বাংলারজমিন
বৃষ্টিতে প্রাণবন্ত চায়ের রাজ্য
ইমাদ উদ দীন, মৌলভীবাজার থেকে
২১ এপ্রিল ২০২৫, সোমবার
দীর্ঘ খরায় মুমূর্ষু অবস্থায় ছিল চা গাছ। নানা প্রতিকূলতায় সেচ দিয়েও রক্ষা করা যাচ্ছিল না। মৌসুমের শুরুতেই এমন প্রতিকূল আবহাওয়ায় কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কায় ছিলেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ দিন শেষে শ্রমিকদের ঝুড়িতে উঠে আসেনি পর্যাপ্ত কুঁড়ি। তাই ফ্যাক্টরিগুলো সচল রাখাও ছিল কষ্টকর। দীর্ঘ প্রায় ৫ মাস পর গেল কয়েকদিনের বৃষ্টিতে প্রাণ ফিরতে শুরু করছে চা গাছগুলোর। বৃষ্টিতে এখন অনেকটাই প্রাণবন্ত চা বাগান। তবে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পর্যাপ্ত বৃষ্টি ও রোদের অনুকূল পরিবেশ প্রত্যাশা চা-বাগান মালিক, শ্রমিক ও সংশ্লিষ্টদের। চায়ের রাজধানী খ্যাত মৌলভীবাজারের প্রতিটি বাগানে এখন সবুজ সতেজ চা গাছের দেখা মিলছে। বৃষ্টিতে মুমূর্ষু অবস্থায় থাকা প্রুনিং (গাছের পাতা ও ডালপালা ছাঁটানো) করা প্রতিটি চা গাছে এখন নতুন কুঁড়ি গজাতে শুরু করেছে। এমন দৃশ্য সম্ভাবনার হাতছানিতে হাসি ফুটছে এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদনেরও প্রত্যাশা তাদের। চা বাগানের উৎপাদন বাড়ার লক্ষ্যে প্রতি বছরই ডিসেম্বরের দিকে একবার করে চা গাছে প্রুনিং করা হয়। সবুজ সতেজ পাতাগুলো বিলীন হয়ে তখন কেবল রুক্ষ ডালপালার উপস্থিতি। এ সময় সাধারণত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় চা গাছগুলো বাঁচিয়ে রাখতে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজস্ব পদ্ধতিতে সেকশনগুলোতে ইরিগেশনের ব্যবস্থা করেন বাগান কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্টদের মতে, চা-বাগানে প্রতি বছর ১৫০ থেকে ২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন দেখা দেয়। যথাসময়ে বৃষ্টিপাত না হলে কিংবা অতিবৃষ্টি ও রোদের দেখা না মিললেও চায়ের উৎপাদনে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। জানা যায় দেশের মোট ১৬৭টি ছোট বড় চা-বাগানের মধ্যে সিলেট বিভাগে রয়েছে ১৩৪টি। এরমধ্যে শুধু মৌলভীবাজার জেলার ৭টি উপজেলায় রয়েছে ৯২টি চা-বাগান। এ ছাড়াও সিলেটের হবিগঞ্জে ২২টি, সিলেট সদরে ২০টি। এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছেন প্রায় ১২-১৫ লাখ মানুষ। একসময় রপ্তানিমুখী পণ্য হিসেবে বেশ সুনাম ছিল চায়ের। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অভ্যন্তরে চায়ের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কমেছে রপ্তানি। তাছাড়া নানা কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগেও ব্যাহত হয় উৎপাদন। দেশের অর্থনীতিতে সম্ভাবনাময়ী এই চা শিল্প নানা প্রতিকূলতা, দুর্যোগ ও সমস্যায় অন্তরীণ। তারপরও চায়ের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় বারবার রেকর্ড করে আশা জাগাচ্ছে এই অর্থকরী শিল্প। ২০০৫ সাল ও ২০১৩ সালে দেশে রেকর্ড সংখ্যক চা উৎপাদিত হয়। এরপর থেকে কমবেশি এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। ২০২৩ সালে দেশের ১৬৭টি চা-বাগান থেকে ১০ কোটি ২৯ লাখ কেজি চা উৎপন্ন হয়। যা বাংলাদেশে চা চাষের ১৭০ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উৎপাদন। আর ২০২৪ সালে উৎপাদন হয় ৯৩ মিলিয়ন কেজি। ২০২৫ সালে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০৩ মিলিয়ন কেজি। দেশে চায়ের উৎপাদন শুরু হয় ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনি ছড়া চা-বাগান থেকে। তবে এই সম্ভাবনার আড়ালে সংকটও কম নয়। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা সম্ভাবনাময় এই শিল্পকে বারবার থমকে দিচ্ছে। চা শিল্প বর্তমান সময়ে অতিক্রম করছে ক্রান্তিকাল। চা-বাগান শ্রমিক ও মালিকদের দাবি বাজার সিন্ডিকেট,পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে চোরাই পথে আসা ও দেশীয় মানহীন চা পাতা বাজার সয়লাব থাকায় তারা প্রকৃত মূল্য পাচ্ছেন না। তারা ক্ষোভের সঙ্গে বলছেন যদি খরচের সঙ্গে সমন্বয় করে সঠিক দাম নির্ণয় না করা হয় তাহলে চা-বাগানগুলোর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। তাদের দাবি চায়ের সঠিক মূল্য নির্ধারণ হলে, শ্রমিকদের মজুরি বাড়বে, চায়ের উৎপাদনও বাড়বে। এমনকি দেশের চাহিদার জোগান দিয়ে রপ্তানিও সম্ভব হবে। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলস্থ আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান মানবজমিনকে জানান, এপ্রিলের ১-২০ তারিখ পর্যন্ত মোট বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ৬১ মিলিমিটার। তবে এ সপ্তাহে হাল্কা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। বাংলাদেশীয় চা সংসদ সিলেট ব্রাঞ্চ চেয়ারম্যান এবং সিনিয়র টি-প্লান্টার গোলাম মোহাম্মদ শিবলী মানবজমিনকে বলেন, সাধারণত এই সময়টাতে বৃষ্টিটা চা-বাগানের জন্য খুবই উপকারী। এবছর দীর্ঘ প্রায় ৫ মাস বৃষ্টি না হওয়াতে উৎপাদনে অনেকটা পিছিয়ে। মৌসুমের শুরুতে পর্যাপ্ত বৃষ্টি ও রোদ হলে ‘ইয়াং টি’ ও প্রুনিংকৃত চা গাছগুলো দ্রুত কুঁড়ি ছাড়ে। তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ বছরও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব।