অনলাইন
প্রত্যাবর্তন
লুৎফর রহমান
১২ মে ২০২৫, সোমবার
বেগম খালেদা জিয়া। নিতান্তই একজন গৃহবধূ থেকে রাজনীতির মাঠে পদার্পণ করেছিলেন। দলের কঠিন এক সময়ে নেতৃত্ব তুলে নিয়ে ছিলেন কাঁধে। রাজনীতিতে পা রাখার ১০ বছরের মাথায় দায়িত্ব পান দেশ পরিচালনার। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন সফল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পত্নী খালেদা জিয়া। এরশাদের স্বৈরশাসন থেকে গণতন্ত্রে ফেরার যুদ্ধে তিনি ছিলেন অগ্রসেনানী। মাঝে একদফা বিরতি দিয়ে ২০০১-এ দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। ’৯৬ সালের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী হয়েও দ্বিতীয় দফা নির্বাচন দিয়ে ছিলেন গণতন্ত্রের প্রতি অবাধ বিশ্বাসের কারণে। আওয়ামী লীগের লগি- বৈঠার আন্দোলনের ফল হিসেবে আসা এক- এগারোর সরকারের সময় থেকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মুখে পড়া খালেদা জিয়া আপসহীন থেকেই লড়েছেন পুরোটা সময়। কারাবরণ করলেও আপস করেননি ক্ষমতার সঙ্গে। মাইনাস টু ফর্মুলার আওতায় তাকে বিদেশ পাঠানোর চেষ্টায় একবারের জন্যও সায় দেননি। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে না দেয়ার চেষ্টার তীব্র বিরোধিতা করেছেন, প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে নানা প্রতিকূলতার কাছে হেরে যাওয়ার পর সেই নির্যাতন-নিপীড়নের মাত্রা আরও ঘোরতর হয়ে আসে। বিনা ভোটে একের পর এক সংসদ গঠন করে ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করা আওয়ামী লীগ প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে খালেদা জিয়াকে। একের পর এক মামলা, দুই সন্তানের ওপর নির্যাতন, বড় ছেলে তারেক রহমানের নির্বাসিত জীবন, ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে জোর করে বের করে দেয়ার ঘটনায় আঘাতগ্রস্ত খালেদা জিয়া একবারের জন্যও ভেঙে পড়েন নি। জারি রেখেছিলেন প্রতিবাদ। নেতাকর্মীদের মধ্যে আশা জাগিয়ে গণতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনের সারি থেকে। খালেদা জিয়াকে দমাতে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের সব কৌশল যখন ব্যর্থ তখনই কথিত দুর্নীতির মামলায় সাজা দিয়ে তাকে জেলে ঢুকানো হয়। ২০১৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি কারাগারে যাওয়ার পর থেকে গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে এসে আপসহীন নেত্রী হয়ে ওঠা খালেদা জিয়ার জন্য নতুন এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি হাজির হয়। নাজিম উদ্দিন রোডের পুরাতন কারাগারের স্যাঁতসেঁতে প্রকোষ্ঠে দীর্ঘদিন থাকায় নানা রোগ শোকে কাবু হয়ে পড়েন তিনি। শারীরিক অসুস্থতা গুরুতর হয়ে পড়ায় আওয়ামী লীগ সরকার বাধ্য হয় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে। বর্তমান বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের (পিজি) কক্ষে বন্দি থাকা খালেদা জিয়া গুলশানের বাসায় ফেরার অনুমতি পান করোনাভাইরাস মহামারির সুবাদে। শর্তে বন্দি খালেদা জিয়া প্রয়োজন হলেও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারেননি তখন থেকে। চিকিৎসকরা বাবার পরামর্শ দিলেও তা গ্রাহ্য করেনি হাসিনা সরকার। রাজনীতি বোদ্ধারা বলে আসছিলেন শেখ হাসিনার চরম আক্রোশের শিকার হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছিলেন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই নেত্রী।
কিন্তু বিধাতার নিখুঁত পরিকল্পনায় সেই নেত্রীর রাজকীয় প্রত্যাবর্তন হয়েছে দেশের রাজনীতিতে। জটিল রোগ, বয়সের ভার চাপা দিয়ে দেশের রাজনীতিতে তিনি ফের আবির্ভূত হয়েছেন এক শক্তিশালী চরিত্র হয়ে। দেশের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কেন্দ্র হয়ে ওঠা খালেদা জিয়া এখন গণতন্ত্রকামী কোটি কোটি মানুষের হৃদস্পন্দন। তাই তো আপসহীন এই নেত্রীর সুস্থতা কামনায় যেমন কোটি হাত একসঙ্গে মোনাজাত ধরে তেমনি সুস্থ হয়ে দেশে ফেরার সময় কোটি মানুষ উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত হয়। ৬ই মে লন্ডনে প্রায় চার মাস চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। নানা সময়ে তাকে নিয়ে শঙ্কা আর উদ্বেগে থাকা নেতাকর্মীরা তার সুস্থ হয়ে এই ফেরাকে রাজসিকভাবে বরণ করেছেন। উচ্ছ্বাস- আবেগে, ভালোবাসায় সিক্ত করেছেন প্রিয় নেত্রীকে। বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসা ফিরোজা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পথে পথে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন দলের লাখো নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। দেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে বেগম খালেদা জিয়া এখন এক মহীরুহ। গণতন্ত্রে ফেরার লড়াইয়ে তাকে ঘিরে এখন ডান-বাম রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, বেগম খালেদা জিয়া এখন অনেকটা সুস্থ। মানসিকভাবে সাবলীল। হুইলচেয়ারে করে ফিরোজা ছাড়া খালেদা জিয়া অবশ্য দুই পুত্রবধূর হাত ধরে হেঁটেই এবার ফিরোজায় ফিরেছেন। খালেদা জিয়ার এই সাবলীল ফেরায় শক্তি সঞ্চার করেছে বিএনপি’র নেতাকর্মী ও গণতন্ত্রকামী দেশবাসীর মনে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও খালেদা জিয়ার এই ফেরাকে দলের জন্য দেশবাসীর জন্য নয়া বার্তা হিসেবেই বর্ণনা করেছেন। গণ- অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের পর এখন গণতন্ত্রে ফেরার যে চেষ্টা চলছে তা গতিশীল রাখতে বেগম খালেদা জিয়া কেন্দ্রভূমে থাকবেন বলেই মনে করা হচ্ছে।
গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে খালেদা জিয়া: ১৯৮১ সালের ৩০শে মে চট্টগ্রামে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে যখন নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তখন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন নিতান্তই একজন গৃহবধূ। তিনি দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে তখন ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিলেন। জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর দল হিসেবে বিএনপি তখন বিপর্যস্ত এবং দিশাহারা। দলের হাল কে ধরবেন? এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলে নানা আলোচনা। দলের নেতারা তখন দ্বিধাগ্রস্ত। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। তৎকালীন সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও সাত্তারকে পছন্দ করতেন। কারণ তারা জানতেন যে, তিনি রাজনৈতিকভাবে দক্ষ নন এবং শারীরিকভাবে দুর্বল। তখন বিএনপি’র একটি অংশ চেয়েছিল কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্বের কাঠামো ঠিক করতে। আরেকটি অংশ, যারা রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের সরকারে ছিলেন তারা ওই চেষ্টার বিরোধী ছিলেন।
বিএনপি’র প্রয়াত নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তার ‘চলমান ইতিহাস: জীবনের কিছু সময় কিছু কথা’ বইতে লিখেছেন, সামরিক এবং শাসকচক্রের জন্য সবচেয়ে বড় ভয় ছিল খালেদা জিয়াকে নিয়ে। কারণ প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার জন্য খালেদা জিয়াই সে সময় সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হতে পারতেন। কিন্তু তড়িঘড়ি করে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য আব্দুস সাত্তারের মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হলো। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এইচ এম এরশাদ চেয়েছিলেন, আব্দুস সাত্তার যাতে হোন।
বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের বার্ধক্য এবং দল পরিচালনা নিয়ে অসন্তোষের কারণে তৎকালীন বিএনপি’র একাংশ খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আনার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু রাজনীতির প্রতি বেগম খালেদা জিয়ার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না তখন। এর কারণ হিসেবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রথমত জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড তার মনে গভীর দাগ কেটেছিল এবং তিনি মানসিকভাবে সে ধকল কাটিয়ে উঠতে পারছিলেন না। দ্বিতীয়ত খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে পরিবারের দিক থেকে তেমন কোনো উৎসাহ ছিল না। এ ছাড়া রাজনৈতিক ভাগ্য তাকে কোথায় টেনে নিয়ে যায় সেটি নিয়েও হয়তো খালেদা জিয়ার মনে চিন্তা ছিল। এসময় দলের নেতাকর্মীরা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন তিনি দলের হাল না ধরলে দল টিকবে না। দলের নেতাদের এই অনুরোধ গ্রহণ করেই ১৯৮২ সালের ৩রা জানুয়ারি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে খালেদা জিয়া আত্মপ্রকাশ করেন। সেদিন তিনি বিএনপি’র প্রাথমিক সদস্যপদ লাভ করেন। একই বছর ৭ই নভেম্বর জিয়াউর রহমানের সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে খালেদা জিয়া প্রথম বক্তব্য রাখেন।
‘বিএনপি: সময়-অসময়’ বইয়ে লেখক মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, বিএনপিতে যোগ দেয়ার পর থেকে খালেদা জিয়া বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া শুরু করেন। ১৯৮২ সালের ২৮শে জানুয়ারি শেরেবাংলা নগরে জাতীয় সংসদের নতুন ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট আব্দুস সাত্তার এবং প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানের সঙ্গে খালেদা জিয়াও উপস্থিত ছিলেন।
১৯৮২ সালের ২১শে জানুয়ারি বিএনপি’র চেয়ারম্যান নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। দলের মধ্যে তখন এনিয়ে বিভক্তি। দলের তরুণ অংশ চেয়েছিল খালেদা জিয়া দলীয় প্রধান হবেন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট আব্দুস সাত্তারকে বিএনপি’র প্রধান হিসেবে দেখতে আগ্রহী ছিল তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ। বিএনপি’র চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য একইসঙ্গে প্রার্থী হয়েছিলেন খালেদা জিয়া এবং রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার। এর ফলে এক বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। বিচারপতি সাত্তার দু’বার বেগম খালেদা জিয়ার বাসায় যান। বেগম খালেদা জিয়া তাকে তরুণ নেতৃত্বের মনোভাবে কথা জানান। এসময় বিচারপতি সাত্তার বেগম খালেদা জিয়াকে দলের সহ-সভাপতির পদ এবং দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান। কিন্তু বেগম জিয়া ব্যক্তিগত কারণে তা গ্রহণ করেননি। অবশেষে বিচারপতি সাত্তারের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর বেগম খালেদা জিয়া চেয়ারম্যান পদ থেকে তার প্রার্থী পদ প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচএম এরশাদ এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। তখন রাজনীতিতে সাত্তারের আর কোনো মূল্যই থাকেনি। তার বার্ধক্য, অসুস্থতা এবং নিষ্ক্রিয়তার কারণে দল থেকে তিনি আড়ালে পড়ে যান। আর আব্দুস সাত্তার আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি’র চেয়ারম্যান থাকলেও দল পরিচালনায় খালেদা জিয়ার প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন এবং এপ্রিল মাসের প্রথমে বিএনপি’র এক বর্ধিত সভায় তিনি ভাষণ দেন। সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের কয়েক মাস পরেই খালেদা জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। এরপর থেকেই সামরিক শাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠেন তিনি। আন্দোলনের সময় তাকে কয়েকবার আটক করা হলেও আন্দোলন থেকে সরে যাননি বিএনপি চেয়ারপারসন। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে বিএনপি জয়লাভ করে। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। পরে খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক জীবনে যতগুলো নির্বাচনে যত আসনে অংশ নিয়েছেন তার সবগুলোতেই জয়লাভ করেছেন।
১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বিএনপি’র অধীনে একটি বিতর্কিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে খুব অল্প সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঘটনা বাদ দিলে খালেদা জিয়া পূর্ণ মেয়াদে সরকার পরিচালনা করেছেন দুই বার। প্রথমবার যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন দেশ পরিচালনায় তিনি ছিলেন একেবারেই অনভিজ্ঞ। এমনকি সংসদেও তিনি ছিলেন নতুন। কিন্তু জীবনের প্রথম নির্বাচনেই খালেদা জিয়া পাঁচটি আসন থেকে লড়ে পাঁচটিতেই জয়লাভ করেন। তার রাজনৈতিক জীবনে যতগুলো নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, তার কোনোটিতেই পরাজিত হননি তিনি।
১৯৯১-৯৬ সালে সফলভাবে সরকার পরিচালনার পর ১৯৯৬ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারির বাধ্যবাধকতার নির্বাচন নতুন জটিলতা তৈরি করে। বাস্তবতা মেনে নিয়ে বেগম জিয়া নতুন করে নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই আবার ক্ষমতায় ফিরে বিএনপি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার দল বিএনপি’র ব্যাপক ভরাডুবির পেছনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ছিল বলে দলের অনেকে মনে করে থাকেন। এরপর থেকে দলটি রাজনৈতিকভাবে একের পর এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি রাজনৈতিকভাবে অনেকটা চাপে পড়ে যায়। তবে খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্তে এই নির্বাচন বর্জন করায় নির্বাচনটি বিনা ভোটের নির্বাচন হিসেবে আখ্যা পায়। অর্ধেকের বেশি এমপি ভোট ছাড়া এমপি হওয়ায় ওই সংসদের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠে। খালেদা জিয়ার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হয় তার বিরুদ্ধে করা দুর্নীতির মামলা। দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হওয়ার কারণে ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনে খালেদা জিয়া অংশ নিতে পারেননি। এই নির্বাচনে বিএনপি ও তাদের সমমনা দল অংশ নিলেও আওয়ামী লীগের ভোট চুরির নয়া কৌশলের কাছে দাঁড়াতেই পারেনি। পুলিশ ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে দিনের ভোট রাতেই হয়ে যায়। এ কারণে এই নির্বাচন আখ্যা পায় রাতের ভোটের নির্বাচন হিসেবে।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি সাজানো দুর্নীতি মামলায় সাজা দিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়। ওদিনই বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তারেক রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়। নাজিম উদ্দিন রোডের কারাগার আর পিজি হাসপাতাল এই দুই জায়গায় বন্দি ছিলেন খালেদা জিয়া। করোনা মহামারি আসার পর ২০২০ সালের ২৫শে মার্চ সরকার নির্বাহী আদেশে তার সাজা স্থগিত করে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর ছয় মাস পরপর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ বাড়াচ্ছিল সরকার। কিন্তু দুই শর্তের কারণে তিনি কার্যত বন্দি ছিলেন বাসায়। শুধু হাসপাতালে যেতে পারতেন। পরিবার এবং দলের পক্ষ থেকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার জন্য বার বার অনুমতি চাইলেও তাতে সাড়া দেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। দল এবং স্বজনরা বারবার আবেদন জানালেও তাতে কর্ণপাত করেনি ফ্যাসিস্ট সরকার।
৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট সরকারের একদিন পরেই বিএনপি’র চেয়ারপারসনকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেয়া হয়। এদিন বঙ্গভবনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানেরা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বৈঠকের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া হয়েছে।
গত ৭ই জানুয়ারি রাতে উন্নত চিকিৎসার জন্য কাতারের আমীর শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি নিজের রাজকীয় এয়ারলাইন্সের বিশেষ এয়ার এম্বুলেন্সে ঢাকা ছাড়েন বেগম খালেদা জিয়া। ৮ই জানুয়ারি সকালে হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছান। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি উন্নত চিকিৎসার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসনকে লন্ডনে ডেভেনশায়ার প্লেসে একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল ‘লন্ডন ক্লিনিকে’ ভর্তি করা হয়। সেখানে লিভার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জন প্যাট্রিক কেনেডির তত্ত্বাবধানে তিনি চিকিৎসাধীন আছেন। ঢাকা ছাড়ার দিনে গুলশানের বাসা থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ সড়কে অবস্থান নিয়ে বিপুল শুভেচ্ছা জানান। বিদেশ যাত্রার আগে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
৮ই জানুয়ারি সকালে হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছালে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানান ছেলে তারেক রহমানসহ স্বজনরা। সেখানে তারেক রহমানের মা’কে জড়িয়ে ধরার আবেগঘন ছবি খবরের শিরোনাম হয়। তারেক রহমান বরাবরের মতো নিজে গাড়ি চালিয়ে খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যান। সর্বশেষ ২০১৭ সালের জুলাইয়ে মা-ছেলের সর্বশেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল।
রাজসিক ফেরা: লন্ডনে চার মাস চিকিৎসা নিয়ে গত ৬ই মে দেশে ফিরেন খালেদা জিয়া। তার সঙ্গে ফিরেছেন দুই পুত্রবধূ জুবাইদা রহমান ও সৈয়দা শামিলা রহমান সিঁথি। জুবাইদা রহমান দেশে ফিরলেন ১৭ বছর পর। লন্ডনে চিকিৎসা নিয়ে খালেদা জিয়া এখন অনেকটাই সুস্থ আছেন। তিনি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরছেন এ বার্তায় ওদিন সকাল থেকে বিমানবন্দর থেকে গুলশান ফিরোজায় পথে লাখো নেতাকর্মীসহ সাধারণ জনগণকে তাকে শুভেচ্ছা জানান। আনন্দ ও উচ্ছ্বাসে বিএনপি চেয়ারপারসনকে স্বাগত জানায় তারা। খালেদা জিয়ার আগমনে উচ্ছ্বসিত ছিল নেতাকর্মী। পথে পথে তাকে অভ্যর্থনা জানান লাখো নেতাকর্মী। সিক্ত হন তাদের শুভেচ্ছায়। খালেদা জিয়া সাধারণত গাড়ির সামনে না বসলেও এদিন তাকে সেখানে আসন নিতে দেখা গেছে। পেছনের আসনে বসেন তার দুই পুত্রবধূ জুবাইদা রহমান ও সৈয়দা শামিলা রহমান সিঁথি। শুভেচ্ছা বিনিময় করে তার বাসায় পৌঁছাতে লেগে যায় ২ ঘণ্টারও বেশি সময়। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে হুইলচেয়ারেই চলাচল করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। এদিন সবাইকে অনেকটা বিস্মিত করে দিয়ে গুলশানে নিজ বাসায় ফিরোজায় ঢোকার সময় গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে প্রবেশ করেন খালেদা জিয়া। সড়কের পাশে অবস্থান নেয়া হাজার হাজার নেতাকর্মী জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা হাতে নিয়ে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানায়। বিএনপি নেত্রী গাড়ি থেকে হাত নেড়ে নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছার জবাব দেন। খালেদা জিয়ার এই রাজসিক প্রত্যাবর্তনে উচ্ছ্বসিত দলের নেতাকর্মীরা। আগামী দিনে গণতন্ত্রে ফেরার লড়াইয়ে, ’২৪- এর গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধে খালেদা জিয়ার এই প্রত্যাবর্তন নতুন আশার সঞ্চার করেছে বলেও মনে করা হচ্ছে।
সূত্র- জনতার চোখ