ঢাকা, ১২ মার্চ ২০২৫, বুধবার, ২৭ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ রমজান ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

তিস্তা পাড়ে উত্তরাঞ্চলবাসীর জনস্রোত

‘পানির হিস্যা কারও করুণার বিষয় নয়’

স্টাফ রিপোর্টার, ঢাকা ও রংপুর
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, বুধবারmzamin

‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবিতে পদযাত্রা করেছে তিস্তা রক্ষা আন্দোলন কমিটি। তিস্তা অভিমুখে এই পদযাত্রায় বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীসহ উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার মানুষের ঢল নামে। কর্মসূচি থেকে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বক্তারা। ৪৮ ঘণ্টার কর্মসূচির সমাপনী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, উত্তরাঞ্চলের পানির ন্যায্য হিস্যা বঞ্চিত এই মানুষরা আজকে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিতে চায়, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫৪টি যে অভিন্ন নদী- এই নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তি কারও কোনো করুণার বিষয় নয়। এটা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রাপ্য। অথচ তিস্তা নদীর ন্যায্য পাওনা আদায়ের জন্য আজকে আমাদের আন্দোলন করতে হচ্ছে। 

মঙ্গলবার তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটির উদ্যোগে তিস্তা রেলসেতু লালমনিরহাট পয়েন্টে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে গত সোমবার থেকে ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। মঙ্গলবার বেলা ১১টায় উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় ১১টি পয়েন্টে দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচি একসঙ্গে শুরু হয়। পদযাত্রাটি লালমনিরহাট প্রান্তের তিস্তা ব্রিজ থেকে শুরু হয়ে রংপুরের কাউনিয়া বাজারে গিয়ে শেষ হয়। তিস্তা বিস্তৃত রংপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামের ১১টি পয়েন্টে স্মরণকালের এই বৃহৎ কর্মসূচিতে যোগ দেন এ অঞ্চলের সর্বস্তরের লাখো মানুষ। প্রথম দিনের মতো সমাপনী দিনেও সকাল থেকেই ১১টি পয়েন্টে সমাবেশ, পদযাত্রা, সাংস্কৃতিক পরিবেশনার আয়োজন করে ‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটি’। সেইসঙ্গে প্রতিবাদ হিসেবে দেশীয় সংগীত, নৃত্য, খেলাধুলা অনুষ্ঠিত হয়।

বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, এই পানি বণ্টন নিয়ে আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে অপ্রতিবেশীমূলক আচরণ করেই চলেছে। আজকে প্রায় ৫০ বছর হলো ফারাক্কার অভিশাপ থেকে বাংলাদেশ মুক্তি পায় নাই। এখন তিস্তা বাংলাদেশের জন্য আরেকটা অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে। সব আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে আমাদের প্রতিবেশী উজানের গজলডোবায় একটা বাঁধ নির্মাণ করেছে। এটা করে তিস্তার স্বাভাবিক এই পানি প্রবাহকে তারা নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। তাদের এই অপ্রতিবেশীমূলক আচরণের কারণে আজকে উত্তরাঞ্চলের এই কোটি জনগণ বন্যায়, খরায় দুর্বিষহ জীবন পার করছে। পানির অভাবে তিস্তার বুকে আজকে ধু-ধু বালুচর। একদিকে পানির অভাবে নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার ফসল। আবার  হঠাৎ করেই উজান থেকে ছেড়ে দিচ্ছে পানি! সেই পানির কারণে বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে সাধারণ মানুষের ঘর-বাড়ি। শস্যের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় লাখ কোটি টাকার। 
বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে চুক্তির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তারেক রহমান বলেন, বাংলাদেশের মানুষ মনে করে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে প্রয়োজনে সকল অন্যায্য এবং একতরফা যে সকল চুক্তি, এগুলোর পুনর্মূল্যায়ন কিংবা পুনর্বিবেচনা করা দরকার। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’- আমাদের পররাষ্ট্রনীতির এটাই মূলনীতি। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে এই নীতিটি পুনর্বিবেচনা করা দরকার। 
তিনি বলেন, প্রতিবেশী ভারত যদি পানির ন্যায্য হিস্যা না দেয় কিংবা দিতে যদি দেরি করে এবং তিস্তা চুক্তি করতে অনীহা দেখায় তাহলে দেশ ও জনগণের স্বার্থে আমাদেরই আমাদের পথ খুঁজে নিতে হবে। পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের জন্য জাতিসংঘসহ সংশ্লিষ্ট সকল আন্তর্জাতিক ফোরামে জোরালোভাবে বাংলাদেশের দাবি তুলে ধরতে হবে। একইসঙ্গে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গেও আমাদের কূটনৈতিক আলোচনা শুরু করতে হবে। আন্তর্জাতিক উদ্যোগের পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলকে মরূকরণ থেকে বাঁচাতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি জনগণের সমর্থনে রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্ব পেলে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। 

বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, গণতান্ত্রিক দলগুলোর পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচনের কথা শুনলেই অন্তর্বর্তী সরকারের কেউ কেউ বিচলিত হয়ে ওঠেন। আমাদের অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন, জাতীয় নির্বাচন নিয়ে একেক উপদেষ্টার একেক রকমের বক্তব্য এই খুনি ও মাফিয়া চক্রের সামনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পথ সুগম করে দেয়। এজন্য বিএনপি বারবার এই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি তাদের কর্মপরিকল্পার রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছে।  

ওদিকে দ্বিতীয়দিনের কর্মসূচিতেও সকাল থেকেই তিস্তা নদীর তীরে নামে মানুষের ঢল। তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়নসহ পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবিতে স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে তিস্তার দুই পাড়ের এই সমাবেশস্থল। তিস্তাপাড়ে হাজারো মানুষ ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগান সম্বলিত পতাকাসহ ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড হাতে জড়ো হন। এই পদযাত্রায় বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীসহ তিস্তাপাড়ের সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন। পদযাত্রায় নেতৃত্ব দেন তিস্তা রক্ষা আন্দোলন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক বিএনপি’র রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু। 

সমাপনী সমাবেশে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, পানি সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। যাতে তিস্তা নিয়ে ভারত আমাদের ব্ল্যাকমেইল করতে না পারে। আর আগামীদিনে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে কোনো রকম নাক গলাবেন না। আমার দেশ, আমরা সমস্যা। আমরাই সমাধান করবো। সেক্ষেত্রে বিদেশিদের যদি পরামর্শ প্রয়োজন হয়, সেটা আমরা নেবো।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আজকে তিস্তাকে দেখে আমার হৃদয়ে রক্তরক্ষণ হচ্ছে। পানির অভাবে এই অঞ্চলে ১৫ লাখ টন চাল কম উৎপাদন হচ্ছে। আর আজকে তিস্তার পানি কেন নাই, কারণ উজান থেকে যে পানি আসছে সেটাকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ন্যায্য পানি পাওয়া থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আর অপেক্ষা করা সম্ভব না। যেকোনো উপায়ে তিস্তার পানি প্রবাহিত করতে হবে।

বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এই পানি আমাদের ন্যায্য অধিকার। এটা আমাদের মানবাধিকার। কিন্তু তিস্তা নদী একতরফাভাবে প্রবাহিত করে ভারত মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। 
বিএনপি’র রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যক্ষ আসাদুল হাবীব দুলুর সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন রংপুর বিভাগীয় বিএনপি’র সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল খালেক প্রমুখ।

তিস্তার তীরে লক্ষাধিক মানুষের ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান
‘কোনঠে সগায়, জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই।’ স্লোগানে, স্লোগানে মুখোরিত তিস্তা নদী অঞ্চল। গতকাল মঙ্গলবার তিস্তা নদীতে নেমে প্ল্যাকার্ড হাতে অবস্থান  আন্দোলনকে ঘিরে তিস্তার তীরে লক্ষাধিক মানুষের ঢল। দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে উত্তাল রংপুর অঞ্চলের লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, রংপুরসহ পাঁচ জেলা। কৃষক, জেলে, শ্রমিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সর্বস্তরের পদচারণায় মুখোরিত ছিল তিস্তারপাড়। এ যেন এক মিলনমেলা। অন্যরকম দৃশ্য। দুই দিনব্যাপী তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের শেষ দিনেও তিস্তা বেষ্টিত এলাকায় ১১ পয়েন্টে সাজ-সাজ রব। পাঁচ জেলার সর্বস্তরের জনগণ তিস্তা অভিমুখে পদযাত্রা এবং নদীর দুই তীরে ২৩০ কিলোমিটার জুড়ে অবস্থান কর্মসূচি, বিভিন্ন রঙ-বেরঙে সাজানো চোখ ধাঁধানো দৃশ্য। দিন-রাত উৎসবমুখর পরিবেশকে ঘিরে ভাওয়াইয়া গান, পালাগান, পল্লী গীতি, জারিগান, ব্যান্ডপার্টি, বাঁশির সুর, তিস্তাপাড়ের মানুষদের নিয়ে নাটক, হস্তশিল্প, কুটির শিল্পসহ বিভিন্ন স্টল ও দোকানপাট গড়ে উঠেছে। চলছে সমান তালে বেচাকেনা। রাত্রী যাপনের জন্য টাঙানো হয়েছে শত শত তাঁবু। নারীদের জন্য রয়েছিল আলাদা ব্যবস্থা। আন্দোলনে আসা একজোট জনতার এক রঙের টি-শার্ট, মাথায় ক্যাপ ছিল চোখে পড়ার মতো। ৪৮ ঘণ্টার আন্দোলনের আগের দিন থেকে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন গুড়, চিঁড়া, মুড়ি, খই পুঁটলিতে বেঁধে নিয়ে আসেন খাওয়ার জন্য। আয়োজক কমিটির উদ্যোগে ২৫ হাজার মানুষের জন্য খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল। তিস্তা রক্ষা ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে যেন সবাই এক। চোখে-মুখে নতুন স্বপ্ন। তিস্তা ফিরবে আগের রূপে।

পাঠকের মতামত

Very impressive and public interest oriented program indeed. The BNP high command needs to organize such types of public gathering and mass people interest related issues activities in much more.

Parnel Shawkat
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, বুধবার, ৬:৩৯ অপরাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status