প্রথম পাতা
মেডিকেল ভর্তিতে কোটা বিতর্ক
স্টাফ রিপোর্টার
২১ জানুয়ারি ২০২৫, মঙ্গলবার
মেডিকেল ভর্তিতে থাকা কোটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। কোটাধারীরা ন্যূনতম ৪০ নম্বর পেয়েও সরকারি মেডিকেলে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। এ কারণে শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দেয়। ফল প্রকাশের পরই একদল শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করেন। গতকালও ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া আসায় স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর কোটায় ভর্তি যোগ্য হওয়া ১৯৩ জনের ফল আপাতত স্থগিত রেখে তাদের কোটার সনদ যাচাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনদিনে এই সনদ যাচাই করা হবে।
রোববার বিকালে চলতি শিক্ষাবর্ষের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। যাতে দেখা যায়, পাসের হার ৪৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। অংশগ্রহণকারী এক লাখ ৩১ হাজার ৭২৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে মোট ৬০ হাজার ৯৫ জন ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। দেশের ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য ৫ হাজার ৩৭২ জন পরীক্ষার্থীদের প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করা হয়। সরকারি মেডিকেল কলেজের ৫ হাজার ৩৮০টি এবং ৬৭টি অনুমোদিত বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ৬ হাজার ২৯৩টি আসনে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বর ছিল ৪০।
ফল প্রকাশের পর থেকেই সমালোচনা ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অনেকেই বলছেন, এখন মুক্তিযোদ্ধা কোটা একেবারে তুলে দেয়ার সময় এসেছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এখন ভর্তি পরীক্ষা বয়সী থাকার সুযোগ খুবই কম। আর যারা আছেন শুধুমাত্র পাস মার্ক পেয়েই ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন। এখানে মেধার অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। এ ছাড়াও মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার সঠিক উত্তরপত্র প্রকাশেরও দাবি জানানো হয়। অনেকেই অভিযোগ করেন প্রাপ্ত নম্বর থেকে ৫ নম্বর কম পেয়েছেন তারা।
প্রতিবাদ জানিয়ে জুলাই স্মৃতি ফাইন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেন, ভর্তি পরীক্ষায় এখনো কিসের কোটা? আজ থেকেই এই শোষণের শেষ হতে হবে। ফুলস্টপ।
রংপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী হাসিবুল ইসলাম লিখেন, আমার অপরাধটা কোথায় আমার মার্ক ৭০.২৫। কিন্তু আমি ভর্তির সুযোগ পেলাম না। কিন্তু ৪০/৪১ পেয়ে কোটাধারীরা ঠিকই ভর্তির সুযোগ পেলো। এই তো সেদিন কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন হলো। এখনো সড়কে রক্তের দাগ। এরইমধ্যে কতোটা বৈষম্যের শিকার হলে এ রকম সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। স্ট্যাটাসের শেষ অংশে লিখেন, কোটা যদি রাখতেই হয় তাহলে ন্যূনতম একটা যোগ্যতা রাখা উচিত ছিল। ৪০/৪১ পাওয়া শিক্ষার্থী দিয়ে কতোটা ভালো ডাক্তার পাওয়া যায়?
কোটায় সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মেধা তালিকা যাচাই করে দেখা যায়, অনেক পরীক্ষার্থীর প্রাপ্ত স্কোর ৪০ থেকে শুরু করে ৫০’র মধ্যে। পাস মার্ক ৪০ নম্বর পেয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন দু’জন। এ ছাড়াও ৪০+ থেকে ৪২ নম্বর পেয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন ৪০ জন। অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বর ৫৫ এর উপরে। যেখানে সাধারণ শিক্ষার্থী ৭০+ পেয়েও মেডিকেলের জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হননি।
গতকাল ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অযৌক্তিক কোটা প্রথার নিরসন ও মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল পুনঃপ্রকাশের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে সর্বস্তরের শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষোভ সমাবেশ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এ সময় চিকিৎসক, শিক্ষার্থী ও ছাত্র প্রতিনিধিরা সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।
সমাবেশে প্রফেসর ডা. মেজর (অব) আব্দুল ওহাব বলেন, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় এমন কিম্ভূতকিমাকার লোকজন চান্স পেয়েছে ৪০, ৪১ পেয়ে, অথচ এর ডাবল মার্ক পেয়েও অনেকে চান্স পায়নি। এটা কি বৈষম্য না? স্বৈরাচারের লোকেরা প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে আর তাদের কুকর্মে প্রকাশ হলো এই রেজাল্ট। এরপর তিনি কোটার বিলুপ্তি ও ফলাফল পুনঃপ্রকাশের দাবি জানান। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, যেহেতু রাজপথে নামতে শিখেছো, সেহেতু তোমাদের রাজপথ থেকেই অধিকার আদায় করে নিতে হবে।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী আবির হোসেন বলেন, আগে মেডিকেল পরীক্ষায় কোটা থাকলেও সেখানে কাট মার্কের চেয়ে ১/২ মার্কের কম চান্স পেতো কিন্তু এই বছর নাতি-নাতনি কোটায় কাট মার্কের চেয়ে ৩০/৩৫ কম পেয়েও সরকারি মেডিকেলে চান্স পেয়েছে যা আমরা মেনে নিতে পারি না, মানবো না। আমরা মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ সকল ধরনের কোটার বিলুপ্তি চাই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সহ-সমন্বয়ক নাদিম মাহমুদ শুভ বলেন, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল পুনঃপ্রকাশ না করা হলে লাগাতার কর্মসূচি দেবেন। এরপর তারা দাবি সংবলিত বার্তা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে জমা দেন।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. রুবীনা ইয়াসমিন বলেন, তাদের সনদ আগামী ২৭, ২৮ ও ২৯শে জানুয়ারি যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, কেবলমাত্র মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনার সন্তানরা কোটায় ভর্তির সুযোগ পাবেন। মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা বাদ পড়ে যাবেন। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চান্সপ্রাপ্তদের তথ্য যাচাই করা হবে। তিনি আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় শূন্য হওয়া আসনে মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হবে। এটা একটা নিয়মিত প্রক্রিয়া তাদের এই সনদ যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত পূর্বেই নেয়া হয়েছিল। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোটা বাতিলের দায়িত্ব আমাদের না। এই দায়িত্ব সরকারের।
জানা যায়, ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটার অধীনে ২৬৯ জন সুযোগ পাওয়ার কথা। কিন্তু শর্ত পূরণ না হওয়ায় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ১৯৩ জন প্রার্থী পাওয়া গেছে। অবশিষ্ট ৭৬টি আসন মেধা তালিকা থেকে পূরণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নয়। আপনারা জানেন যে কোটা বাতিলের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত থেকে যে রায় দেয়া হয়েছিল, সেখানে মূল পরিবর্তন হলো নাতি-নাতনির পরিবর্তে, পরবর্তী প্রজন্মের বদলে সন্তান বলা হয়েছে। অতএব, কোটার বিষয়টিতে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে এটা একটা নীতিগত সিদ্ধান্ত। এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষাও প্রচলিত আইন ও বিধি অনুযায়ী হয়েছে। তারপরও এটা স্ক্রুটিনি করা হবে।
তিনি বলেন, এই ১৯৩ জনের মধ্যে খুবই আনইউজুয়াল হবে যাদের বাবার বয়স ৬৭-৬৮ এবং যাদের সন্তান থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। সেখানে যদি কোনো ত্রুটি ধরা পড়ে তাহলে সেটা দেখা হবে। এমবিবিএস পরীক্ষায় মূল কোটা থাকবে কি থাকবে না এই নীতিগত সিদ্ধান্তটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নয়, এটি রাষ্ট্রের। আগামী ২৭, ২৮ ও ২৯শে জানুয়ারি এটি যাচাই করা হবে।
গতকাল রাতে পাঠানো এক বার্তায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় জানায়, মেডিকেল কলেজ ২০২৪-২৫ সালের এমবিবিএস ভর্তি কার্যক্রমে ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিদ্যমান বিধি অনুসারে শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনাদের সন্তানদের জন্য প্রযোজ্য হবে, তাদের নাতি-নাতনি বা অন্য কারও জন্য প্রযোজ্য হবে না। এই কোটার অধীনে সংরক্ষিত ২৬৯টি আসনের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ১৯৩ জন প্রার্থী পাওয়া গেছে। অবশিষ্ট ৭৬টি আসন ইতিমধ্যেই মেধা তালিকা থেকে পূরণ করা হয়েছে। এই কোটায় প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত ১৯৩ জনের পিতা/মাতার মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র, নিজের জন্মনিবন্ধন সনদসহ যাবতীয় প্রমাণাদি ও একাডেমিক সার্টিফিকেট নিয়ে আগামী ২৯শে জানুয়ারির মধ্যে মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পুরাতন ভবনের দোতালায় অবস্থিত মেডিকেল এডুকেশন শাখায় উপস্থিত হয়ে যাচাই-বাছাই করাতে হবে।
এতে আরও বলা হয়, যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় কোনো ভুল বা অসত্য তথ্য পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর ভর্তি বাতিল হবে এবং মেধা তালিকা থেকে সেই শূন্য আসন পূর্ণ করা হবে। এই যাচাই-বাছাই কার্যক্রম সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এই ১৯৩ জনের ভর্তি সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। অবশিষ্টদের ভর্তিসহ মেডিকেল কলেজের অন্যান্য কার্যক্রম যথারীতি চালু থাকবে।
পাঠকের মতামত
আমার ভাগ্নি ৭২ নম্বর পেয়ে ও সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ নেই, এটা দুঃখজনক।
এই মুহূর্তে কোটার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। সম্পূর্ণ রূপে কোটা বিলুপ্ত করার দাবী জানাচ্ছি।
২০২৫ সালে কোন মুক্তিযুদ্ধার সন্তানের বয়স ১৮/২০ বছর হবে আর সেটাও আমাদের বিশ্বাস করতে হবে? ভিখারির দলগুলো কচু পাতার পানি হয়ে গেছে
ভাই খুবই কষ্ট লাগে আমার মেয়ে ৬৯পেয়েও সরকারি বেসরকারি কোন স্থানে ভর্তির সুযোগ হয়নি । তাহলে কি দরকার আমরা অটো চালিয়ে, না খেয়ে ছেলেমেদের পড়া লেখার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় কেন পোষ্য কোটা বহাল রাখার চেষ্টা হচ্ছে?