শেষের পাতা
মানহীন শিক্ষা, চাকরি নিয়ে চরম হতাশা
সংকটে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা
স্টাফ রিপোর্টার
২২ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার
বগুড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউশন থেকে ট্যুরিজম অ্যান্ড হোটেল ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে ডিপ্লোমা করেছেন মুহিব ইসলাম। আর বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে অনার্স শেষ করেছেন আল-আমিন। তারা একইসঙ্গে একই পদে ঢাকার একটি অভিজাত হোটেলে চাকরি শুরু করেন। দু’জনেরই এটি প্রথম চাকরি। কিন্তু একই কাজ একই পদ হওয়া সত্ত্বেও মুহিবের বেতন ধরা হয় ১২ হাজার টাকা, আল-আমিনের ১৮ হাজার টাকা।
মুহিব ইসলাম বলেন, আমরা শুধুমাত্র ডিপ্লোমা করার কারণে কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছি। একই কাজ একই পদ হওয়ার পরেও এই বৈষম্য। তিনি বলেন, দু’জনের পার্থক্য তো আছেই। বেসিক কিছু বিষয় আমারা পিছিয়ে। প্রথমত, আমরা প্রাকটিক্যাল একটি বিষয়ের শিক্ষার্থী হলেও হাতে কলমে শিখেছি খুবই কম। আমরা একটি টেবিল সাজানোর মতোও উপকরণ পাইনি। আমাদের শিক্ষক ছিলেন না। আমাদের ভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক দিয়ে ক্লাস নেয়া হতো। এই বিষয়ে বিদেশে দক্ষকর্মী প্রেরণের সুযোগ আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই বিষয়ে নজর দেয়া হলে খুব সহজেই দক্ষ কর্মী পাঠিয়ে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গ্লাস অ্যান্ড সিরামিকস, বিশেষায়িত এই প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী ছিলেন মো. আব্দুল্লাহ। তিনিও একই বৈষম্যর শিকার। বলেন, আমি চাকরি করি আড়াই বছর ধরে। একবার বেতন বৃদ্ধির পর আমার বেতন হয়েছে ১৬ হাজার টাকা। কিন্তু একই পদে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা অনভিজ্ঞ একজনের স্যালারি ধরা হয় ১৮/২২ হাজার টাকা। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমরা কাজ কিন্তু একই করি। আমাদের চাকরির বাজারে গ্রহণযোগ্যতা আছে কিন্তু অর্থ নেই।
কেন এই বৈষম্য? জানতে চাইলে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের হিউম্যান রিসোর্স বিভাগের প্রধান শীলা জামিল বলেন, পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের প্রাকটিক্যাল নলেজ কিছুটা কম। যেমন, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন মডেলের মেশিন ব্যবহার করা হয়। এই মেশিনগুলো পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা চাকরি ক্ষেত্রে এসে প্রথম দেখে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের এই সমস্যা হয় না। তাদের একটা বেসিক ধারণা থাকে। আরেকটি প্রধান সমস্যা কমিউনিকেশন। আমার দীর্ঘ ১২ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতায় দেখেছি পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে কমিনিকেশন গ্যাপের পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসও কম থাকে।
একই সুরে কথা বলেন একটি মোবাইল এক্সসোসরিজ এসেম্বলিং কোম্পানির নিয়োগদাতা কবির হোসেন। তিনি বলেন, বেতন কম হওয়ার বিষয়ে আরেকটি কারণ হচ্ছে কনফিডেন্স। আমি চাইলেই অল্প বেতনে পলিটেকনিক পাস করা শিক্ষার্থী পাচ্ছি। তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এমন থাকে যে, চাকরি পেলেই হলো। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর জড়তা ছাড়া ভাইবা ফেস করে। আবার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভাইবায় বার্গেনিং করে বেতন ঠিক করে নেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বার্গেনিং না করলেও স্মার্ট স্যালারি ছাড়া যোগদান করেন না।
এই আত্মবিশ্বাসের অভাবটা কেন? জানতে চাইলে সরকারি একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউশনের শিক্ষক বলেন, মান নিয়ন্ত্রণের জায়গায় আমরা অনেক পিছিয়ে। আমাদের নির্দেশনা দেয়া হয় পাস করিয়ে দেয়ার জন্য। আমাদের অনেক সময় ৬ থেকে ৮ নম্বর পর্যন্ত গ্রেস মার্ক দিতে হয়। এটা প্রাকটিক্যাল সেক্টর। বিজ্ঞানের বিষয়। কিন্তু আমাদের সমাজের মিথ হয়ে দাঁড়িয়েছে লেখাপড়ায় যারা ভালো না তারা পড়বে পলিটেকনিক্যালে।
দেশে উন্নত প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে এক দশকে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী এগোতে পারেনি কারিগরি শিক্ষা। যার মধ্যে অধিকাংশই পর্যবষিত হয়েছে দুর্নীতিতে।
কোটি কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিলেও প্রধান কাজ শিক্ষার্থীদের উন্নয়ন ও পাঠের উন্নয়ন হয়নি। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় শিক্ষক পদের ৭০ শতাংশই শূন্য। নানা ধরনের ভবন করার উদ্যোগ নেয়া হলেও এসবে নজর দেয়া হয়নি। এ ছাড়াও জনশক্তি ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান ব্যুরোর অধীন কারিগরি প্রতিষ্ঠানেও প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষকের পদ শূন্য। যদিও সম্প্রতি প্রায় দুই হাজারের অধিক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। তার পরও নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক। টেকনোলজি ও কোর্সের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ল্যাবরেটরি নেই।
রংপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউশনের সাবেক শিক্ষার্থী নিবেদিকা সাহা বলেন, আমাদের নতুন ভবনের থেকেও অধিক জরুরি সিলেবাস আপডেট করা। আমাদের দেশের প্রচুর মানুষ বিদেশে যাচ্ছে আন-স্কিলড হয়ে। আমরা যদি এই শিক্ষার্থীদের আপগ্রেডেশনের মাধ্যমে তাদের বিদেশমুখী করতে পারি তবে দেশের জন্য অনেক ভালো হবে। কিন্তু আয়মুখী এই শিক্ষার প্রচারণা এতটাই নগণ্য যে, আমরা এর মূল্যায়নটাই বোঝাতে সক্ষম হয়নি।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোয় ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে মোট আসন ছিল ১ লাখ ৭১ হাজার ৫০০টি। এর বিপরীতে ভর্তি হয় ৬৮ হাজার ৭৮২ শিক্ষার্থী, যা বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অর্থাৎ প্রায় ৬০ শতাংশ আসন ফাঁকা। বিগত পাঁচ বছরের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মোট শিক্ষার্থী ভর্তি হয় ৮১ হাজার ৭৬ জন। ওই শিক্ষাবর্ষে আসন ফাঁকা ছিল ৫২ দশমিক ৮ শতাংশ। তার পরের শিক্ষাবর্ষে ৭৭ হাজার ২৭২ শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও ৫৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ ছিল শূন্য আসন। এ ছাড়া ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ছিল ৭৩ হাজার ২৭২ জন, ফাঁকা আসন ৫৮ দশমিক ৬২ শতাংশ; ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয় ৭১ হাজার ৫৫৩ শিক্ষার্থী, আর ফাঁকা পড়ে ছিল ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ আসন।
জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিতে (নায়েম) ২০২১ সালে দেয়া এ গবেষণায় দেখা যায়, ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের মধ্যে ৫৪ শতাংশ কর্মজীবী, ৪ শতাংশ উদ্যোক্তা, ৩৮ শতাংশ বেকার ও ৪ শতাংশ কাজে আগ্রহী নয়। তবে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বেকারত্বের হার বেশি। গ্রামাঞ্চলের মাত্র ৪৮ শতাংশ ডিপ্লোমাধারী কর্মক্ষেত্রে রয়েছেন। ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের ৪৪ শতাংশের মাসিক আয় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যে এবং ৪৩ শতাংশের আয় ১০ হাজার টাকার কম। মাত্র ১৩ শতাংশের মাসিক আয় ১৫ হাজারের ওপর।