প্রথম পাতা
মুক্তগণমাধ্যম দিবসে বক্তারা
স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে না
স্টাফ রিপোর্টার
৫ মে ২০২৫, সোমবার
গণমাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্র হবে না। গণমাধ্যমকে স্বাধীনতা দিতে হবে, কথা বলতে দিতে হবে, লিখতে দিতে হবে। সংবাদপত্র যেটা বলতে চাইবে সেটাকে গ্রহণ করা বা পছন্দ না হলে বর্জন করা যায়। কিন্তু সে প্রতিষ্ঠানকে উড়িয়ে দেয়া, তার ওপর মব জাস্টিস প্রয়োগ করা কখনো গণতন্ত্রের মানদণ্ড হতে পারে না। আবার রাষ্ট্রের এমন কোনো আইনও থাকা চলবে না, যাতে সরকার গণমাধ্যমের গলা টিপে ধরতে পারে। স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে না।
গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। বিশ্ব মুক্তগণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে সম্পাদক পরিষদ। সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বক্তব্য রাখেন, সম্পাদক পরিষদের কোষাধ্যক্ষ ও দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজের সম্পাদক নূরুল কবীর, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি কবি হাসান হাফিজ, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি’র আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকারে থাকি আর না থাকি, নির্দ্বিধায়, দৃঢ়চিত্তে, স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, আমরা বরাবরই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলাম, আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকবো। এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে পারি। তিনি বলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যে নির্যাতন নিপীড়ন হয়েছে এবং যে সমস্ত আইনকানুন দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল তার বিপক্ষে আমরা লড়াই করেছি। এখনো করছি এবং ভবিষ্যতেও করবো। আমরা কখনো অন্যায়ভাবে অন্যের মতকে চাপিয়ে দেয়া সমর্থন করবো না। আরেকজনের মতের স্বাধীনতাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দেবো। সেটাতে আমাদের বিশ্বাস থাকুক, আর নাই থাকুক। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আমাদের অন্যতম বিষয়। যেটি আমরা আমাদের ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচিতেও রেখেছি।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিএনপিই সর্বপ্রথম কাজ করেছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, আমার দলই তো প্রথম, যারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে ওপেন করেছিল ১৯৭৫ সালে। তার আগে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশালের সময় চারটি ছাড়া সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সব সংবাদপত্রকে স্বাধীন করেছিলেন। তিনি বলেন, আমরা বলছি না যে, আমরা ধোয়া তুলসিপাতা। কিন্তু এ কথা নিশ্চয় বলতে পারি নিঃসন্দেহে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য অনেক বেশি কাজ করেছে বিএনপি। আমাদের সময় সংবাদপত্র ও সংবাদকর্মীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন তুলনামূলকভাবে অনেক কম ছিল। আমরা এখনো পর্যন্ত বিশ্বাস করি।
মির্জা ফখরুল বলেন, কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম বলছে, তারা যা বলছে তা ঠিক অন্যেরা ভুল। তা না হলে সে ফ্যাসিস্ট, ভারত ও আওয়ামী লীগের দোসর। এটা ঠিক না। আমি আগেও বলেছি যে, এতটুকু কথা কেটে প্রচার করে দেয় যে, আমি ভারতীয় দোসর। এটা যেন না হয় সে জন্য আমাদের সজাগ হওয়া উচিত। বিশেষ করে আমরা যারা বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই তাদের দায়িত্বটা অনেক বেশি। তরুণদেরও এটা মাথায় রাখতে হবে। তা না হলে হাজার হাজার তরুণের রক্ত এবং ১৫ বছর ৬০ লাখ মানুষের লড়াই ম্লান হয়ে যাবে।
সভাপতির বক্তব্যে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, আমাদের উপলব্ধি করতে হবে- গণমাধ্যম জনগণের সেবায় নিয়োজিত। দেশপ্রেমিক, সমাজকে উন্নত করতে চাই, বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, মত প্রকাশে বিশ্বাস করি এবং আমাদের সমস্ত কাজ সমাজকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। আমাদের গণমাধ্যম মুক্ত না। শেখ হাসিনা রিজিম জনধিকৃত হয়েছিলেন তার অন্যতম কারণ ছিল গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছিল না। আমরা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ অনেক আইনে ভিকটিম হয়েছিলাম। তবে এখনকার যে ব্যাপারটা সতিকারার্থে আমি উদ্বেগ প্রকাশ করছি। বর্তমানে ২৬৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা অথবা ভায়োলেন্ট মামলা চলছে। এটা কীভাবে সম্ভব? তিনি বলেন, এটা সাংবাদিকতা এবং আমাদের অসম্মানের কারণ। এটার অর্থ এই নয় যে কেউ দোষ করেনি। দোষ করে থাকলে সঠিকভাবে মামলা করে তাকে শাস্তি দেন। আমরা কেউই তার পাশে দাঁড়াবো না। ৬ থেকে ৭ মাস হয়ে গেছে তারা এই মামলায় পড়েছেন। এক কদমও এগোয় নাই ইনভেস্টিগেশনের ব্যাপারে। এই মুহূর্তে ১৩ জন সাংবাদিক জেলে আছেন। আমি আবার বলি তারা যদি অপরাধ করে থাকেন অবশ্যই তার বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু ৭-৮ মাস তারা জেলে কোনো বেইল (জামিন) পাচ্ছেন না। তাদের কোনো আইনি প্রক্রিয়া চলছে না, বিচার হচ্ছে না। তাহলে এইটা কি চলতে থাকবে?
আলোচনা সভায় দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, যে দেশে প্রশ্ন করার জন্য সাংবাদিকের চাকরি যায়, সেই দেশে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করছি। খুব অবাক লাগে, আমি বিস্মিত হই। জানি না আমি কাকে দায়ী করবো। আমি কি সরকারকে দায়ী করবো, না মালিককে দায়ী করবো। না সাংবাদিক ইউনিয়ন কী করেছে সে প্রশ্ন রাখবো। আমি মনে করি আমরা সম্পাদক পরিষদও ব্যর্থ হয়েছি। যাই হোক আত্মসমালোচনা দরকার যে, আমরা কতোটুকু করতে পেরেছি। স্বীকার করতেই হবে যে, পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে অনেকখানি। এক বছর আগে যে অবস্থা ছিল, সেই অবস্থা এখন আর নেই। অনেকখানি পাল্টেছে। তবে আমরা হতাশ হচ্ছি বেশ কিছু অ্যাকশনের কারণে। তিনি বলেন, সাংবাদিকদের ভেতরে যে অনৈক্য, বিভাজন সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে। আমি আশা করবো- পত্রিকায় পত্রিকায়, ইদানীং আবার টেলিভিশনে টেলিভিশনে যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে, এটা অবিলম্বে বন্ধ হবে। তা না হলে আমরা যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে গণমাধ্যমে কাজ করছি, সেটা ব্যাহত হবে। বিচ্যুত হবো সেই উদ্দেশ্য থেকে। মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, গণমাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্র হবে না- এটা পরিষ্কার। গণমাধ্যমকে স্বাধীনতা দিতে হবে, আমাদের কথা বলতে দিতে হবে, লিখতে দিতে হবে। আবার এটাও বলতে হবে, আমরা হঠকারিতা চাই না।
নিউএজ-এর সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, যখন সারা দুনিয়ায় প্রতি বছর একবার করে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করা হয় তার মধ্যদিয়ে প্রমাণিত হয় সারা পৃথিবীতে গণমাধ্যম নানা প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করে। বাংলাদেশে আজকে আমরা মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করছি। ঠিক এক বছর আগেও এইদিনে আমরা এই দিবসটি পালন করেছিলাম। কিন্তু এই দুটি দিবসের মধ্যে অনেক অনেক পার্থক্য সূচিত হয়েছে। পার্থক্য সূচিত হওয়ার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। সেটা আমরা ইতিবাচকভাবে নিয়ে যেতে পারি এটা শুধু গণমাধ্যমকর্মীদের ওপরই নির্ভর করে না। সেটা নির্ভর করে প্রধানত যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, আইন প্রণয়ন করেন। বাংলাদেশ মুক্তগণমাধ্যমের তালিকায় সারা বিশ্বের কয়েকশ’ দেশের নিচে অবস্থান করছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের পরিচালকবৃন্দ আইনকানুনের মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে খর্ব করে। তার জন্য রাজনীতিকরা প্রধান দায়ী।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, জুলাই-আগস্টের পরিবর্তনের পর প্রায় সকল বিষয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করে যেভাবে এগোবার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেটা মহত্ত্ব চেষ্টা। গণমাধ্যম আসলে কতোটা মুক্ত বা মুক্ত হতে পারে। গত ৫৩-৫৪ বছরের মধ্যে বর্তমানে যে সরকার ক্ষমতায় আছে এর মতো উদার দৃষ্টিভঙ্গি সরকার আসেনি। আগামীতে আসবে কিনা জানি না। যারাই ক্ষমতায় যাবেন তারা এই নীতিটাকে কীভাবে প্রণয়ন করবেন, কী করে বাস্তবায়ন করবেন। তিনি বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যত মামলা হয়েছিল সে মামলাগুলোর অনেকগুলো এখনো রয়ে গেছে। এটা ড. ইউনূসের মতো মানুষ যিনি বলেন ‘আপনারা প্রাণ ভরে সমালোচনা করেন, আমারও সমালোচনা করতে পারেন।’ উনি মামলাগুলো তুললো না কেন? আপনি যদি অবাধ, মুক্ত সাংবাদিকতা চান কোনো ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর প্রতিষ্ঠা করার কিংবা যারা গণতন্ত্রের পক্ষে তাদের অঙ্গীকার রাখতে চাই। আমাদের দলের পক্ষ থেকে সংগ্রাম, অঙ্গীকার আছে যে, আমাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য আমরা আমাদের সর্বোচ্চ লড়াইটা করবো। রাষ্ট্রের এমন কোনো আইন থাকা চলবে না, যাতে সরকার গণমাধ্যমের গলা টিপে ধরতে পারে। তিনি বলেন, একজন ব্যক্তি চাইলেন আর অনেকগুলো গণমাধ্যম খুলে ফেললেন, এ জায়গাটা বন্ধ হওয়া দরকার। গণমাধ্যমের মালিকানার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকার দরকার। যাতে সেখানে কোনো একচেটিয়া স্বার্থ কায়েম না হয় এবং একচেটিয়া স্বার্থের সেবক হিসেবেও গণমাধ্যম না দাঁড়ায়। এটা সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি’র আহ্বায়ক ও সাবেক তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকার গত ১৬ বছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর যে দলীয়করণ নীতি চালিয়েছে, গণমাধ্যমও তার বাইরে ছিল না। সুতরাং গণমাধ্যমকে এই ফ্যাসিজমের ভেতর থেকে বের করে আনতে আমাদের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা প্রয়োজন। কারণ বিগত সময়ে মিডিয়া ও ফ্যাসিজমের যে সম্পর্ক ছিল, সে আধিপত্য থেকে যদি মিডিয়া বের না হয়, তাহলে জুলাই পরবর্তী যে মুক্তগণমাধ্যমের চিন্তা আমরা করছি, তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে দেরি হচ্ছে। এই সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত। তাহলেই আমরা বলতে পারবো জুলাই পরবর্তী যে গণমাধ্যম আমরা চেয়েছিলাম, তা দৃশ্যমান হচ্ছে। নাহিদ ইসলাম বলেন, গণমাধ্যমের মালিকানার বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট হওয়া উচিত বলে মনে করি। কারণ অনেক করপোরেট মালিক বা একটি গোষ্ঠী গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে। ফলে তাতে গণমানুষের কথা না উঠে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ধারণ করে। তাই করপোরেট মালিকানায় কতোগুলো গণমাধ্যম থাকতে পারবে, তা নিয়ে আমাদের সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন।