ঢাকা, ১৭ মে ২০২৫, শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৮ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এবার বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ৮৩৯ কোটি টাকা

পিয়াস সরকার
৫ মার্চ ২০২৫, বুধবার
mzamin

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ থেকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ ছিল পতিত আওয়ামী লীগের স্লোগান। এসব কথিত উন্নয়নের স্লোগান বাস্তবায়নের নামে লুটপাটকে টার্গেট করে প্রকল্প নেয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি। এখানে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, পরিকল্পনা, ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই চালু করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়টি। এটি বাস্তবায়নে বাজেট চাওয়া হয় ১০ হাজার ১০০ কোটি টাকা। গড়তে চাওয়া হয় বিলাসী বিশ্ববিদ্যালয়। তৎকালীন সময়ে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এই লুটপাটের প্রকল্পে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম থাকার কারণে প্রশাসনিকভাবে কেউ বিরোধিতা করেননি। আবার ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে দলীয় স্লোগান বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীরা। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয়নি। ২০১৮ সালে প্রথম শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কাঠামোই দাঁড় হয়নি। তবে শেখ হাসিনার পতনের পর প্রতিষ্ঠানটির নতুন নাম দেয়া হয়েছে গাজীপুর ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়। এখন সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারের কাছে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে  ৮৩৯ কোটি টাকা।

বিশ্ববিদ্যালয়টি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে সামনে রেখে আধুনিক কিছু বিষয় যুক্ত করা হয়। যেমন, আইওটি অ্যান্ড রোবটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং, এডুকেশন টেকনোলজি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, সাইবার সিকিউরিটি ইঞ্জিনিয়ারিং, ডেটা সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি। এ ছাড়া ক্লাউজ কম্পিউটিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ন্যানো সায়েন্স, বায়োমেডিকেল ইত্যাদি। 

জুলাই অভ্যুত্থানের পর বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম পরিবর্তন করা হলেও শিক্ষার্থীদের ‘বাংলাদেশ ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি’ নাম প্রদানের দাবি ছিল। এই দাবিতে আন্দোলনও করেছেন শিক্ষার্থীরা।

দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে ১৩টি। এ ছাড়া প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৫টি। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক স্লোগান ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে অনুমোদন দেয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনই নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দেরও প্রস্তাব করা হয়। 
খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পটি ছিল একটি বিলাসী প্রকল্প। শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতৃত্বকে খুশি করার জন্য প্রকল্প নেয়া হয়েছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনে ২০১৬ সালে সংসদে আইন হয়। গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক সংলগ্ন এলাকায় ৫০ একর জায়গা জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের লক্ষ্যে আইনটি প্রণয়ন হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৮ সালের জুনে। যার লক্ষ্যের কথা বলা হয়, রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়ন। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় অংশগ্রহণ। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশে পৌঁছানোতে ভূমিকা রাখা, বাংলাদেশে অনলাইন শিক্ষার প্রসার ঘটানো এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একটি অন্যতম উন্নতমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের প্রথম প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকায় এই বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ হবে হাইটেক পার্কের পাশে। হাইটেক পার্ককেন্দ্রিক সকল প্রকল্প মূলত নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক।

তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সুপারিশে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদে আসে। নাম প্রস্তাব করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণের সময় ছিল না কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ছিল না মাস্টার প্ল্যান। ঢাকায় ভাড়া করা ভবনে শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রম। ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নূর। তার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য বিলাসী বাজেট প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ব্যয়ে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ হয়েছিল নেত্রকোনার শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়। ব্যয় ছিল ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জমির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ২০০ একর। কিন্তু গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় মাত্র ৫০ একর জমির ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি স্থাপনের জন্য বাজেট দেয়া হয় ১০ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এই বিপুল অর্থের ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোপোজাল (ডিপিপি) জমা দেয়া হয়। জমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামো খাতে ব্যয় ধরা হয় ৪ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। বাকি টাকার বেশির ভাগই খরচ হওয়ার কথা কেনাকাটায়। এই বিপুল ব্যয়বহুল বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সর্বোচ্চ পড়তে পারবেন ৪ হাজার শিক্ষার্থী। 

তৎকালীন ইউজিসি সদস্য ড. মোহাম্মদ আলমগীর ২০২২ সালে মানবজমিনকে বলেছিলেন, আমরা ডিপিপি সংশোধন করতে বলেছিলাম। কিন্তু তারা তেমনভাবে কোনো পরিবর্তন করেননি। পরে আমরা আমাদের পর্যবেক্ষণসহ সেই ডিপিপি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়। প্রকল্প কার্যক্রমের জন্য মোট ক্রয় পরিকল্পনা-পণ্যের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে ৫ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। এই বিপুল বাজেটের বিশ্ববিদ্যালয় মানবজমিনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়। সে সময় এনিয়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম হয়। এটি বাতিল করে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর অধ্যাপক মুনাজ আহমেদের স্থলে ভিসির দায়িত্ব পান অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম। জুলাই অভ্যুত্থানের পর বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিসির দায়িত্ব পান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির উন্নয়নের জন্য ৮৩৯ কোটি টাকার ডিপিপি জমা  দেয়া হয়েছে। এটি অনুমোদনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির ১০ হাজার ৪০০ কোটি টাকার উন্নয়ন ব্যয় নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগ আপত্তি জানালে তা বাতিল হয়ে যায়। পরবর্তীতে নতুন করে ১০ হাজার ১০০ কোটি টাকার ডিপিপি জমা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বাতিল হওয়া ডিপিপিতে কর্তৃপক্ষ সুইমিং পুল, বক্তৃতা মঞ্চ, স্কলার প্লাজা, স্পোর্টস কমপ্লেক্স নির্মাণের কথা বলেছিল। ইউজিসি সূত্র জানায়, গত জানুয়ারি মাসে নতুন করে ৮৩৯ কোটি টাকার ডিপিপি ইউজিসিতে জমা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় জুন-২০২৯ পর্যন্ত।

ইউজিসিতে জমা দেয়া ডিপিপি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪২ কোটি ২৯ লাখ টাকা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ১৮৫ কোটি ৬ লাখ, ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ১৭৩ কোটি ২১ লাখ, ২০২৭-২৮ অর্থবছরে ২১০ কোটি ৫৯ লাখ এবং ২০২৮-২৯ অর্থবছরের জন্য ১৭৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। ডিপিপিতে মূলধন ক্যাটাগরির মোট ব্যয় দেখানো হয়েছে ৭৫৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে একাডেমিক ভবন নির্মাণের ব্যয় দেখানো হয়েছে ২৭৭ কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৩৪.৪৬ শতাংশ। প্রশাসনিক ভবন নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮৫ কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের ২৩.০১ শতাংশ। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ রাস্তা নির্মাণের জন্য ৭ কোটি ৪৫ লাখ, ড্রেনেজ কাঠামোর জন্য ২২ কোটি ৬৫ লাখ, এক্সটার্নাল ইলেক্ট্রিফিকেশনের জন্য ১৭ কোটি ৮৮ লাখ, ভূমি উন্নয়নে ৪৪ কোটি, তথ্য ও যোগাযোগ সরঞ্জামাদির জন্য ৫০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। ক্যামেরা ক্রয়ে ব্যয় দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৬৭ লাখ, গবেষণাগারের সরঞ্জামাদিতে ৫৫ কোটি, আসবাবপত্রে ২৩ কোটি এবং ভূমি অধিগ্রহণে ৩৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। মূলধন এবং রাজস্ব ব্যয়ের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৮০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
ইউজিসি’র পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ মাকছুদুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, আমরা ইউজিসি’র পক্ষ থেকে ডিপিপি পাস করেছি। সামঞ্জস্যপূর্ণ করার চেষ্টা করেছি। এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে পাস হয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে যাবে। সেখান থেকে যাবে একনেকে।

পাঠকের মতামত

হাসিনাকে কেয়ামত পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। আর এই প্রকপ্লের সাথে যারা জড়িত, অবিলম্বে তাদের আইনের আওতায় এনে এমন বিচার করতে হবে যা পৃথিবীর মানুষ আগে দেখেনি।

সোহাগ
৫ মার্চ ২০২৫, বুধবার, ১০:৫৭ পূর্বাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status