ঢাকা, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, সোমবার, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

সারা দেশে পাথর কোয়ারি খুললো, সিলেটে বন্ধ, রহস্য কী?

মিজানুর রহমান
২৮ এপ্রিল ২০২৫, সোমবার
mzamin

সন্তোষজনক কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই সিলেটকে বাদ দিয়ে সারা দেশের পাথর কোয়ারিগুলো খুলে দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। পরিবেশ বিপর্যয়ের অজুহাতে প্রায় ৮ বছর পাথর উত্তোলন বন্ধ রেখে আমদানিনির্ভরতা বাড়িয়েছে কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনা সরকার। ৫ই আগস্টের পর থেকে পাথর রাজ্য সিলেটসহ দেশের ৫১টি কোয়ারি খুলে দেয়ার দাবি জোরালো হচ্ছিল। তবে অতীতের ধারাবাহিকতায় তা বন্ধ রাখতে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছিলেন পরিবেশবাদীরা। মুখোমুখি বা পাল্টাপাল্টি ওই অবস্থায় উভয় দিক বিবেচনায় গতকাল একটি গ্রহণযোগ্য উপায় খুঁজতে বৈঠকে বসেছিল এ সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ। পাথর/সিলিকাবালু, নুড়ি পাথর/সাদা মাটি কোয়ারিসমূহের ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাটি হয় হাইব্রিড ফরমেটে। কেন্দ্র ছিল জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সভাকক্ষ ১২১। সভায় ফিজিক্যালি উপসি'ত থেকে সভাপতিত্ব করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান উপসি'ত ছিলেন। 

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, কোয়ারি থাকা জেলাগুলোর জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও দপ্তরের প্রতিনিধিরা অনলাইনে যুক্ত ছিলেন। সভায় খোলাসা করে বলা হয়, হাসিনা সরকার পরিবেশ রক্ষার নামে ৮ বছর ধরে কোয়ারিগুলো বন্ধ করে রাখলেও এক সেকেন্ডের জন্য পাথর লুট বন্ধ হয়নি। এতে শাসক দলের মদদপুষ্ট অসাধু নেতাকর্মীরা উপকৃত হয়েছে, কিন্তু  সরকার বছরে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে। ৫ই আগস্টের পর কোয়ারিগুলোর নিয়ন্ত্রণে হাত বদল হয়েছে। আগে এটি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাদের শেল্টারে পাথর লুট হতো। যার বখরা পেতো আওয়ামী প্রশাসন। ৫ই আগস্টের পর কিছু দিন বন্ধ থাকলেও এখন কোয়ারিগুলো থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন তথা লুটপাট অব্যাহত রয়েছে সমান গতিতে। এই লুটপাটে এখন ‘বহুদলীয়’ সিন্ডিকেট। যার মধ্যস্থতা করছে কোথাও বিএনপি নেতা, কোথাও সমন্বয়ক পরিচয়ধারী আবার কোথাও বা জামায়াত। পুনর্গঠিত সিন্ডিকেটে সামাজিক, ব্যবসায়িক এবং শ্রমিক পরিচয়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী যুক্ত রয়েছে। এ অবস্থায় মাঠ প্রশাসন তথা বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা প্রশাসকদের বক্তব্য ছিল হাজার হাজার কোটি টাকার পাথর লুট বন্ধ করতে প্রশাসন হিমশিম খাচ্ছে। যদিও অভিযান অব্যাহত রয়েছে। অভিযান শেষে স্থানচ্যুত হওয়ার আগেই ফের লুট শুরু  হয় এমন মন্তব্য করে এক কর্মকর্তা বলেন, সীমিত পরিসরে কোয়ারি খুলে না দিলে লুট পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না। এ সময় বিজিবি’র টহল বাড়ানোর কথাও ওঠে। যার যৌক্তিকতা নিয়ে খোদ সভাতে প্রশ্ন ওঠে। 

বলা হয়, বিজিবি’র কাজ সীমান্ত রক্ষা। পাথর লুট ঠেকানো নয়। পুলিশ লুট হওয়া পাথর পরিবহন বন্ধে উদ্যোগ নিতে পারে। কিন্তু  সেটি খুব একটি দৃশ্যমান নয়; বরং প্রশাসনের সাঁড়াশি অভিযানে গতকালও একজন পুলিশ সদস্যকে পাথর লুটের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ক্লোজ করা হয়েছে। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা সনাতন পদ্ধতিতে উত্তোলনের অনুমতি প্রদানের পক্ষে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। বলেন, সিস্টেমেটিক ইজারা দিলে অন্তত ইজারাদারকে জবাবদিহির মধ্যে রেখে অর্থাৎ পরিবেশ রক্ষা করে তার মাধ্যমে পাথর উত্তোলন করানো সম্ভব। এতে লুট ঠেকানো এবং রাজস্ব দু’টিই মিলতো। তারা ইসিএভুক্ত এবং মামলার আওতায় না থাকা দেশের সব কোয়ারি খুলে দেয়ার অনুরোধ জানান। মাঠের কর্মকর্তারা বলেন, ইজারা দিলে নির্ধারিত ইজারাদার পাথর তুলবে। এখন যে যার শক্তিমত্তা প্রদর্শন করে দিনে রাতে পাথর তুলছে, লুট করছে। কোথাও কোনো শৃঙ্খলা নেই। এটি চলতে পারে না। কোয়ারি বন্ধ থাকায় এ খাতে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ বাড়ছে। পাথর লুটকে কেন্দ্র করে নব্য সিন্ডিকেটের অভ্যন্তরীণ সংঘাত-রাহাজানি তথা অঞ্চল ভেদে অস্থিতিশীলতা চরম আকার ধারণের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু না, এ নিয়ে কোনো গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে হাঁটেনি উপদেষ্টা পরিষদ। মাঠ প্রশাসনের রিপোর্ট তথা বক্তব্যকে আমলে না নিয়ে তারা নিজেদের মতো করে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন! যা নিয়ে সভাতেই প্রশ্ন উঠে। বিশেষ করে পাথরের রাজ্য সিলেটের কোয়ারিগুলো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত রহস্যের জন্ম দিয়েছে। সরকারের হাজার কোটি টাকার রাজস্বের ক্ষতি তো বটেই, এ নিয়ে শান্ত সিলেট উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সভায় এও বলা হয়, ২০২২-২৩ সালে সিলেট অঞ্চলের ভয়াবহ বন্যার অন্যতম কারণ হিসেবে দীর্ঘদিন পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখায় নদীগুলোর পানি প্রবাহ বিঘ্নিত হওয়াকে চিহ্নিত করা হয়। 

সে সময় বলা হয়, নদীগুলোতে পাথর স্তূপের কারণে মৎস্য প্রজননও ঝুঁকিতে। সিলেট চেম্বার অব কমার্সের একাধিক সেমিনারে সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের সুযোগ উন্মুক্তকরণের জোর দাবি জানানো হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে শেখ হাসিনার সরকারের পথ ধরে পাথর রাজ্য সিলেটকে বাদ দেয়ার বিষয় জানতে চাইলে সভায় উপসি'ত একজন কর্মকর্তা বলেন, সারা দেশের গেজেটভুক্ত পাথর কোয়ারি, সিলিকাবালু কোয়ারি, নুড়িপাথর, সাদা মাটি উত্তোলনসহ অন্যান্য সকল কোয়ারির ইজারার পক্ষেই বলেছেন মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। কিন্তু  উপদেষ্টা পরিষদের ৩ সদস্যের মধ্যে এ নিয়ে বিভাজন দেখা দেয়। সিলেটের কোয়ারিগুলো উন্মুক্তকরণে কোনো অবস্থাতেই একজন উপদেষ্টা রাজি হননি। বরং তিনি পরিবেশ রক্ষায় আরও কঠোর হতে জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১২ সালে জাফলংয়ের পিয়াইন নদীসহ ১৫ কিলোমিটার পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ফলে ইসিএভুক্ত এলাকা জাফলং এবং মামলা থাকায় শারপিনটিলা থেকে পাথর উত্তোলনের সুযোগ নেই। এ বিষয়ে সবাই অবগত। কিন্তু  সিলেটের বাকি কোয়ারিগুলো কেন এখনো বন্ধ? তা নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় প্রশ্ন ওঠে। তবে কোনো সদুত্তর মেলেনি। এ বিষয়ে সভার সভাপতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সঙ্গে দেখা করে তার আনুষ্ঠানিক বক্তব্য চায় মানবজমিন। কিন্তু  তিনি কথা বলতে রাজি হননি। বরং রেফার করেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের কাছে। সচিবের দপ্তরে সন্ধ্যা অবধি অপেক্ষা, পিএস এর মাধ্যমে দফায় দফায় বার্তা পাঠানো বিশেষ করে উপদেষ্টার রেফারেন্স দেয়া হলেও সচিব কথা বলতে রাজি হননি। 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status