প্রথম পাতা
নানা আয়োজনে বর্ষবরণ
স্টাফ রিপোর্টার
১৬ এপ্রিল ২০২৫, বুধবার
রাতের নির্জনতা ভেঙে চারদিকে তখন ভোরের স্নিগ্ধতা। বৈশাখের শীতল হাওয়ায় দুলছে বাগানের পত্র-পল্লব। গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে রক্তিম সূর্য। সেই সূর্যের লাল আভা কোমল স্পর্শ বুলিয়ে দেয় রমনার নিবিড় সবুজ গাছের পাতায় পাতায়। এমনই মনোমুগ্ধকর পরিবেশে শিল্পী সুপ্রিয়া দাস ছড়িয়ে দিলেন ভৈরবী রাগালাপ। শান্ত শহরে যন্ত্রের সুর উদাসীন করে তোলে নগরবাসীকে। যে সুর জানান দেয়, নতুনের। স্বাগত বাংলা নববর্ষ ১৪৩২।
বরাবরের মতো রমনার বটমূলে এভাবেই বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেয় ছায়ানট। সোমবারের সে দৃশ্যের সাক্ষী হতে আগে থেকেই হাজির হয়েছিলেন সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ। ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ প্রতিপাদ্যে ছায়ানট এবারো মুক্তির প্রশ্নে আলোক সন্ধানী। প্রকৃতি, মানুষ, দেশকে ভালোবেসে আঁধার পেরিয়ে আলোর পানে যাত্রী হওয়ার আহ্বান ছিল এবারের পরিবেশনায়। যেখানে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, লালন ও বাংলাদেশের লোকজ ধারার বেশ কিছু গান স্থান পায়। ছায়ানটের দেড় শতাধিক শিল্পী তাদের ৫৮তম বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ৯টি সম্মেলিত ও ১২টি একক গান এবং ৩টি কবিতা আবৃত্তি পরিবেশন করে। সুপ্রিয়া দাসের রাগালাপের পর শিল্পীরা সম্মেলিত কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন ‘নতুন প্রাণ দাও, প্রাণসখা’। এরপর দীপ্র নিশান্ত পরিবেশন করেন ‘তিমির দুয়ার খোলো,’ সেঁজুতি বড়ুয়ার কণ্ঠে ছিল ‘আপনারে দিয়ে’। এরপর আবার সম্মেলিত কণ্ঠের গান ‘তুমি প্রভাতের সকরুণ ভৈরবী’। তারপর মোস্তাফিজুর রহমান গেয়েছেন ‘ভেঙেছে দুয়ার, এসেছে জ্যোতির্ময়’। এ ছাড়াও তোমার চরণ তলে দিও মোরে ঠাঁই, নতুন প্রাণ দাও, তিমির দুয়ার খোলো, মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান, ভাইয়ের দোরে ভাই কেঁদে যায়, মৃত্যু নাই নাই দুঃখ আছে শুধু প্রাণ ইত্যাদি। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ছায়ানট জানায়, বিশ্বব্যাপী যেমন ক্ষয়ে চলেছে মানবতা, তেমনি এদেশেও ক্রমান্বয়ে অবক্ষয় ঘটছে মূল্যবোধের। তবু আমরা আশাহত হই না, দিশা হারাই না, স্বপ্ন দেখি হাতে হাত রেখে সকলে একসাথে মিলবার, চলবার। বাঙালি জাগবেই, সবাই মিলে সুন্দর দিন কাটানোর সময় ফিরবেই। সার্থক হবেই হবে, মানুষ-দেশ, এ পৃথিবীকে ভালোবেসে চলবার মন্ত্র। সকাল সাড়ে ৬টায় শুরু হওয়া বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শেষ হয় জাতীয় সংগীত পরিবেশনার মধ্যদিয়ে। ওদিকে বর্ষবরণে এবারের ভিন্ন আঙ্গিকে অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আনন্দ শোভাযাত্রা। নাম বদলে এবার ফিরেছে পুরনো নামে। যে শোভাযাত্রায় এবার স্থান পেয়েছে বাংলার সব জাতি গোষ্ঠীর সংস্কৃতি। পাহাড় থেকে সমতল কাউকে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের অংশীদারিত্ব থেকে বাদ দেয়া হয়নি। সকলের বর্ণিল অংশগ্রহণে আনন্দ শোভাযাত্রা হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত। যেমনটি অতীতে দেখা যায়নি। নেচে-গেয়ে হাজার হাজার মানুষ অংশ নিলো ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’য়। এবারের পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য- ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী এ শোভাযাত্রায় স্থান পায় জুলাইয়ের প্রতিকৃতি। চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে সকাল ৯টায় শোভাযাত্রা শুরু হয়। শেষ হয় সকাল সাড়ে ১০টায়। এতে অংশ নেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. নিয়াজ আহমদ খান, প্রো-ভিসি (প্রশাসন) প্রফেসর ড. সায়মা হক বিদিশা, প্রো-ভিসি (শিক্ষা) প্রফেসর ড. মামুন আহমেদ, ট্রেজারার প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী প্রমুখ। শোভাযাত্রাটি চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ মোড়, টিএসসি মোড়, শহীদ মিনার, শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্র ও দোয়েল চত্বর হয়ে বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তা দিয়ে আবারো চারুকলা অনুষদে গিয়ে শেষ হয়। শোভাযাত্রায় সাতটি বড়, সাতটি মাঝারি ও সাতটি ছোট মোটিফসহ মোট ২১টি মোটিফ প্রদর্শিত হয়। এবারের শোভাযাত্রার মূল মোটিফ হলো ‘স্বৈরাচারের প্রতিকৃতি’। তাছাড়া পায়রা, মাছ, বাঘ, ৩৬শে জুলাই, তরমুজ ও মুগ্ধর আলোচিত পানির বোতল প্রদর্শিত হয়েছে। ছিল বাংলার ঐতিহ্যবাহী মুখোশ। ছিল ফিলিস্তিনের পতাকা। এ ছাড়া ছিল পুলিশের অশ্বারোহী দল।
শোভাযাত্রায় প্রতীকীভাবে বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হয়। কৃষককে নেচে-গেয়ে ফসল তোলার দৃশ্য দেখা যায়। এবারের শোভাযাত্রায় ২৮টি জাতিগোষ্ঠী, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন দেশের অতিথিরা অংশ নেন। ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি মোটিফটি পুড়িয়ে দেয়ায় ককশিট দিয়ে দাঁতাল মুখের এক নারীর মুখাবয়ব বানানো হয়। মাথায় খাঁড়া চারটি শিং, হা করা মুখ, বিশালাকৃতির নাক ও ভয়ার্ত দুটি চোখ। এটিকে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি হিসেবে ধারণা করেছিলেন অনেকে। দেশের ২৮টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা নিজ নিজ সংস্কৃতির প্রতীক ও ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে শোভাযাত্রাকে বর্ণিল করে তুলেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও জাতিগত সমপ্রীতির এক অনন্য উদাহরণ। শোভাযাত্রার উপ-কমিটির সদস্য সচিব ও চারুকলা অনুষদের প্রফেসর এ এ এম কাওসার হাসান জানান, ম্রো, মারমা, লুসাই, বম, খেয়াং, চাকমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গা, সাঁওতাল, ওরাওঁ, মণিপুরীসহ পাহাড় ও সমতলের ২৮টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবারের শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছেন।
এদিকে চ্যানেল আই-সুরের ধারা আয়োজিত ১৪৩২ বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হয় রাতের আঁধার কেটে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে। রাজধানীর ধানমণ্ডির রবীন্দ্রসরোবরের উন্মুক্ত চত্বরে যেন প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়েই শুরু হলো নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর সূচনা। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের শিল্পীদের সরোদের সুর আর তবলার তালে বরণ করে নেয়া হয় বঙ্গাব্দ ১৪৩২-কে। যন্ত্রসংগীতের পরই সুরের ধারার খুদে শিল্পীদের কণ্ঠে আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে গেল ‘আলো আমার আলো ওগো’র সুর। ওরা গানে গানে জানিয়ে গেল, আলোর স্রোতে হাজার প্রজাপতির পাল তোলার কথা। তৃতীয় পরিবেশনা ছিল ‘প্রভাত বীণা তব বাজে’ সুরের ধারার সমবেত সংগীত। এর পরপরই এলো ‘ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী’র কণ্ঠে পার্বত্য অঞ্চলের গান। দেশাত্মবোধক গান, রবীন্দ্রসংগীত, লোকগীতিসহ পঞ্চকবির গান পরিবেশনা হয়েছে এ আয়োজনে।
রাতে ছিল রোমাঞ্চকর পরিবেশনা। রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউর আকাশে যখন পূর্ণিমার আলো খেলা করছে। তখন চারদিক আলোকিত করে প্রদর্শিত হয় ড্রোন শোর। বিকাল ৩টা থেকে উন্মুক্ত কনসার্ট ও সন্ধ্যার ড্রোন শোতে মুগ্ধ হয় নগরবাসী। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে বিকাল ৩টায় কনসার্ট শুরু হয় বান্দরবানের ‘বেসিক গিটার লার্নিং স্কুল’-এর পরিবেশনা দিয়ে। এরপর ‘আর এন আর’ সংগীত পরিবেশন করে। সমবেত কণ্ঠে শিল্পীরা শোনান ‘এসো হে বৈশাখ’ গান। কনসার্টে একক সংগীত পরিবেশন করেন মিঠুন চক্রবর্তী। ‘দেওরা’ গানসহ আরও একটি পালা গেয়ে শোনান ইসলামউদ্দিন পালাকার। গারো জাতিগোষ্ঠীর ব্যান্ড ‘এফ মাইনর’ সংগীত পরিবেশন করে। ‘চলো নীরালায়’ গানসহ তিনটি একক সংগীত পরিবেশন করেন আতিয়া আনিশা। এরপর রাকিব, সাগর দেওয়ান, আরজ আলী ওস্তাদ গান পরিবেশন করেন। কনসার্টের পর সন্ধ্যা ৭টায় শুরু হয় ড্রোন শো, যার শুরুর মোটিফ জুলাই অভ্যুত্থানের যোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে সাজানো হয়। ১৪ মিনিটের সেই প্রদর্শনীতে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ আবু সাঈদের অকুতোভয় আত্মাহুতি, নারী জাগরণ, দেশীয় সংস্কৃতি ও ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি তুলে ধরা হয়। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় এ আয়োজনে কারিগরি সহায়তা করেছে ঢাকায় চীন দূতাবাস। ২ হাজার ৬০০ ড্রোন ব্যবহার করে মোট ১২টি মোটিফ ফুটিয়ে তোলা হয় শো-তে। ‘ড্রোন শো’ পরিচালনায় চীনের বিশেষজ্ঞ ৬ জনের দল গত ফেব্রুয়ারি মাসে কাজ শুরু করে। ১৩ চীনা পাইলট বা ড্রোন পরিচালনায় অভিজ্ঞরা এই শো পরিচালনা করেন।