ঢাকা, ১ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার, ১৮ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

অনলাইন

কৃষকের ঈদ

শাইখ সিরাজ
৩০ মার্চ ২০২৫, রবিবারmzamin

‘থালা ঘটি বাটি বাঁধা দিয়ে হের চলিয়াছে ঈদগাহে,
তির-খাওয়া বুক, ঋণে-বাঁধা-শির, লুটাতে খোদার রাহে।
জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’

কাজী নজরুল ইসলামের ‘কৃষকের ঈদ’ কবিতাটি পড়লে কৃষকের যে সামাজিক-অর্থনৈতিক চিত্র পাওয়া যায় তা-ই ছিল আমাদের এক সময়ের কৃষকের অবস্থা। কৃষি মানেই ছিল অনিশ্চিত এক পেশা। ফসল ঘরে ওঠা না অবধি কৃষকের কিছুই থাকতো না। আবার ঘরে ফসল উঠলেও ঠিকঠাক দাম না পেলে সেই ফসলও কৃষককে সমৃদ্ধ করতো না। ফলে ফসল ফলাতে, জীবন ধারণ করতে কৃষকের মাথায় সব সময় বয়ে বেড়াতে হতো ঋণের বোঝা। নিজে ফসল ফলালেও ঘরে খাবার থাকতো না তার। ফসল ঘরে তোলা না অবধি কৃষকের পকেটে কোনো নগদ অর্থ থাকতো না। কিন্তু ঈদ তো আর ফসল তোলার হিসেবে আসতো না। ঈদ আসে চান্দ্রমাসের হিসেবে। এই সময়ে এসে অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে বটে। তবে এখনও বৈরী আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে কৃষককে গুনতে হয় লোকসানের হিসাব। ঋণের বেড়াজাল থেকে সহসা বের হতে না পেরে বিপর্যস্ত হতে হয়। ঈদে ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন কাপড়ের ব্যবস্থা করা, এক মাস রোজার পর ঈদের জন্য বিশেষ বাজার সদাই করা ছিল কৃষকের জন্য কঠিন একটা ব্যাপার।
গত শতাব্দীর আশির দশকে যখন কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান নির্মাণ শুরু করি। তখন খুব কাছ থেকে দেখেছি কৃষকের দুরবস্থা। কৃষি মানেই ছিল ধান আর পাট। বন্যা বা খরায় একবার ফসল নষ্ট হলেই কৃষককে পথে বসতে হতো। গ্রামের মহাজনদের কাছে একরকম জিম্মি হয়ে থাকতে হতো কৃষককে। আপনাদের অনেকের মনে থাকতে পারে, প্রায়ই সংবাদপত্রে খবর হতো, দুই মণ ধান বিক্রি করেও একটি ইলিশ কিনতে পারে না কৃষক। ধান ও পাটের দাম নিয়ন্ত্রণ করতো তৃতীয়পক্ষ। লাভের অংক চলে যেতো তৃতীয়পক্ষের পকেটে, কৃষক থাকতো লোকসানে। কৃষক যখন ধান পাট চাষ থেকে বের হয়ে বৈচিত্রপূর্ণ কৃষিতে যোগ দিলো, তখন মাঝারি কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হতে শুরু করলো। একেক মৌসুমে একেক ফসল। আবার একই ক্ষেত থেকে একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ফসল ফলিয়ে কৃষক তার হাতে সব সময়ই টাকা রাখার কৌশল শিখে নিয়েছে। এখন গ্রামের কৃষক বেশ হিসাব করে কৃষি কাজ করে। কখন কোন ফসল লাগালে, কোন ফসল থেকে কী লাভ আসবে সব তার হিসাবের মাঝে আছে। এই বদলে যাওয়া কৃষি ও কৃষককে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। 

বেশ কয়েকদিন আগে গিয়েছিলাম মানিকগঞ্জের বৈচিত্র্যময় কৃষির এলাকা সিংগাইর উপজেলার খালাসিপাড়ায়। সেখানকারই একটি গ্রাম খাসেরচর। গাড়ি থেকে নেমে গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়লো একটা বাড়ি। গ্রামের একটা গৃহস্থবাড়ি যেমন হয়। আগে গ্রামাঞ্চলে যেমন জীর্ণ ভাঙা বাড়ি চোখে পড়তো, এখন আর তেমনটি চোখে পড়ে না। এখন গ্রামের অনেক বাড়িই পাকা, নয়তো টিনের চালার ঘর। খাসেরচরের যে বাড়িটির কথা বলছি, সেটি আধাপাকা একটি বাড়ি। আমায় দেখে এগিয়ে এলেন গৃহকর্তা। নাম সিরাজুল ইসলাম। বয়স ষাট-পঁয়ষট্টি হবে। এখনো বেশ শক্ত সামর্থ্য। আমাকে নিয়ে গেলেন বাড়ির উঠোনে। ঘরের বারান্দায় বসতে দিলেন। কথা হলো তার সঙ্গে। কৃষিজীবী সিরাজুল ইসলাম অল্পস্বল্প ব্যবসা করেন। গত ২৪ বছর তিনি এই বাড়িতে আছেন। বলছিলেন, সুখী পরিবার তার। জীবনে তৃপ্তিও আছে।  উঠোনের চারদিকে চারটি ঘর। দুটি থাকার ঘর। একটি রান্নাবান্নার। আর একটি ঘর গরু-বাছুরের। সেখানে দুটি গরু রয়েছে। ‘প্রতি বছর দুটি করে গরু মোটাতাজা করে কোরবানির সময় বিক্রি করি। এতে হাতে বেশ কিছু নগদ টাকা আসে।’ বলছিলেন সিরাজুল। ‘কৃষিকাজ করে এখন বেশ আয়-উন্নতি হয়।’ সিরাজুল ইসলাম নিজের চোখে দেখা কৃষি উন্নতির কথা বলছিলেন। মাঠে মাঠে ফসল বৈচিত্র্য বেড়েছে। তবে কৃষকের নিজের জমি কমছে। এই এলাকার প্রতি বাড়িরই কেউ না কেউ বিদেশ থাকে। বিদেশ থেকে পাঠানো টাকায় কৃষিকাজ হয়, গরু কিনে। জানালেন সিরাজুল ইসলাম। তার মানে এ অঞ্চলের কৃষিতে বিনিয়োগের একটা বড় অংশই আসে রেমিট্যান্স থেকে। শুধু এ অঞ্চল নয়, সারা দেশেই কৃষিতে বিনিয়োগের বড় একটা অংশ আসে অকৃষিজ পেশা থেকে। কেউ বিদেশ থেকে টাকা পাঠায়, কেউ বা গার্মেন্টস বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করে বাড়িতে টাকা পাঠায়। সেই টাকায় কৃষি কাজ হয়। কৃষক এখন শুধু কৃষিকাজেই যুক্ত নেই। নিজেই এখন বহুমুখী পেশায় নিজেকে যুক্ত রেখেছে। ফলে তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটেছে। এখন ঈদ মানে কিছুটা হলেও আনন্দের। 

আমার কাছে এখন ঈদ আনন্দ মানেই ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’। প্রতি বছর খুব আগ্রহ নিয়ে ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’ তৈরি করি। টেলিভিশন তখন ধনীদের ড্রয়িং রুম থেকে মধ্যবিত্তের ঘরে প্রবেশ করেছে। সেই সময় আমি টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাণ শুরু করি। কৃষকদের নিয়ে সেই অনুষ্ঠান কৃষকরা দেখতো কোন মধ্যবিত্তের ঘরে কিংবা উঠোনে কিংবা চায়ের দোকানে দল বেঁধে বসে। কিন্তু কৃষক যখন সমৃদ্ধ হতে শুরু করলো, টেলিভিশনের দামও কমে এলো, তখন নিজের ঘরেই একটা টেলিভিশন রাখার ক্ষমতা তৈরি হলো। আমার মনে হলো, সে সময়টাতে কৃষকদের নিজের জন্য ঈদের কোনো অনুষ্ঠান নেই। টেলিভিশনের ঈদ অনুষ্ঠান মানেই শহুরে নাটক, সিনেমা কিংবা গান। আমি চিন্তা করলাম কৃষকদের জন্য এমন একটা অনুষ্ঠান নির্মাণের যাতে কৃষকের সরাসরি অংশগ্রহণ থাকবে। সেই চিন্তা থেকে নির্মাণ শুরু করি কৃষকের ঈদ আনন্দ। কৃষকদের নিয়ে খেলাধুলা। পাশাপাশি কৃষকদের নানান বিষয়ে সচেতন করে তোলা। এই অনুষ্ঠান তুমুল জনপ্রিয়তা পেলো। শুধু কৃষকই নয়, এই অনুষ্ঠানের দর্শক আবালবৃদ্ধবনিতা শহরের চাকরিজীবী থেকে শুরু করে প্রবাসী বাংলাদেশিরাও। যখন শুনি কৃষকের ঈদের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’, তখন খুব আনন্দ হয়। 
কৃষকের সন্তান কৃষির বাইরে নানান পেশায় নিয়োজিত আছেন অনেকে। তারা ছড়িয়ে পড়েছেন সারা দেশে। সারা পৃথিবীতে। ঈদে কৃষকের সন্তান, নাতি-নাতনি বাড়ি ফেরে। আমরা সকলেই কোনো না কোনো কৃষক পরিবারেরই সদস্য। আমাদের কাছে এখনো ঈদ মানেই বাড়ি ফেরা, গ্রামে সকলের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন। প্রতি ঈদে কৃষকের বাড়িটি পূর্ণ হয় আত্মীয়স্বজনে। ঈদে বিপুল সংখ্যক মানুষের বাড়ি ফেরার পথটি আমরা এখনো নিরাপদ করতে পারি নি। বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে ধারণ ক্ষমতার বাইরে যাত্রী বহনের কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। এ ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের সচেতন হওয়াটা সবচেয়ে জরুরি। ঈদে বাড়ি ফিরতে গিয়ে লাশ হয়ে ফেরার চেয়ে দেরিতে করে জীবন নিয়ে ফেরাটা নিশ্চয়ই ভালো। এক্ষেত্রে সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সমন্বয় করে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ঈদ পরিপূর্ণ হোক আনন্দে। সকলের ঈদযাত্রা হোক নিরাপদের। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। Í
 

অনলাইন থেকে আরও পড়ুন

অনলাইন সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status