শরীর ও মন
মলদ্বার ফেটে গেলে বা এনাল ফিশার
ডা. মোহাম্মদ তানভীর জালাল
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, বুধবারএনাল ফিশার অর্থ মলদ্বার ফেটে যাওয়া বা মলদ্বারে ঘা। সাধারণত মলদ্বারে সচরাচর ঘটে থাকে এরকম রোগের মধ্যে এনাল ফিশার অন্যতম।
বিশ্বে প্রতি ১ হাজার জনে এক-দু’জন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে এই রোগে ভোগেন। শিশু থেকে বৃদ্ধ যেকোনো বয়সের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কেউ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে বা হয়ে থাকে। তবে অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যে এ রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়।
কোষ্ঠকাঠিন্যকেই এই রোগের প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়। তবে অতিরিক্ত ডায়েরিয়া হলেও এনাল ফিশার হতে পারে। মলত্যাগের সময় অতিরিক্ত চাপ দিয়ে মলত্যাগের বদভ্যাস এই রোগের সম্ভাবনা বাড়ায়। সাধারণত মলদ্বারের পেছন দিকে ফাটা অথবা ঘা হয়ে থাকে।
তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে কখনো কখনো বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় মলদ্বার সামনের দিকে ফেটে যেতে পারে। মলদ্বারের টিবি, যৌনবাহিত রোগ, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগের কারণেও অনেক সময় মলদ্বারের পাশে ঘা দেখা দেয়।
প্রকার ও প্রকারভেদে উপসর্গ:
সাধারণত এনাল ফিশার দুই ধরনের হয়ে থাকে।
১. হঠাৎ সংকটজনক হয়ে ওঠা ফিশার
২. দীর্ঘস্থায়ী ফিশার
এই রোগের প্রধান উপসর্গ ব্যথা। এ ছাড়া রক্তক্ষরণ, চুলকানি, মলদ্বারে শ্লেষ্মা বা পিচ্ছিল পদার্থ যাওয়া, মলদ্বারের পাশে বাড়তি মাংস এবং কোষ্ঠকাঠিন্য নিয়ে রোগীরা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
হঠাৎ সংকটজনক হয়ে ওঠা ফিশার: তীব্র ব্যথা এই রোগের প্রধান লক্ষণ। মলত্যাগের পরপর এই ব্যথা শুরু হয় এবং দীর্ঘক্ষণ ব্যথা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যথার সঙ্গে জ্বালা পোড়া হতে থাকে। ব্যথা অনেক ক্ষেত্রে এতটাই তীব্র হয় যে, অনেক রোগী বাথরুমে যেতে ভয় পান। এই রোগে রক্তক্ষরণের পরিমাণ সাধারণত কম। বেশিরভাগ রোগী অভিযোগ করেন মলত্যাগের পর টিস্যু ব্যবহার করলে রক্ত দেখা যায়। অল্প কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়। মলদ্বারে শ্লেষ্মা বা পিচ্ছিল পদার্থ যেতে পারে।
দীর্ঘস্থায়ী ফিশার: ছয় সপ্তাহের বেশি ফিশারকে দীর্ঘস্থায়ী ফিশার বলা হয়। দীর্ঘস্থায়ী ফিশারে ব্যথা অল্প কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যথা নাও হতে পারে। অধিকাংশ রোগী মলদ্বারের পাশে বাড়তি মাংস (Sentinel Piles) আছে বলে অভিযোগ করেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মলদ্বারের ভেতরেও বাড়তি মাংস (Hypertrophied Anal Papilla) থাকতে পারে। অনেক সময় রোগীরা দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পর মলদ্বারে ব্যথা অথবা জ্বালা, মলদ্বার সামান্য ভেজা ভেজা অথবা মলদ্বারে চুলকানি অনুভব করেন।
দুই ধরনের ক্ষেত্রেই ফিশার সংক্রমিত হয়ে ফোঁড়া (Abscess), পুঁজ পড়া কিংবা ফিস্টুলা হতে পারে। পুরুষদের ক্ষেত্রে অনেকে প্রসাবের সমস্যায় এবং নারীরা অনেকে যৌন মিলনের সময় ব্যথা অনুভব করেন।
রোগ নির্ণয়: রোগীর উপর্সগ শুনে এবং মলদ্বার পরীক্ষা করে চিকিৎসকরা রোগ নির্ণয় করে থাকেন। মলদ্বার না দেখে শুধুমাত্র শুনে চিকিৎসা করা অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো। কেননা মলদ্বার দেখেই চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেন যে রোগীর মলদ্বারের টিবি, যৌনবাহিত রোগ, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগের কারণে হওয়া ফিশার নির্ণয়ে রোগীর অন্য কোনো পরীক্ষা (সিগময়ডোস্কোপি/ কোলনস্কোপি) প্রয়োজন কিনা।
প্রতিরোধ: অনেক রোগ হওয়ার আগে তা প্রতিরোধ করা যায়। তাই বলা হয়ে থাকে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। প্রতিরোধের জন্যে যেসব নিয়ম মেনে চলতে হয়:
কোষ্ঠকাঠিন্য যাতে না হয় সে ব্যবস্থা করা, অতিরিক্ত চাপ দিয়ে মলত্যাগের বদভ্যাস ত্যাগ করা, বারে বারে মলত্যাগের অভ্যাস ত্যাগ করা, নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করা, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা না করা, ডায়েরিয়া হলে দ্রুত চিকিৎসা নেয়া।
চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা: শুরুতে চিকিৎসা নিলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ রোগের জটিলতা এড়ানো সম্ভব। প্রাথমিক অবস্থায় পরিমিত (ঈড়হংবৎাধঃরাব) চিকিৎসায় ফিশার সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন করে রোগমুক্ত থাকা সম্ভব।
শুরুতে অল্প ব্যথা এবং রক্তপাত হয় বিধায় অধিকাংশ মানুষ বিষয়টি অবহেলা করেন। অথচ এ সময় মল নরম করার ওষুধ, ব্যথানাশক ওষুধ এবং স্থানিক মলম ব্যবহার করে রোগটির চিকিৎসা সম্ভব।
সিজ বাথ (ঝঃরু ইধঃয) এবং আঁশ জাতীয় খাবার বেশি করে গ্রহণ করে রোগীরা উপকার পান। ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী ফিশারের স্বল্প মেয়াদি (৬ মাস) চিকিৎসা সম্ভব। এরপর পুনরায় ইঞ্জেকশন দেয়ার প্রয়োজন হয়। দীর্ঘস্থায়ী ফিশার নির্মূলে অপারেশন প্রয়োজন। কেননা, দীর্ঘদিন ভোগার কারণে মলদ্বার সংকুচিত হয়ে যায় এবং মলদ্বারের পাশে মাংস বেড়ে (ঝবহঃরহবষ চরষবং) যায়, যা অপারেশন ছাড়া নিরাময় সম্ভব নয়। দেখা যায় অপারেশনের ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের ভীতি রয়েছে। উপরন্তু অপারেশনের পর সুস্থ হবো কিনা কিংবা মল ধরে রাখতে কোনো অসুবিধা হবে কিনা ইত্যাদি ভয়ে রোগীরা চিকিৎসকের কাছে যান না। এমনকি অনেকে ১৫ থেকে ২০ বছর রোগ পালন করেন। কিন্ত বর্তমানে আধুনিক কিছু চিকিৎসা ও অপারেশন করলে এই রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করা যায়। তবে কেবল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাই এ রোগের ভালো চিকিৎসা করে থাকেন।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক (কলোরেক্টাল সার্জারি বিভাগ) কলোরেক্টাল, লেপারোস্কপিক ও জেনারেল সার্জন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
চেম্বার: ১৯ গ্রীন রোড, এ. কে. কমপ্লেক্স, লিফট-৪, ঢাকা।
ফোন-০১৭১২৯৬৫০০৯