শেষের পাতা
দ্য সানডে গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণ
ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ
মানবজমিন ডিজিটাল
৫ মে ২০২৫, সোমবার
কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর সামপ্রতিক সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়ায়, পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু নদের পানি চুক্তি স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে ভারত। ফলে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে উঠেছে। দুই দেশের উত্তেজনা বাংলাদেশেও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের দাবি, ভারত রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে সিন্ধু পানি চুক্তি ব্যবহার করতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ। ঢাকার এই উদ্বেগের মূলে রয়েছে ২০২৬ সালে ভারত-বাংলাদেশের গঙ্গা পানি চুক্তি নবায়নের বিষয়টি।
পানি বিশেষজ্ঞ নূতন মনমোহন বলছেন, গঙ্গা চুক্তি আগামী বছর নবায়নের কথা থাকলেও, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পানি বণ্টনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সন্দেহ দেখা দিতে পারে। মনোহর পারিকর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস (আইডিএসএ)-এর উত্তম সিনহা মনে করেন, যদিও ভারত ঐতিহ্যগতভাবে গঙ্গা চুক্তি সহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পানি বণ্টন ব্যবস্থাকে সম্মান করে আসছে, তবে ভবিষ্যতের আলোচনার সাফল্য নির্ভর করছে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটি মন্তব্যে নাখোশ হয়েছে দিল্লি। ড. ইউনূস ভারতের সংবেদনশীল উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের চেয়ে বাংলাদেশকে চীনের জন্য বেশি অগ্রাধিকার দেয়ায় ভালোভাবে নিতে পারেনি দিল্লি সরকার। ইতিমধ্যেই যার প্রতিক্রিয়া দিয়েছে তারা। প্রতিক্রিয়ায় গত ৮ই এপ্রিল থেকে রপ্তানিকৃত পণ্যের জন্য বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে ভারত।
এ ছাড়া লালমনিরহাট বিমান ঘাঁটির পুনরুজ্জীবন সহ চীনের সহযোগিতায় শিলিগুড়ি করিডোরের কাছে একটি কৌশলগত ঘাঁটি গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের নীতি থেকে নিজের প্রশাসনকে বের করে আনছেন ড. ইউনূস। এক্ষেত্রে কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ হয়েছে চীন ও পাকিস্তান। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সমপ্রতি ঢাকায় পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের আলোচনা করেছে, যার লক্ষ্য পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সফরের পথ প্রশস্ত করা। তবে, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণে সফরটি আপাতত স্থগিত করা হয়েছে।
ভারত-বাংলাদেশ গঙ্গা পানি চুক্তির নবায়ন দুই দেশের মধ্যে সামপ্রতিক দ্বিপক্ষীয় আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালের জুন মাসে হাসিনার ভারত সফরের সময় এটি বিশেষ গুরুত্ব পায়। জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতার (গণ-অভ্যুত্থান) আগে এটিই ছিল তার শেষ রাষ্ট্রীয় সফর। হাসিনার পতনের পর থেকে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চুক্তিটির বিষয়ে আলাপ অব্যাহত রেখেছে।
এ বছরের ৬ই মার্চ, কারিগরি দল যৌথ নদী কমিশনের অধীনে কলকাতায় চুক্তি নবায়নের বিষয়ে আলোচনা করতে একত্রিত হয় ভারত ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। সেসময় বাংলাদেশি প্রতিনিধিদল ফারাক্কায় যৌথ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রটিও পরিদর্শন করেন। ১৯৯৬ সালের ১২ই ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী এইচ. ডি. দেবগৌড়া এবং হাসিনার প্রথম মেয়াদে স্বাক্ষরিত ভারত-বাংলাদেশ গঙ্গা পানি চুক্তিতে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে পানি প্রবাহের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। তিন দশক পর পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে চুক্তিটি ২০২৬ সাল নাগাদ নবায়নের জন্য নির্ধারিত হয়েছে।
মনমোহনের পর্যবেক্ষণ বলছে, যদিও চুক্তিটি আগামী বছর নবায়নের জন্য প্রস্তুত, তবুও সিন্ধু পানি চুক্তির ওপর ভারতের চলমান স্থগিতাদেশ বাংলাদেশের সঙ্গে নদীর পানি বণ্টনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সন্দেহ তৈরি করতে পারে। সিনহা দ্য সানডে গার্ডিয়ানকে বলেছেন যে, গঙ্গা চুক্তি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভিত্তিপ্রস্তর, যা পানি বণ্টনের জন্য একটি কাঠামো প্রদান করে। ১৯৯৬ সালের চুক্তির ধারা ১২-তে বলা হয়েছে, চুক্তিটি স্বাক্ষরের পর কার্যকর হবে এবং ত্রিশ বছর ধরে বলবৎ থাকবে। পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে এটি নবায়নযোগ্য হবে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নবায়ন প্রক্রিয়াটি স্বয়ংক্রিয় নয়। পারস্পরিক সম্মতির জন্য উভয় পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি বা সমঝোতা প্রয়োজন। যদি উভয় পক্ষই অপ্রয়োজনীয় মনে করে তবে চুক্তিটি নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
প্রতিবেশীদের সঙ্গে পানি বণ্টন ব্যবস্থাকে সমর্থন করে আসছে ভারত। গঙ্গা চুক্তিটি তারই প্রতিফলন। তবে, এটা অনস্বীকার্য যে, এর পুনর্নবীকরণের জন্য কার্যকরী সংলাপ বিরাজমান রাজনৈতিক গতিশীলতার ওপর নির্ভর করবে। ভারত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সংলাপ চালাতে ইচ্ছুক এবং আশা করা যায় যে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই দিকেই এগিয়ে যাবে। তবে ভারত সংলাপ চালিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে মনে করেন ওই বিশ্লেষক।
গত বছরের মার্চে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল ৮৬তম যৌথ কমিটির কারিগরি বিশেষজ্ঞ বৈঠকে যোগ দিতে ভারত সফর করেন। হাসিনার অধীনে ২০২৪-এর নির্বাচনের পর সেটিই প্রথম সফর। আলোচনায় গঙ্গা চুক্তি পুনর্নবীকরণ এবং তিস্তা ও ফেনী সহ অন্যান্য নদীর পানি বণ্টনের ওপর আলোকপাত করা হয়েছিল।
মনমোহন উল্লেখ করেছেন যে, পূর্ব ভারতের ভূ-প্রকৃতি পশ্চিম অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে আলাদা। পশ্চিমে যেখানে পানির অভাব রয়েছে, সেখানে পূর্বাঞ্চলে রয়েছে পানির আধিক্য। পূর্বের বিশাল নদীগুলোকে কাজে লাগানো তাদের আয়তনের কারণে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। বিহার এবং ঝাড়খণ্ডে কয়লা খনি পোড়ার দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করে ভূগর্ভস্থ আগুন নেভানো যেতে পারে। আদর্শগতভাবে, একটি বিস্তৃত এবং দূরদর্শী পরিকল্পনার মধ্যে থাকবে এই অতিরিক্ত পানিকে বৃহৎ পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রবাহিত করে মধ্য ভারতের শুষ্ক অঞ্চলে বিশাল জলাধার তৈরি করা। এই মনুষ্যসৃষ্ট ‘জলপ্রবাহ’ মধ্য ভারতের অনুর্বর মালভূমিগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে এবং পানি-বঞ্চিত বাস্তুতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করতে পারে।
পাঠকের মতামত
উজানের পানি ভাটি এলাকাজুড়ে স্বাভাবিকভাবে আসবে ........ এটাই প্রকৃতির নিয়ম। ভাটি এলাকার অধিকার। অথচ ভারত রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশকে তার ন্যায্য পানি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করে আসছে !! যা অত্যন্ত বর্বর কাজ !