ঢাকা, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

অনলাইন

প্র চ্ছ দ র চ না

নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কতোদূর?

মুনির হোসেন

(১১ ঘন্টা আগে) ২৯ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার, ১০:৪১ পূর্বাহ্ন

mzamin

অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান সমপ্রতি এক নিবন্ধে মন্তব্য করেছেন, “রাজনীতির চিরন্তন শিক্ষা হলো সঠিক সময়ে সঠিক লড়াই করা।” তার মতে, গত সাত মাসে ভবিষ্যতের জন্য একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে ব্যর্থ হওয়ায় ছাত্রআন্দোলনের দীপ্তি ক্রমেই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। যদিও এ মন্তব্য অনেকের কাছে কঠোর বলে মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা তার পক্ষেই দাঁড়িয়েছে। ছাত্রদের নেতৃত্বে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপিকে গড়ে তোলার পথ এখন নানা পরীক্ষায় জর্জরিত। গণ-মানুষের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার ব্যবধান দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর পাশাপাশি, দলটির শীর্ষ নেতাদের কর্মকাণ্ডও নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে, যা প্রায়শই সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে উঠছে। আত্মসমালোচনার প্রবণতা দলটির অভ্যন্তরেও দেখা যাচ্ছে। তবে যাদের নিয়ে এই অস্বস্তি-তারা আদৌ বাস্তবতা উপলব্ধি করছেন কি-না, সেই প্রশ্নও অমূলক নয়।

২০২৪ সালের জুনে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্রআন্দোলন একসময় রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনের দাবিতে রূপ নেয়। এ আন্দোলনের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের একদলীয় কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। এর মাধ্যমে এ দেশের মানুষের অগাধ আস্থা অর্জন করেছিলেন ছাত্রআন্দোলনের নেতারা। গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও স্বচ্ছতার প্রত্যাশা সৃষ্টি হয় দেশের মানুষের মধ্যে। ৫ই আগস্ট পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অংশও হয়েছিলেন অভ্যুত্থানের নায়ক নাহিদ ইসলামরা। অন্যদিকে মাস পেরুতেই রাজনীতির নয়া বন্দোবস্ত নিয়ে হাজির হন নাহিদের সহযোদ্ধারা। “আমরা রাজনৈতিক দল নই, তবে আমাদের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক”- এমন কথা বলেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আত্মপ্রকাশ ঘটে জাতীয় নাগরিক কমিটির। এদেশের মানুষকে তারা নতুন রাজনীতির স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন। এক সময় সরকার ছেড়ে নাহিদ ইসলামও যোগ দেন এ উদ্যোগে। তার নেতৃত্বেই ফেব্রুয়ারিতে রাজনৈতিক নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির আত্মপ্রকাশ।

দীর্ঘ এ পরিক্রমায়, ছাত্র নেতারা টকশো, সভা-সমাবেশে বারবার পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তারা এক নতুন ধারার রাজনীতির স্বপ্ন দেখান। এতে জনগণের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়। তবে রাজনৈতিক দল গঠনের আগে-পরে তাদের কর্মকাণ্ডে কতোটা নতুনত্ব প্রতিফলিত হয়েছে, তা এখন মূল্যায়নের সময় এসেছে।
বিশেষ করে এনসিপি’র আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের পর থেকেই একাধিক নেতার বিরুদ্ধে এসেছে নিয়োগ-বাণিজ্য, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ। যারা কিছুদিন আগেও নিজেদের ‘ভাঙা ঘরের বাসিন্দা’ বলে পরিচয় দিতেন, তারাই এখন বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ছেন, শোডাউনের রাজনীতি করছেন। ফলে এনসিপি ‘নতুন রাজনীতির প্রতীক’ হিসেবে তার অবস্থান ধরে রাখতে পারছে না। এসব কর্মকাণ্ড পুরনো রাজনীতিকে সমর্থন করে। 
নেতাদের বিতর্কিত বক্তব্য, অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে অহেতুক দ্বন্দ্বে জড়ানো এবং নিজেদের ‘অভ্যুত্থানের একচ্ছত্র নায়ক’ দাবি করা- এসবই পুরনো রাজনীতির প্রতিচ্ছবি। এ ছাড়া, সংস্কার ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের দূরত্বও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এতে জনসমর্থনের ভিত্তিও দুর্বল হচ্ছে; পূর্বের মতো ছাত্র নেতাদের ডাকে সাড়া দিয়ে রাজপথে নামে না হাজার হাজার মানুষ।

রেহমান সোবহান তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, “চার দশক ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র দ্বিদলীয় আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে একটি তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজন ছিল।” এনসিপি-কে সেই সম্ভাব্য তৃতীয় শক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছিল। কিন্তু আত্মপ্রকাশের পূর্বপর্যায় থেকেই নেতারা নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন, যা দলের প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়ে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাহ উদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়মের অভিযোগে তাকে সাময়িক অব্যাহতি দেয়া হয়। এক্ষেত্রেও নতুনত্ব দেখাতে পারেনি এনসিপি। কারণ তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ শুরুতে আমলেই নেয়নি এনসিপি। মার্চের শুরুতে ওঠা অভিযোগের কারণে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে গত সোমবার। কারণ ওই দিন তানভীর সচিবালয়ে গিয়েছেন এমন একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এনসিপি এটিকে ‘শৃঙ্খলার প্রয়োগ’ বললেও, এ সিদ্ধান্ত বাস্তবিক অর্থে প্ররোচিত প্রতিক্রিয়া বলেই মনে হয়েছে অনেকের কাছে। 
তানভীরের বিরুদ্ধে আগেও ডিসি নিয়োগসহ সচিবালয়ে বিভিন্ন সরকারি কাজে প্রভাব খাটানো ও ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ ছিল। এনসিপি তানভীরকে অব্যাহতির চিঠিতে বলে, গত ১১ই মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আপনার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পাঠ্য বই ছাপার কাগজে কমিশন-বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। চিঠিতে সালাউদ্দিন তানভীরকে এনসিপি’র কেন্দ্রীয় শৃঙ্খলা কমিটির প্রধানের কাছে সাতদিনের মধ্যে লিখিতভাবে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, তাকে (তানভীর) কেন দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে না, তা জানতে চেয়ে কারণ দর্শানোর জন্য দলের আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন নির্দেশ দিয়েছেন। সাংগঠনিক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আগের মৌখিক সতর্কতা অমান্যের পরিপ্রেক্ষিতে সালাউদ্দিন তানভীরকে দলের সব দায়িত্ব ও কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় চিঠিতে। এর আগের দিন বাংলামোটরে রূপায়ন ট্রেড সেন্টারে এনসিপি’র তৃতীয় সাধারণ সভায়ও কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির নেতাদের কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তাকে। যদিও আত্মপক্ষ সমর্থন করে সব প্রশ্নের জবাব দেন তিনি। বলেন, কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারলে তিনি নিজেই পদত্যাগ করবেন। অবশ্য তানভীরের উত্থানও রহস্যেঘেরা। কোথা থেকে এলেন, কীভাবে দলে পদ বাগিয়ে নিলেন তা নিয়ে রয়েছে রহস্য। এনসিপি’র উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম হাত ধরে তানভীরের এনসিপিতে আসা বলে অনেকে দাবি করেন। তানভীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ- কোনোভাবেই নতুন রাজনীতির পক্ষে যায় না।

এ ছাড়াও পুরনো রাজনীতির দৃশ্যপট দেখা গেছে সারজিস আলমের নিজ জেলা পঞ্চগড় সফরের সময়ও। বিশাল গাড়িবহর নিয়ে এলাকায় শোডাউন দেয়ার বিষয়টি নিয়ে নানা সমালোচনার সৃষ্টি করে। চলতি মাসেই হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করার বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা দেখা যায়। তাই তো এনসিপি’র সাধারণ সভায় সারজিসকে নানা প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছিল। তার বিরুদ্ধেও স্বজনপ্রীতি ও তদবির বাণিজ্যের অভিযোগ উঠে। সেদিন আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দেন সারজিস। সংগঠনটির যুগ্ম সদস্য সচিব নুসরাত তাবাসসুমসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ওয়াসায় মাস্টাররোলে কর্মী নিয়োগে তদবিরের অভিযোগ উঠে। আরেক নেতা আব্দুল হান্নান মাসুদও নানা সময় আলোচনায় থাকছেন। দলের মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর অতিকথনে ডুবছে এনসিপি। এসব কিছুই নতুন রাজনীতিকে সমর্থন করে না বলে মনে করেন অনেকে। কিন্তু এনসিপি নেতারা সেগুলো কতোটুকু বুঝতে পারছেন- সে প্রশ্ন রাখাই যায়। এ ছাড়াও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও বর্তমান যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে গত কয়েক মাসে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। সোমবার তাকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপনও জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একই অভিযোগে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের আরেক নেতা ও স্বাস্থ্য উপদেষ্টার এপিএসকে। আবার উপদেষ্টা আসিফের বাবা বিল্লাল হোসেন তার নির্বাচনী এলাকায় এনসিপি’র নিয়ন্ত্রক। ছেলের মন্ত্রণালয়ের ঠিকাদারি লাইসেন্স নিয়ে গত সপ্তাহে আলোচনায় আসেন তিনি। এসবই নতুন রাজনীতির প্রত্যাশার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

নেতৃত্বের জবাবদিহি নিয়েও অসন্তোষ বাড়ছে। এনসিপি’র তৃতীয় সাধারণ সভায় নেতাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ ওঠে- যার মধ্যে ছিল আর্থিক অস্বচ্ছতা, একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, দায়িত্বহীনতা ও নেতৃত্ব সংকট। সেদিন এসব ইস্যুতে দলীয় কাঠগড়ার মুখোমুখি হতে হয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি’র শীর্ষ নেতাদের। জবাবদিহিতা চাওয়া হয়েছে আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ শীর্ষ নেতাদের কাছে। সেদিনের বৈঠকে এক নেতা খোদ দলটির রাজনীতি কতো শতাংশ আর বাকি আছে এমন প্রশ্নও তোলেন। বলেন, “নানা কর্মকাণ্ডে আমাদের ৬০ ভাগ রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাকি ৪০ ভাগ কতোটুকু ধরে রাখতে পারবো- এটা নিয়েও শঙ্কা আছে। জাতীয় রাজনীতিতে এনসিপি’র যে সম্ভাবনা ছিল তার ৩০ শতাংশ একজনের কারণেই নষ্ট হয়ে গেছে।” গণ-অভ্যুত্থানের সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা শীর্ষ ওই ছাত্র নেতার নামও উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, “এনসিপি বা নাগরিক কমিটির কোনো পদে না থেকেও তিনি সব জায়গায় হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছেন। তার কারণে আমাদের বৈঠকের সিদ্ধান্তও অনেক সময় গুরুত্ব পায় না।” অভিযোগ করা হয়, তার কারণে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। জুলাই ঘোষণাও বিলম্ব হচ্ছে। ওইদিনের সভায় আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্ব নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেন কেউ কেউ। তারা বলেন, এখন পর্যন্ত তার কাছ থেকে প্রত্যাশিত নেতৃত্ব পাচ্ছেন না। সংগঠন বিস্তারের দূরদর্শী কোনো চিন্তা হাজির করতে পারেননি নাহিদ। একইসঙ্গে আর্থিক বিষয়ে অস্বচ্ছতার বিষয়টিও উঠে আসে এনসিপি’র সাধারণ সভায়।

সমালোচনার পাশাপাশি সভায় তৃণমূলে সংগঠন বিস্তারের বিষয়টি আলোচনায় ছিল। যেখানে জেলা ও উপজেলা কমিটির ক্ষেত্রে আহ্বায়ককে ন্যূনতম ৪০ বছর বয়সী হতে হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। শৃঙ্খলা ও তদন্ত বিষয়ক একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে। প্রায় ১৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা সভায় অঞ্চলভিত্তিক সাংগঠনিক নীতিমালা নির্ধারণ, সংস্কার বিষয়ক প্রস্তাবনা প্রণয়ন, গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের বিচার ও গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি নির্ধারণ, সীমান্ত হত্যা বন্ধে কার্যকর পলিসি গ্রহণে সরকারের কাছে দাবি জানানো; ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান ইসরাইলি সহিংসতা ও ভারতে ওয়াক্‌ফ বিলের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে জনমনে স্বস্তি আনতে সরকারের কাছে জোর দাবি জানানোর বিষয়ে আলোচনা হয়। এখানেও প্রশ্ন উঠছে নতুন করে। কারণ যে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের অধিকাংশের বয়স ৩০-এর নিচে সে দল জেলা-উপজেলা কমিটির আহ্বায়কের বয়স নির্ধারণ করেছে ৪০ বছর।

ওই দিনের সভাসূত্র জানায়, এনসিপি’র সব সিদ্ধান্ত নির্দিষ্ট এক জায়গা থেকে আসছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যুগ্ম সদস্য সচিব আরিফ সোহেল। আরেক যুগ্ম সদস্য সচিব ‘জুলাই ঘোষণা’র দাবির প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা করেন। যেখানে তিনি উল্লেখ করেন- হঠাৎ করে বলা হচ্ছে ৫ দিনের মধ্যে জুলাই ঘোষণা লাগবে, যেটি কোনো ফোরামে আগে আলোচনা করা হয়নি। সভায় একাধিক নেতা জোর দিয়ে বলেন, সবাইকে নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেন। কাউকে জিজ্ঞেস না করে নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নিলে সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোনো নির্দিষ্ট জায়গা থেকে আসা সিদ্ধান্ত দলের সিদ্ধান্ত হতে পারে না। দলের আর্থিক বিষয়ে অস্বচ্ছতার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন। তিনি দাবি করেন, এ বিষয়ে যেন জবাবদিহিতা থাকে। কোথা থেকে টাকা আসছে, কোথায় খরচ করা হচ্ছে তা কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে স্পষ্ট থাকতে হবে। কোনো ব্যক্তির আর্থিক দায়ভার পুরো দল নিতে পারে না বলেও তিনি স্পষ্ট করেন। কেন্দ্রীয় কমিটির অনেকে মনে করেন, আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম প্রত্যাশা অনুযায়ী দল চালাতে পারছেন না। দুর্নীতি ও দলীয় নীতিবিরুদ্ধ কাজ করাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন নি। এ ছাড়া সংগঠনের বিস্তারেও নাহিদ ইসলাম ও সদস্য সচিব আখতার হোসেনের কার্যক্রমে খুশি নন বলে অনেকে সভায় উল্লেখ করেন। প্রায় দুই মাস অতিবাহিত হতে চললেও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব নির্ধারিত হয়নি। বিশেষ করে আহ্বায়ক কমিটির সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন তাদের কোনো দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে না বলে। সেদিনের সভা শুরুর আগে আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে বলে কয়েকজন জানান। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের শীর্ষ নেতারা এনসিপি’র সাধারণ সভার আগে রূপায়ন ট্রেড সেন্টারে এসে দলটির নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠক করেন। যেখানে তারা এনসিপি নেতাদের জানান, আপনাদের কারণে গণমানুষের কাছে আমাদের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আপনারা সংশোধন হন। নতুবা সামনে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।

ওদিকে এনসিপি’র সভায় বারবার উঠে আসে নেতাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার বিষয়ও। নেতাদের অবিবেচক স্ট্যাটাস ও মন্তব্য দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে বলেও অভিযোগ তোলা হয়। তাই নেতাদের ফেসবুক ব্যবহারে সতর্ক থাকতে বলা হয়। অবশ্য এর আগেও সতর্ক করা হয়েছিল। তবুও পাল্টাননি নেতারা। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একদিন পর গঠন করা হয় একটি শৃঙ্খলা ও তদন্ত কমিটি। কমিটির কাজ হচ্ছে নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত ও দলে শৃঙ্খলা আনা।

সব মিলিয়ে নয়া রাজনীতির বন্দোবস্তে শুরুতে হোঁচট খেতে হয়েছে এনসিপিকে। অন্যান্য দলের সমালোচনা করলেও তাদেরও যে পুরনো পথেই হাঁটতে হচ্ছে রাজনীতি করতে গিয়ে। তরুণ নেতৃত্ব ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়ের অভাব, নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব- সব মিলিয়ে এনসিপি এক ধরনের রাজনৈতিক শৈথিল্যে ভুগছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ সঠিকভাবেই বলেছিলেন, “এই ছাত্র নেতাদের বয়স কম, কিন্তু তাদের ম্যাচিউরিটির দরকার আছে। তা না হলে প্রতিপক্ষরা এ ভুলের সুযোগ নেবে।” যদিও এনসিপি’র শীর্ষ নেতৃত্ব এখনো আশাবাদী- পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলে নতুন রাজনৈতিক ধারা চালু করার বিষয়ে। এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপাদান আমাদের ভেতরও আসার চেষ্টা করছে। আমরা সেটাকে জবাবদিহির আওতায় আনছি। আমরা হয়তো নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা ও ভুলত্রুটির মধ্য দিয়েই যাচ্ছি। এটা আমরা অস্বীকার করি না। তবে যারা আমাদের সমালোচনা করছে তারাও চায় আমরা ভালো করি।”

প্রকৃতপক্ষে, নতুন রাজনীতি গড়ার প্রত্যয় যেমন সাহসের দাবি রাখে, তেমনি দরকার আত্মপ্রবঞ্চনাহীন আত্মসমালোচনা, কার্যকর নেতৃত্ব এবং সংগঠন গড়ে তোলার সক্ষমতা। না হলে ‘নতুনের’ মোড়কে পুরনোরই পুনরাবৃত্তি হয়ে দাঁড়াবে এনসিপি’র রাজনৈতিক যাত্রা। 

সূত্র: জনতার চোখ

অনলাইন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

অনলাইন সর্বাধিক পঠিত

‘দ্য উইক’ ম্যাগাজিনে তারেক রহমানকে নিয়ে কাভার স্টোরি/ ‘নিয়তির সন্তান’

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status