নিয়ে যমুনার পাশে ও ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের পাশের ফোয়ারার সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করেন তারা। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে দেন নানা স্লোগান। আন্দোলনকারীরা মঞ্চের সামনেই জুমার নামাজ আদায় করেন। মঞ্চ থেকে দেয়া হয়েছে আজান। জমায়েতের আগে দল-মতনির্বিশেষে সবাইকে এতে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত ফ্যাসিস্ট গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দিয়ে নিবন্ধন বাতিল করে নিষিদ্ধ করা হয় এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় সুস্পষ্ট রোডম্যাপ উপস্থাপন করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা রাজপথ ছাড়বেন না। হাসনাত আব্দুল্লাহ’র ডাকে শুরু হওয়া এ আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জুলাই অভ্যুত্থানকারীদের প্ল্যাটফরমগুলো অংশ নেয়।
আন্দোলনকারী আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে যখন চূড়ান্ত আন্দোলনে রয়েছেন তখন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, একটি দলের এক্টিভিস্টরা বলে বেড়াচ্ছেন- বারবার লীগ নিষিদ্ধের আইনি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে ছাত্ররা রাজি ছিল না। এটা মিথ্যা কথা। আমার কেবিনেটে প্রথম মিটিংয়ে স্পষ্টভাবে এ আইনের অনেকগুলো ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। নাহিদ-আসিফও আমার পক্ষে ছিল। শুক্রবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, দল হিসেবে বিচারের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হলে একজন উপদেষ্টার জবাব ছিল ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের মতো পশ্চাৎপদ উদাহরণ আমরা আমলে নিতে পারি কিনা। এ যুক্তি যিনি দিয়েছিলেন, একটি দলের এক্টিভিস্টরা আজ সমানে তার পক্ষে স্ট্যাটাস দিয়ে যাচ্ছেন ছাত্রদের কুপোকাত করতে। অথচ, উনার সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। মিছে বিরোধ লাগানোর অপচেষ্টা করে কোনো লাভ নেই।
তথ্য উপদেষ্টা লেখেন, বলে রাখা ভালো, দুজন আইন ব্যাকগ্রাউন্ডের উপদেষ্টা (একজন ইতিমধ্যে মারা গিয়েছেন) ও আমাদের বক্তব্যের পক্ষে ছিলেন। সংস্কৃতি উপদেষ্টাও পক্ষে ছিলেন। গতকাল (গত বৃহস্পতিবার) বিকালে কথা হয়েছে। দল হিসেবে লীগের বিচারের প্রভিশন অচিরেই যুক্ত করার আশ্বাস দিয়েছেন উক্ত উপদেষ্টা। উনাকে ধন্যবাদ। মিথ্যা বলা বন্ধ করুন। ঘোষণাপত্র নিয়ে আপনাদের দুই মাস টালবাহানা নিয়ে আমরা বলবো। ছাত্রদের দল ঘোষণার প্রাক্কালে আপনারা দলীয় বয়ানের একটি ঘোষণাপত্র নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলেন। সমস্যা নেই, আমরাও চাই সবাই স্বীকৃত হোক। কিন্তু, এখন সেটাও হতে দিবেন না। দোষ আমাদেরও কম না। আমরা আপনাদের দলীয় প্রধানের আশ্বাসে আস্থা রেখেছিলাম।
মাহফুজ তার সে স্ট্যাটাসে নির্বাচন নিয়েও মন্তব্য করেন। বলেন, ডিসেম্বর টু জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। আমরা নির্বাচন পেছাতে চাই না। আপনারা যদি মনে করেন, ছাত্ররা নিজেদের আদর্শ ও পরিকল্পনা নিতে পারে না বরং এখান থেকে, ওখান থেকে অহি আসলে আমরা কিছু করি, তাহলে আপনারা হয় ছাত্রদের খাটো করে দেখছেন, নয়তো ছাত্রদের ডিলেজিটিমাইজ করার পরিকল্পনায় আছেন। সেই আগস্ট থেকেই আমরা জাতির জন্য যা ভালো মনে করেছি, সবার পরামর্শ নিয়েই করেছি। বরং, উক্ত দলকেই আমরা বেশি ভরসা করেছি। সবার আগে উনাদের সঙ্গে পরামর্শ করেছি। ভরসার বিনিময়ে পেয়েছি অশ্বডিম্ব। সব দোষ এখন ছাত্র উপদেষ্টা নন্দঘোষ! অন্তর্বর্তী সরকারের এই উপদেষ্টা লেখেন, আমরা উক্ত দলকে বিশ্বাস করতে চাই। উক্ত দলের প্রধানকে বিশ্বাস করতে চাই। উনি আমাদের বিশ্বাসের মূল্য দিয়ে লীগ নিষিদ্ধ প্রশ্নে ও ঘোষণাপত্র প্রকাশে দেশপ্রেমিক ও প্রাগমাটিক ভূমিকা রাখবেন বলেই আস্থা রাখি। উক্ত দলকে নিয়ে কে কী বলবে জানি না কিন্তু আমরা চাই উক্ত দল ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে দেশের পক্ষে, অভ্যুত্থানের শত্রুদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ঐকমত্যের নেতৃত্ব দিক। দেশপ্রেমিক ও সার্বভৌমত্বের পক্ষের শক্তি হিসেবে নেতৃত্ব দিলে ছাত্ররা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় উনাদের সঙ্গে চলবেন।
এর আগের দিনও মাহফুজ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ইস্যু নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ডিসেম্বরের পর সহযোগী ভূমিকায় নেই। ক্ষমতার ভরকেন্দ্র অনেকগুলো। ফলে কাজের দায় সরকারের, কিন্তু কাজ করে ক্ষমতার অন্যান্য ভরকেন্দ্র। জোড়াতালি দিয়ে গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্ভব না, সম্ভব নয় রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। রাজনৈতিক দলগুলো ডিসেম্বরের পর সহযোগী ভূমিকায় নেই। কিন্তু ঠিকই প্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশে তারা স্টেইক (অংশীদারিত্ব) নিয়ে বসে আছেন। এস্টাবলিশমেন্ট দ্বিদলীয় বৃত্তে ফিরতে এবং ছাত্রদের মাইনাস করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘কৈফিয়ত কিংবা বাস্তবতা’ শিরোনামে দেয়া এক স্ট্যাটাসে এসব দাবি করেন তিনি। মাহফুজ বলেন, প্রায় তিন ডজন নিয়োগপ্রাপ্তদের (উপদেষ্টা) মধ্যে ছাত্র মাত্র দু’জন। ছাত্র প্রতিনিধিদেরও এস্টাবলিশমেন্ট প্রেসিডেন্ট অপসারণের ঘটনার পর থেকে কোণঠাসা করে রেখেছে। আমরা দু’জন সর্বোচ্চ ব্যালেন্সিং অ্যাক্ট করতে পারছি, কিন্তু প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে হলে সরকারে সুষম ছাত্রপ্রতিনিধিত্ব লাগবে।
তিনি আরও বলেন, এস্টাবলিশমেন্ট দ্বিদলীয় বৃত্তে ফিরতে এবং ছাত্রদের মাইনাস করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ছাত্রদের পরিপূর্ণ অসহযোগিতার মুখে ইতিমধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। এ অবস্থার সমাধান হলো রাষ্ট্র ও এস্টাবলিশমেন্টে ছাত্রদের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা এবং ফ্যাসিবাদী শক্তি ও তার দালালদের বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে আঘাত করা। মাহফুজ লেখেন, ছাত্রদের কয়েকটি দল হয়ে যাওয়ায় তারা এখন বিভক্ত, তদুপরি অন্য রাজনৈতিক দলের মতোই তারা ট্রিটেড হচ্ছেন। এ জন্য নাগরিক কমিটিই ছিল দীর্ঘমেয়াদে অভ্যুত্থানের ফোর্স হিসেবে টেকসই। যাই হোক! এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফরম দেশব্যাপী ছাত্রদের গুছিয়ে উঠতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অভ্যুত্থানের ছাত্র-জনতা বিভক্ত ও দ্বিধান্বিত। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র কম্প্রোমাইজড (আপসকামী)। মিডিয়া ও ব্যবসায়ে লীগের আধিপত্য কমেনি। লীগের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে হাত দেয়া যায়নি। পুরনো দ্বিদলীয় বন্দোবস্ত টিকে গেছে। বিচার বিভাগ এখনো দ্বিদলীয় বৃত্তে বন্দি। বাম-ডানের কালচারাল ক্যাচাল জুলাইকে দুর্বল করেছে এবং শাহবাগ-শাপলাকে চিরন্তন করে তুলেছে।
মাহফুজের এসব স্ট্যাটাস থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে তিনি সরকারে থেকেও স্বস্তিতে নেই। বিভিন্ন সময় তাকে নানা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তার দাবি তিনিসহ দুই ছাত্র উপদেষ্টা সরকারে কোণঠাসা। প্রশ্ন হচ্ছে কারা তাকে কোণঠাসা করছেন। কারা বাধা দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের। বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন ও সরকার নিতে পারে। আমরা এই সিদ্ধান্ত নেয়ার মালিক না। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের কথা বলছে। আমরা বিএনপি হিসেবে তো, এই সিদ্ধান্ত নেয়ার মালিক নই। আমাদের মহাসচিব ইতিমধ্যে তো বলছেন, জনগণের সিদ্ধান্তের বিষয় এটি। জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে তারা নির্বাচন করবে কি করবে না। এটা হচ্ছে আমাদের বক্তব্য। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আসবে কি আসবে না, তাদেরকে গ্রহণ করা হবে কি হবে না, তাদের নিষিদ্ধ করা হবে কি হবে না- এটা আওয়ামী লীগকে জিজ্ঞাসা করেন। তারা কি আসলেই নির্বাচন করতে চায়, তারা কি আসলেই গণতন্ত্র চায়? এটা তো আওয়ামী লীগকে বলতে হবে।
এর আগে গত ৫ই এপ্রিল হেফাজতের সঙ্গে এক আলোচনা শেষে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আওয়ামী লীগকে বিচারের আওতায় আনার দাবি আমরা প্রকাশ্যে করেছি। লিখিতভাবে করেছি। সরকারকে জানিয়েছি। আমরা চাই আওয়ামী লীগকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচারের আওতায় আনা হোক। এজন্য সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইন করা যায় এবং আইন সংশোধন করা যায়। জামায়াতও বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে। দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। এমনকি শুক্রবার যমুনার সামনে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভেও অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি করেছে দলটির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ।
এদিকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ চান না আইন উপদেষ্টা এমন অভিযোগের জবাবে শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণের সুযোগ রাখার লক্ষ্যে আইসিটি আইনে সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার বিধান আইন মন্ত্রণালয়ের খসড়ায় ছিল। আইন উপদেষ্টা হিসেবে আমি নিজে এটা উপদেষ্টা পরিষদের সভায় উত্থাপন করেছি। আমার উত্থাপিত খসড়ার আমিই বিরোধিতা করবো এটা কীভাবে সম্ভব? কে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় কী ভূমিকা রেখেছে এ নিয়ে আমাকে, ছাত্র উপদেষ্টাদের বা অন্য কাউকে দোষারোপ করা থেকে বিরত থাকুন। সেখানে যা সিদ্ধান্ত হয় তার দায় দায়িত্ব আমাদের প্রতিটি উপদেষ্টার। আমাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রশ্নে কোনো দ্বিমত নেই। তবে পদ্ধতি নিয়ে সবার নিজস্ব মত থাকতেই পারে।
অন্যদিকে ‘জুলাই ঘোষণা’ নিয়েও মতবিরোধ রয়েছে রাজনৈতিক দল ও অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে। অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো মনে করে তারা যদি একটি ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করতে না পারে তাহলে ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবে তারা অভ্যুত্থানের শক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে। যেটি পরিস্থিতি জটিল করতে পারে। তাই এর সমাধান এখনই দরকার। জুলাই ঘোষণা তারা সংবিধানে যুক্ত করতে চায়। সরকার এটি সবার মতামতের ভিত্তিতে করতে চায়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নিয়মিত এ বিষয়ে কথা বলছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। শিগগিরই হয়তো জুলাই ঘোষণা নিয়ে একটি সমাধান আসবে। তবে সেখানে রাজনৈতিক দল ও অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর দাবি কতোটা বাস্তবায়ন হবে সে সংশয় রয়ে যায়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ অবশ্য আশাবাদী সবার মতামতের ভিত্তিতে একটি ঘোষণা প্রস্তুতের বিষয়ে।
অন্যদিকে সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে ছাত্ররা যে গণপরিষদ চাচ্ছে তার সঙ্গে বিএনপি একমত নয়। ছাত্ররাও এ বিষয়ে ছাড় দিতে নারাজ। তাই বিষয়টিও জটিল। তবে শেষ পর্যন্ত এটি হওয়ার সম্ভবনাও কম। সে ক্ষেত্রে ছাত্ররা কী সিদ্ধান্ত নেন সেটা দেখার বিষয়। তারা চান সংবিধানের মৌলিক সংস্কার। কিন্তু বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল তাতে সায় দিচ্ছে না।
নির্বাচনকে ঘিরেও জনমনে অনিশ্চয়তা কাটেনি। একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে থাকলেও, এখনো পর্যন্ত নির্বাচনকালীন কাঠামো এবং ভোটের সুনির্দিষ্ট সময়রেখা চূড়ান্ত হয়নি। যেটি নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে বিএনপি। কারণ দলটি দ্রুত নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চায়। যদিও সরকার একটি রোডম্যাপ দিয়ে দিয়েছে- ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন। যেটি ভালোভাবে গ্রহণ করতে নারাজ বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
সরকারের সামনে এখন তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। প্রথমত ছাত্র-জনতার অতীতের বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটানো। এক্ষেত্রে তাকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধসহ কয়েকটি কাজে হাত দিতে হবে। যেগুলোর সব করতে গেলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলও বাধা দিতে পারে। দ্বিতীয়ত রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, বাম ও ইসলামপন্থি দলগুলোর মধ্যে জাতীয় ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তোলাই বড় চ্যালেঞ্জ। আর সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংস্কার। ক্ষমতা কাঠামো ও সংবিধানের মৌলিক সংস্কারও বড় চ্যালেঞ্জ সরকারের কাছে।
সর্বোপরি বাংলাদেশের রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণ, জুলাই ঘোষণা, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার ও রাজনৈতিক সহিংসতার বিচার- এই ইস্যুগুলো একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। কোনো একটি বিচ্ছিন্নভাবে সমাধান করলেই চলবে না। সমন্বিত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্বচ্ছ একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকারকে এগোতে হবে। অন্যথায় রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠতে পারে এবং জাতির সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ ব্যাহত হতে পারে।
সূত্র- জনতার চোখ