প্রথম পাতা
করপোরেট মজুতদারি অস্থির চালের বাজার
আরিফুল ইসলাম
২৮ জানুয়ারি ২০২৫, মঙ্গলবার
বাজারে চালের দাম কোনোভাবেই স্থিতিশীল হচ্ছে না। কয়েক দফায় চাল আমদানি করার পরও কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে মিলার, মালিক ও করপোরেট কোম্পানিগুলো। কিছুদিন আগেই আমন ধান কাটা শেষ হয়েছে। অথচ চালের ঊর্ধ্বমুখী দামে ভরা মৌসুম বাজারে প্রভাব ফেলতে পারছে না।
রাজধানী কাওরান বাজারে মিনিকেট চিকন ও নাজিরশাইর চাল বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে। মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬২ টাকা কেজি দরে। কিছুদিন আগেও মোটা চালের কেজি ছিল ৫৫ থেকে ৫৮ টাকার মধ্যে। গত সপ্তাহে চিকন চালের দাম ছিল ৭৮ থেকে ৮৮ টাকা। আর মাসখানেক আগে ছিল ৭৬ থেকে ৮২ টাকার মধ্যে। হঠাৎ করে চালের দাম বাড়ায় সংকটে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। সামনে রমজানকে কেন্দ্র করে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে চাল ও তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে বলে অভিযোগ জানিয়েছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
সরজমিন রাজধানীর কাওয়ান বাজার ও পুরান ঢাকার বাবু বাজারের পাইকারি চালের আড়ত ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। চালের এলাকা বলে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও দিনাজপুরে। সেখানকার ব্যবসায়ীরাও বলছেন, করপোরেট কোম্পানিগুলো ধানের আগাম মজুত বাড়ায়। আর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে মিল মালিকদের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চালের দাম বাড়ার পেছনে ওইসব করপোরেট কোম্পানিগুলোই দায়ী। এ ছাড়া বেশি দামে ধান কেনার কারণে দাম বাড়ছে বলেও জানান চাল ব্যবসায়ীরা।
বাবু বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল ৭২ থেকে ৮০ টাকা, নাজিরশাইর ৭২ থেকে ৯০ টাকা, বাসমতি ৯০ থেকে ৯৫ টাকা, আটাশ চাল ৫৮ থেকে ৬২ টাকা, গুটি স্বর্ণা ৫১ টাকা, পাইজাম চাল ৫৭ থেকে ৫৮ টাকা ও হাস্কি-১ ৫৮ থেকে ৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কাওরান বাজারে আসা নাজমুস সাকিব বলেন, সবজির দাম এখন মোটামুটি নাগালের মধ্যে রয়েছে। যার কারণে সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষরা সহজেই সবজি কিনে খেতে পারছে। ওদিকে চাল আর তেলের বাজারে রীতিমতো আগুন লেগেছে। আগুনের মধ্যে হাত দিলে যেমন হাতে আগুন লাগে। চালের বাজার এখন তেমনই হয়ে গেছে। তেলের দাম বাড়ানোর পরও বাজারে বোতলজাত ভোজ্য তেলের সংকট চলছে। রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের মতো ছোটখাটো চাকরিজীবীদের চাল তেল কিনতে, জানান তিনি।
তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী মমিন বলেন, আমার পড়াশোনা শেষ হয়েছে। চাকরির প্রস্তুতির জন্য এখনো মেসে আছি। বাজার করতে গেলে সহজে সবজি কিনতে পারি। কিন্তু চাল আর তেল কিনতে গেলে মাথা আর কাজ করে না। সরকার চাল আমদানি করলেন, তেলের দাম বাড়ালেন কিন্তু সেটা আমাদের সাধারণ মানুষের কোনো উপকারে এলো না। বাজারে আমরা এখনো চাল ও তেলের দাম স্থিতিশীল দেখছি না।
রায়হান নামে এক যুবক বলেন, দিনের পর দিন যদি এভাবে বাজার অস্থিতিশীল হতে থাকে তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।
বাবু বাজারে কথা হয় সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি শিঙাড়া সমুচা বিক্রি করি। সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার পরও আমার পণ্যের দাম কিন্তু বাড়াইনি। বাজারে আবার বোতলজাত সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা।
চালের আড়ত ও পাইকারি বাজার পুরান ঢাকার বাবু বাজারের একাধিক চাল ব্যবসায়ী জানান, বাজারে চালের দাম বাড়ার জন্য আমাদেরকে দোষ দেয়া হয়। আমরা তো চাল বিভিন্ন জায়গা থেকে কিনে বিক্রি করি। নওগাঁ, দিনাজপুর, শেরপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আমাদের এখানে চাল আসে। চালের দাম আমরা কীভাবে বাড়াবো। আমাদের যেমন কেনা তেমনই বিক্রি করা। কিন্তু বড় বড় কোম্পানিগুলোর মজুত করার ফলে চালের সংকট তৈরি হয়। তখন কোম্পানিগুলো সুযোগ বুঝে বাজারে চাল ছাড়েন। সরকার যেভাবে চাল আমদানি করছে, তাতে এখন আর বাজারে চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। ভারত সহ বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আসছে, আগামীতে চালের দাম বাড়ার আর কোনো কারণ দেখছি না বলেও জানান তারা।
হাজী রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী রুহুল আমিন বলেন, আমরা কিনি বিক্রি করি। বড় বড় রাঘববোয়ালরা চালের দাম বাড়ানোর পেছনে মূলত দায়ী।
রশিদ রাইস এজেন্সির ম্যানেজার এক কর্মকর্তা বলেন, বাজারের যে অবস্থা, তাতে চালের দাম সর্বোচ্চ বেড়েছে। ভারত থেকে চাল আসছে এখন বাজারে দাম কমে আসবে বলেও জানান তিনি।
চালের অন্যতম উৎপাদন এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর ও নওগাঁ। এসব জায়গায়ও চালের বাজার চড়া। স্থানীয় বাজারগুলোতে দুই সপ্তাহ আগেই পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে সব ধরনের আমন চালের দাম কেজিতে ৫-৮ টাকা বেড়েছে। খুচরা পর্যায়ে চিকন চাল বিক্রি হয়েছে ৭৮ টাকা কেজি। আর মোটা চাল বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৫৮ টাকায়।
চালের দাম বাড়ার জন্য ব্যবসায়ীরা আঙ্গুল তুলছেন কোম্পানি ও চাল-কল মালিকদের দিকে। তারা বলছেন, মিলমালিকরা বিভিন্ন অজুহাতে ৫০ কেজির বস্তায় দাম বাড়িয়েছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। এতে পাইকারি ও খুচরা বাজারে চালের দাম বাড়ছে। অনেকটা আক্ষেপ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউ মার্কেটের এক চাল ব্যবসায়ীরা বলেন, আমরাও মানুষ আমাদেরও ভাত খেতে হয়। দাম কেন বেশি, যারা উৎপাদন করে তাদের প্রশ্ন করেন। দাম নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানোর দাবি ভোক্তাদের।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাজারগুলোতে খুচরা পর্যায়ে মোটা চাল স্বর্ণা প্রতি কেজি ৩ টাকা বেড়ে ৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরু (মিনিকেট) চালের দাম প্রতি কেজি ৭৮ টাকা। সপ্তাহ দুয়েক আগেও ছিল ৭০ থেকে ৭২ টাকা। মাঝারি (পাইজাম) চালের দামও কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫৬ থেকে ৫৮ টাকায়। নাজিরশাইল ৩ টাকা কেজিতে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৮৮ টাকায়, কাটারিভোগ চাল বিক্রি হচ্ছে ৮৪ টাকা কেজি, যা ১৫ দিন আগে বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ৮২ টাকা কেজি।
জেলার মিলমালিকরা জানান, জানুয়ারি মাসের শুরু থেকেই বাজারে ধানের দাম ঊর্ধ্বমুখী। যে স্বর্ণা ধানের দাম আগে ১ হাজার ১০০ টাকা ছিল, সেই ধান এখন কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৩৫০ টাকা মণ। তবে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে জিরা ধানের। এই ধানের দাম প্রতি মণে ২০০-৩০০ টাকা বেড়ে বিক্রি ১ হাজার ৮৫০ টাকা মণ। ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় চালের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই চালের দাম বাড়াতে হয়েছে বলেও জানান তারা।
চালের দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অটোরাইস মিলমালিক সমিতির সভাপতি হারুন-অর-রশিদ জানান, এ জেলায় চালের কোনো সিন্ডিকেট নেই। হঠাৎ করেই ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় চালের দাম বাড়াতে হয়েছে। গত এক মাসে ধানের দাম যে পরিমাণে বেড়েছে, তাতে চালের দাম বেড়ে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান মানবজমিনকে বলেন, আমাদের বাজার মনিটরিং কার্যক্রম চলমান রয়েছে। গত দুই সপ্তাহে বিভিন্ন মিলমালিকদেরকে আমরা আনুমানিক ৪০ লাখ টাকার মতো জরিমানা করেছি।
উল্লেখ্য, খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে কোনো চাল আমদানি করা হয়নি দেশে। ২০২৩ সালে আমদানির পরিমাণ ছিল ছয় লাখ ৩৩ হাজার টন, ২০২২ সালে ছয় লাখ ৮৩ হাজার টন, ২০২১ সালে পাঁচ লাখ ৭২ হাজার টন চাল। এ বছর উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আড়াই লাখ টন চাল আমদানি করা হবে। এ ছাড়া মিয়ানমার থেকে জিটুজি বা সরকারি পর্যায়ে চুক্তির মাধ্যমে এক লাখ টন চাল আমদানি চূড়ান্ত করা হয়েছে। পাকিস্তান থেকেও ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করতে আলোচনা চলছে। আলোচনা চলছে ভারতের সঙ্গেও। জিটুজির বাইরে মিয়ানমার থেকে উন্মুক্তভাবে ৭৫ হাজার টন চাল আসবে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ১৬ই জানুয়ারির তথ্য অনুযায়ী, সরকারি গুদামে ১২ লাখ ৫২ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে। এর মধ্যে চাল আট লাখ ৫১ হাজার টন এবং গম তিন লাখ ৮৬ হাজার টন। গত বছর এ সময়ে সরকারের গুদামে খাদ্যশস্যের মজুত ছিল অন্তত ১৫ লাখ টন।
পাঠকের মতামত
ভাই খুবই সাধারণ ফরমুলা : টিসিবি কে দিয়ে প্রচুর পন্য বিক্রি করতে হবে. সামান্য এ ব্যাপার টা উপদেষ্টা দের মাথায় আসে না. It is very unfortunate!!!!
হে আল্লাহ্ যারা এই মজুতের সাথে জড়িত তুমি তাদেরকে হেদায়েত দাও না হয় তাদের ধ্বংস করে দাও। যারা গরিবের উপর জুলুম করছে তাদের তুমি উচিত শাস্তি দাও।
বসুন্ধরা, আকিজ, এসিআই, স্কয়ার, ফ্রেশসহ বিভিন্ন কর্পোরেট কোম্পানিগুলি চাউলের ব্যবসায় জড়িয়ে যাওয়ায় বর্তমান সংকট শুরু হয়েছে। ছোট ছোট প্যাকেট ও ছোট বস্তায় চাউলকে ব্র্যান্ডিং করায় এই দুর্ভোগ স্থায়িত্ব পাচ্ছে। ৭২কেজির বড় চটের বস্তায় ছাড়া কোন প্যাকেটজাত চাউল কিংবা আটা বিক্রি করতে পারবে না ..... এমন নির্দেশনা দিলে এসব কৃত্রিম সংকট কিছুটা কমে আসবে।
বড় বড় শিল্পগ্রুপের হাতে বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যাবস্হা দ্রব্য মূল্য অস্থিতিশীল করার জন্য দায়ী।একেকটা গ্রুপ বাজার থেকে একচেটিয়া হারে পণ্য ক্রয়পূর্বক তারা এককভাবে পণ্যের মূল্য নির্ধারণের সুযোগ পায়।ছোট ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয় আবার বাজারের পণ্য সরবরাহ স্থিতিশীল থাকে।