প্রথম পাতা
কেন এই মরণোত্তর পদক?
স্টাফ রিপোর্টার
১২ মার্চ ২০২৫, বুধবার
অনেকেই বলেন পুরস্কার মানুষের দায়িত্ব বাড়ায়-তা যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন। পুরস্কৃত ব্যক্তি উৎসাহিত হয়, অনুপ্রাণিত হয়, নূতন উদ্যমে কাজ করেন। কিন্তু এই পুরস্কারই যখন মৃত্যুর পরে দেয়া হয় অর্থাৎ মরণোত্তর হয়, তখন যাকে পুরস্কার দেয়া হয় তিনি কিছুই জানতে পারেন না। কারণ তিনি বেঁচে নেই। দায়িত্ব বাড়া বা উৎসাহিত হওয়া তো দূরের কথা পুরস্কার পেলে বা কাজের স্বীকৃতি পেলে তার যে আনন্দটুকু পাবার কথা সেটা থেকেও তাকে বঞ্চিত করা হয় এবং তিনি জীবিতাবস্থায় তার কাজের স্বীকৃতি দেখে যেতে পারেন না। সারা জীবন কাজ করে তার যে অর্জন, যে স্বীকৃতি সেটাই যদি তার জীবিতাবস্থায় দেখে যেতে না পারেন তাহলে এই পুরস্কার বা মূল্যায়নে লাভ কী? সেটা তো তার কাছে মূল্যহীন।
পুরস্কার প্রদানে আমাদের দেশে ইদানীং এই অদ্ভুত পদ্ধতি চালু হয়েছে। সঠিক ব্যক্তিকে মূল্যায়ন বা নির্বাচন করতে না পারা এবং মরণোত্তর পুরস্কার দেয়া। স্বাধীনতার পর ৫৩ বছর গেছে, বহু সরকার এসেছে-গেছে, অনেক জ্ঞানী-গুণীজনকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার অধিকাংশ সময়ই বিবেচিত হয়েছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও চাটুকারিতায়। যে কারণে এসব পুরস্কার সবসময়ই হয়েছে বিতর্কিত। এইসব পুরস্কার বা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ ব্যক্তির প্রভাবে পুরস্কারগুলো সঠিক যোগ্য ব্যক্তির কাছে যায় না। ফলে প্রতিবারই পুরস্কৃতরাও সমালোচিত হন। কারণ অনেক বিতর্কিত ব্যক্তি, এমনকি একবার মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিকেও এই পুরস্কার দেয়া হয়েছে। পরে আবার সংশোধন ও পরিবর্তন করে নাম ঘোষণা করা হয়েছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে এসব আচরণ অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। অনেকেই সঠিক সময়ে মূল্যায়ন না হওয়ায় এসব পুরস্কার নিতে অস্বীকৃতি জানান। ইদানীং পুরস্কার বা পদ-পদবি পেতে ফেসবুক পোস্টের ভূমিকাও লক্ষণীয়। এর নজির বা প্রমাণ আমরা দেখেছি। কেউ পদক পেয়েছেন, কেউ উপদেষ্টাও হয়েছেন। এসব দেখে যারা পুরস্কার খুঁজে পুরস্কৃত বা পদ খুঁজে বিশেষ পদ পান, তাতে তাদের লজ্জা না লাগলেও অনেকেই এ নিয়ে হাসাহাসি করেন। কারণ বিষয়টি লজ্জাজনক।
১৯৭৪ সালে নোবেল ফাউন্ডেশন সিদ্ধান্ত নেন মৃত্যুর পরে অর্থাৎ কাউকে মরণোত্তর পুরস্কার দেয়া হবে না। কারণ মৃত ব্যক্তিকে নোবেল দেয়ায় বিশ্বব্যাপী সমালোচনা হয়, বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তাই এই সিদ্ধান্ত নেয় নোবেল কমিটি। তবে পুরস্কার ঘোষণার পর যদি তার মৃত্যু হয় তবে ২/১টি ক্ষেত্রে তাকে মরণোত্তর নোবেল দেয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৭৪ সালের আগে মাত্র দু’জনকে মরণোত্তর নোবেল দেয়া হয়। তার মধ্যে ১৯৩১ সালে সাহিত্যে মরণোত্তর নোবেল পান এরিক আক্সেল কার্লফেল্ট। এর ৩০ বছর পর ১৯৬১ সালে শান্তিতে মরণোত্তর নোবেল পান ড্যাগ হ্যামারশোল্ড। আর ২০১১ সালে ফিজিওলজি বা মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পরে নোবেল ফাউন্ডেশন জানতে পারেন পুরস্কারপ্রাপ্ত রালফ স্টেইনম্যান পুরস্কার ঘোষণার মাত্র তিনদিন আগেই মারা গেছেন। যেহেতু ফাউন্ডেশন তার মৃত্যু সম্পর্কে জানতেন না, তাই নোবেল বিজয়ীদের তালিকায় তার নাম রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
তবে এবার বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অনেক চমকের মধ্যে এই পুরস্কার প্রদানও একটি। স্বল্প মেয়াদের এই সরকারের আমলে বাংলা একাডেমির পুরস্কার নিয়ে সমালোচনার রেশ কাটতে না কাটতেই একুশে পদক দেয়া হলো। এই পুরস্কার দিয়ে দেশের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সমালোচিত উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ফেসবুক পোস্ট দিয়ে জানালেন একুশে পদকে তিনি চমক দেখিয়েছেন, এরপর আবার চমকের কথা লিখলেন এই স্বাধীনতা পুরস্কার নিয়েও। শুধু এই বিতর্কিত উপদেষ্টাই নয়, শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেছেন এবার স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন যারা জীবনব্যাপী অবদান রেখেছেন, নূতন কিছু তৈরি করেছেন, যার ধারাবাহিকতায় এখনো চলছে।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘আপনারা একুশে পদক দেখে খুশি হয়েছেন, এই পুরস্কার দেখে আরও খুশি হবেন।’ তিনি আরও বলেছেন, আগে নাকি তাদের সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। আসিফ নজরুল সাহেব এই পুরস্কার দেখে আপনারা খুশি হলেও অন্য কেউই খুশি হয়নি। কারণ এদের মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তিই এই পুরস্কারের ঊর্ধ্বে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানী, বিজ্ঞানী অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম, ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ, কবি আল মাহমুদ-এরা সবাই এমন সময় এই পদক পেলেন যখন এই কীর্তিমান ব্যক্তিরা এইসব পদকের ঊর্ধ্বে। জেনারেল এমএজি ওসমানী-মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ছিলেন। ১৯৮৫ সালে তাকে এই পদক দেয়া হয়, আর তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ১৯৮৪ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ আগেও তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়। এবার প্রথমে পদকপ্রাপ্তদের তালিকায় জেনারেল ওসমানীর নাম থাকলেও গতকাল চূড়ান্ত ঘোষণায় তার নাম ছিল না।
এই সরকারের বিজ্ঞ উপদেষ্টাদের এটাও একটা চমক, এক ব্যক্তিকে দু’বার স্বাধীনতা পদক দেয়া হলো। আর স্যার ফজলে হাসান আবেদ বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা। ২০১০ সালে বৃটিশ সরকার তাকে সবচেয়ে সম্মানিত অর্ডার নাইট কমান্ডার উপাধিতে ভূষিত করেন, ২০১৯ সালে নেদারল্যান্ডসের রাজা তাকে নাইটহুড ‘অফিসার ইন দ্য অর্ডার অব অরেঞ্জ-নাসাউ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এ ছাড়াও তিনি র্যামন ম্যাগসাইসাই থেকে শুরু করে ইউনেস্কো, ইউনিসেফসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছেন। ‘অরিজিনাল ম্যান’ হিসেবে খ্যাত জামাল নজরুল ইসলাম একাধারে একজন গণিতবিদ, বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ববিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী। কেমব্রিজ থেকে প্রকাশিত তার দি আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স অনূদিত হয়েছে একাধিক ভাষায়। এরা সবাই আপন আলোয় উদ্ভাসিত। দেশে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকা হাসিনা সরকার থেকে শুরু করে কোনো সরকারই তাদের সেভাবে মূল্যায়ন করেনি। যা করার দরকার ছিল তাদের জীবদ্দশায়। স্বীকৃতি বা রাষ্ট্রীয় সম্মান পেলে তারা নিশ্চয়ই খুশি হতেন। কিন্তু এই পুরস্কারটি মরণোত্তর পুরস্কার হিসেবে এমন সময়ে দেয়া হলো যখন তারা এসব পুরস্কারের ঊর্ধ্বে। আবরারকে স্বাধীনতা পদক দেয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আবরার ছাড়াও ছাত্রলীগের গুণ্ডাবাহিনী যেই বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করলো, সেই বিশ্বজিৎ এবং জুলাই আন্দোলনের অগ্রনায়ক আবু সাঈদকেও এই পদক দেয়া উচিত ছিল। যেহেতু মরণোত্তর পুরস্কার নিয়ে সরকারের উপদেষ্টারা খুবই গর্বিত, সেক্ষেত্রে এদেরও মরণোত্তর পুরস্কার দেয়া যেত। ‘অভ্র’ টিমের একজনকে প্রথমে একুশে পদক দেয়া হলে তারা পদক নিতে অস্বীকৃতি জানালো। পরে আপন পদে গর্বিত উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পুরস্কারের সম্মান রক্ষার্থে বাধ্য হয়েছেন পুরো টিমকে একুশে পদক দিতে। তেমনি বিশ্বজিৎ, আবরার, আবু সাঈদ এই তিনজনকেই মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দেয়া যেত।
আসলে বর্তমান সরকার এবং সরকারের ২/৩ জন উপদেষ্টাকে নিয়ে চরম বিতর্কের কারণে তারা এইসব রাষ্ট্রীয় পুরস্কার নিয়ে বিতর্কিত হতে চান না। তাই লোক দেখানো বিতর্কমুক্ত পদক দেয়ার জন্যই বোধহয় এই মরণোত্তর ব্যবস্থা। এইসব মরণোত্তর পুরস্কারের ভিড়ে আটজনের মধ্যে শুধু বদরুদ্দীন উমরই জীবিত অবস্থায় এই পদক পান। তিনিও এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাহলে প্রধান উপদেষ্টা রাষ্ট্রের এই সর্বোচ্চ পদক কাদের হাতে তুলে দেবেন? পুরস্কারপ্রাপ্তদের আত্মীয়-স্বজন কিংবা নাতি-পুতিদের? এখনো সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন অঙ্গনে কাজ করছেন এমন ব্যক্তিত্বদের কি এতই অভাব? বর্তমান পুরস্কার কমিটি কি নোবেল কমিটির চাইতেও অভিজ্ঞ? এই সরকারের সুযোগ ছিল শুধু ঢাকা শহর নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে খুঁজে খুঁজে প্রতিভাবানদের পুরস্কৃত করা, মূল্যায়ন করা। তাহলে তারা যেমন স্বীকৃতি পেতো, তেমনি আরও নতুন উদ্যমে পদকপ্রাপ্তির দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে পারতেন। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানটিও মরণোত্তর অনুষ্ঠান হতো না, হতো সবার কাছে গ্রহণযোগ্য।
পাঠকের মতামত
Good People Never Demand Recognition! This is an usual expectation that human being will do good practice and they will remain engaged in good activities, and that is why “the best creation of God is human being — Ashraful Makhlukath — the representative of Allah”! That means it is automatic that as a human being our “fundamental right is to do good things, not the bad”! And, if anyone is doing any exceptional job, that is not because of his/her capabilities; because his/her creator has been kind on him/her so he/she has been able to do that exceptional job — the credit is not his/hers! If any one demands any reward/award/ recognition for his/her extraordinary performance that means he/she claims by denying the fact that he/she is the “gift of Allah”! As a result, the priority of the selections of reward/award/recognition should be given to those only who consider themselves that they did it because they demand something in return! Under this circumstances, if Late Mr Osmani is not recognized for his sacrifices for the country he did that means he did the right thing! And, we have suffered for 15 years because someone claimed that they did the extraordinary job, and in return they have obtained the rights to ruin the people’s normal life [destruction is the recognition for their accomplishments] — still they are honking!?
Death of Biswajit is not comparable to the death of Abrar or Aby Sayeed. The latter two defied the idiotic islamophobic anti liberation Awami govt.
স্বাধীনতা পদক কমিটিতে কে কে আছেন জানতে খুব ইচ্ছে করে।
এবার স্বাধীনতা পদক। দেখা যাক কারা পায়।
স্বাধীনতা পদকের নাম বদল করে রাখা হোক "জাতীয় মরণোত্তর পদক" ।