শেষের পাতা
নিয়ন্ত্রণে আসছে না চালের দাম নেপথ্যে সিন্ডিকেট
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২৬ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার
চালের বাজারে অস্থিরতা কাটছেই না। ফলে নিয়ন্ত্রণেও আসছে না দাম। বরং আরও বেড়েছে। এর মধ্যেই খাদ্য উপদেষ্টার ‘বাজারে চালের দাম কিছুটা বাড়বে’- এমন আভাসের পর নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী ও বাজার বিশ্লেষকরা। এ ছাড়া বন্যা, বাড়তি সরবরাহ খরচ, ডলারের দাম বৃদ্ধি ও আমদানি কম- এ রকম নানা অজুহাত দেখিয়ে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন মিলার ও করপোরেট ব্যবসায়ীরা।
গত কয়েক মাস ধরেই অস্থির দেশের চালের বাজার। মাঝেমধ্যে কমলেও তা স্থায়ী হচ্ছে না। বিভিন্ন সময় সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে দাম কমানোর কথা বলা হলেও কার্যকর কোনো প্রভাব পড়েনি। কাজে আসছে না চাল আমদানিতে শুল্ক ছাড়ের সুবিধা। সরকার নিজে আমদানি করছে, বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করছে, কিন্তু চালের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমছে না। অথচ গত কয়েক মাসে সরকারি পর্যায়ে চালের আমদানির প্রবণতা যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বেসরকারি পর্যায়েও আমদানি হয়েছে ভালো পরিমাণ চাল। বাজারে সরবরাহ ঘাটতিও নেই। কিন্তু দাম কমছে না।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, চাল ব্যবসায়ী চক্রদের সরকার শাস্তির আওতায় আনতে পারছে না। ভরা মৌসুমে কৃষক থেকে কম দামে ধান কিনে মজুত করে। এরপর বছর জুড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে তারা। এতে ভোগান্তিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, নতুন ধান ওঠা শুরু হয়েছে। এই মুহূর্তে চালের দাম বাড়ানোর কোনো কারণ নেই। রাজধানীর কাওরান বাজারের বরিশাল রাইস এজেন্সির বিক্রেতা জানান, বোরো মৌসুমের ধান ওঠা শুরু হয়ে গেছে। এখনো নতুন চাল বাজারে আসেনি। আসলে দাম কিছুটা কমতে পারে।
দুই উপদেষ্টার বক্তব্য: গত ১৩ই এপ্রিল বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছিলেন, দুই সপ্তাহের মধ্যে বাজারে বোরো ধানের চাল আসবে। নতুন ধান উঠলে চালের বাজার আরও সহনীয় হয়ে উঠবে। তবে বাণিজ্য উপদেষ্টার আশ্বাসের ঠিক উল্টো কথা জানালেন খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার।
কিন্তু ২৪শে এপ্রিল সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জে ধান সংগ্রহ অভিযান উদ্বোধন অনুষ্ঠানে খাদ্য উপদেষ্টা বলেন, ধান-চাল ক্রয় নিয়ে কোনো সিন্ডিকেট আর হবে না, হতে দেবে না সরকার। কৃষকের স্বার্থে বিগত বছরের চেয়ে কেজিতে চার টাকা বেশি দামে ধান-চাল ক্রয় করছে সরকার। সরকারের বেশি দামে কেনার কারণে বাজারে চালের দাম কিছুটা বাড়বে। এতে লাভবান হবেন কৃষক।
সরকার প্রতি কেজি ধান ৩৬ টাকা ও চাল ৪৯ টাকা কেজি দরে কিনবে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, বাজারে চালের মূল্য কিছুটা বাড়তে পারে। কৃষক পরিশ্রম করে ধান উৎপাদন করে তাদের উপযুক্ত মূল্য দিতে না পারলে কৃষক ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। এতে কৃষক লাভবান হবেন বলেও জানান তিনি।
বাজার পরিস্থিতি নিয়ে হোসেন নামে এক ক্রেতা বলেন, এক উপদেষ্টা বলছেন চালের দাম কমবে, আরেক উপদেষ্টা বলছেন দাম বাড়বে। বাজার আসলে কোন দিকে যাবে?
সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবি’র তথ্য বলছে, বাজারে গত এক বছরে সরু চালের দর বেড়েছে সাড়ে ১৪ শতাংশ। মাঝারি চালের প্রায় ৯ এবং মোটা চালের ৫ শতাংশ দর বেড়েছে। যদিও গত একমাসে দাম বাড়ার এই হার কিছুটা কম। তবে বাজারের চিত্র ভিন্ন।
রাজধানীর কাওরান বাজারের ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরু বা মিনিকেট চালের দাম বেশি বেড়েছে। বেড়েছে মোটা ও মাঝারি আকারের চালের দামও। খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি গুটি স্বর্ণা বা মোটা চাল ৫৩ থেকে ৫৫ এবং পাইজাম চাল ৫৬ থেকে ৫৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাসখানেক আগে এসব চাল অন্তত ২ টাকা কমে কেনা গেছে। বিআর-২৮ জাত বা মাঝারি চালের কেজি মাসখানেকের ব্যবধানে প্রায় ৩ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬৪ থেকে ৬৬ টাকায়। আবার ভালো মানের বিআর-২৮ জাতের চিকন চাল ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ মিনিকেট বলে বিক্রি করছেন ৭০ থেকে ৭২ টাকায়। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সরু চালের। ৮০ টাকার নিচে এখন সরু চাল মিলছে না। মানভেদে এ ধরনের চালের কেজি কিনতে ভোক্তাকে খরচ করতে হচ্ছে কেজিতে ৮০ থেকে ৯০ টাকা। এক-দেড় মাস আগে এ ধরনের চালের কেজি ছিল ৭৮ থেকে ৮৫ টাকা।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ১৬ লাখ ৮০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। বিপরীতে ২২শে এপ্রিল পর্যন্ত সরকারিভাবে আমদানি হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৯ হাজার টন। এ ছাড়া বেসরকারিভাবে আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল। সরকারি-বেসরকারি মিলে চলতি অর্থবছরের সাড়ে ৯ মাসে মোট আমদানি হয়েছে ১০ লাখ ৭৭ হাজার টন। সরকারের গুদামে বর্তমানে প্রায় ৯ লাখ টন চাল মজুত রয়েছে।
খুচরা আর মিলগেটে চালের দামের ব্যবধান অনেক বেশি বলে মনে করেন মিল মালিকরা। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুর রশিদ বলেন, এবার ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। চাল নিয়ে বেশি টেনশন করতে হবে না। ফলন অনেক ভালো হয়েছে। তবে মিল, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে সরকারের কঠোর নজরদারি দরকার। গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর কারণে মিলারদের বিপদে পড়তে হয়।
কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, বাজারে তদারকি নেই। করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও মিলার একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে দাম বাড়ান। যারা এই সিন্ডিকেটে জড়িত আবার তারাই আমদানিকারক। আমদানি ও মজুত সবই তাদের হাতে। ফলে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে বাজার। তবে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, চালের বাজার তদারকি হচ্ছে।
পাঠকের মতামত
চাউলের দাম আর কখনও নিয়ন্ত্রণে আসবে না। কারণ, আকিজ, মেঘনা গ্রুপ, এসিআই, স্কয়ারসহ সমস্ত কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলি এখন লক্ষ লক্ষ টন চাল গুদামজাত করে নিজেদের ব্র্যান্ডে ব্রান্ডিং করে বাজার জাত করে। সরকারের উচিত আইন করে এই এসব প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের উৎপাদিত পণ্য ছাড়া যেন কোন খাদ্য পন্য বাজারজাত করতে না পারে।
সবগুলোকে গ্রেফতার করে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক