শেষের পাতা
নারী ও শিশু নির্যাতন
আওয়ামী লীগের শেষ সাড়ে ৫ বছরে মামলা ১ লাখ ১৮ হাজার ৯০০
শুভ্র দেব
১০ ডিসেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবারসারা দেশে প্রতিনিয়তই নারী ও শিশুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপসহ নানাভাবে নারী ও শিশুদের নির্যাতন করা হয়। ভয়, হয়রানি, সামাজিক অবস্থান ও মান সম্মানের ভয়ে অধিকাংশ নারী ও শিশু আইনের আশ্রয় ও মামলা না করলেও দেশের বিভিন্ন থানায় মামলার পরিসংখ্যান আকাশচুম্বী। পুলিশ সদরদপ্তরের মামলার পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে গড়ে প্রতিদিন সারাদেশে ৫৮টি নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা হয়। প্রতি মাসে গড়ে মামলা হয় ১৭৪৯টি। আওয়ামী লীগ শাসন আমলের শেষ সাড়ে পাঁচ বছরে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা হয়েছে এক লাখ ১৮ হাজার ৯০০।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালে সারাদেশের থানাগুলোতে মামলা হয়েছে ২১ হাজার ৭৬৪টি। ওই বছর বেশি মামলা হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের বিভিন্ন থানায় দুই হাজার ৪০০টি, ঢাকা রেঞ্জে তিন হাজার ৪৩২টি, চট্টগ্রাম রেঞ্জে দুই হাজার ৮৬০টি, খুলনা রেঞ্জে এক হাজার ৯৪৩টি, বরিশাল রেঞ্জে এক হাজার ৫৭৭টি, রাজশাহী রেঞ্জে দুই হাজার ৪৭৪টি, রংপুর রেঞ্জে দুই হাজার ৪৩২টি ও ময়মনসিংহ রেঞ্জে এক হাজার ৬৭৫টি মামলা হয়েছে। ২০২০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা হয়েছে ২২ হাজার ৫১৭টি। মামলার মধ্যে ডিএমপিতে দুই হাজার ১৯৮, ঢাকা রেঞ্জে তিন হাজার ৩৯৮, ময়মনসিংহ রেঞ্জে এক হাজার ৮৬১, চট্টগ্রাম রেঞ্জে দুই হাজার ৮৮৮, খুলনা রেঞ্জে দুই হাজার ১৩৫টি, বরিশাল রেঞ্জে এক হাজার ৪৩২, রাজশাহী রেঞ্জে দুই হাজার ৮৬১ ও রংপুর রেঞ্জে দুই হাজার ৫৪৩টি মামলা হয়েছে। ২০২১ সালে মামলা হয়েছে ২২ হাজার ১৩৬টি। এর মধ্যে বেশি মামলা হয়েছে, ডিএমপিতে দুই হাজার ২১৮, ঢাকা রেঞ্জে তিন হাজার ৫৫৯, ময়মনসিংহ রেঞ্জে দুই হাজার ১৫৫, চট্টগ্রাম রেঞ্জে দুই হাজার ৮২৩, খুলনা রেঞ্জে দুই হাজার ১৫, বরিশাল রেঞ্জে এক হাজার ৩০০, রাজশাহী রেঞ্জে দুই হাজার ৩১০ ও রংপুর রেঞ্জে দুই হাজার ৫২৯টি। ২০২২ সালে সারাদেশে মামলা হয়েছে ২১ হাজার ৭৬৬টি। এর মধ্যে বেশি মামলা হয়েছে, ডিএমপিতে দুই হাজার ১২, ঢাকা রেঞ্জে তিন হাজার ৪৭৯, ময়মনসিংহ রেঞ্জে দুই হাজার ১৭২, চট্টগ্রাম রেঞ্জে দুই হাজার ৪৮৬, খুলনা রেঞ্জে এক হাজার ৯৩২, বরিশাল রেঞ্জে এক হাজার ২৮৩, রাজশাহী রেঞ্জে দুই হাজার ৬২৪ ও রংপুর রেঞ্জে দুই হাজার ৬৪৬টি। ২০২৩ সালে সারাদেশে মামলা হয়েছে ১৮ হাজার ৯৪১টি। এর মধ্যে বেশি মামলা হয়েছে, ডিএমপিতে এক হাজার ৬০২টি, ঢাকা রেঞ্জে তিন হাজার ২৯১, ময়মনসিংহ রেঞ্জে এক হাজার ৭৯৮, চট্টগ্রাম রেঞ্জে দুই হাজার ২০, খুলনা রেঞ্জে এক হাজার ৬৯৮, বরিশাল রেঞ্জে এক হাজার ৩০১, রাজশাহী রেঞ্জে দুই হাজার ২৮৯ ও রংপুর রেঞ্জে দুই হাজার ৩৭৭টি। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত মামলা হয়েছে ১১ হাজার ৭৭৬টি। এর মধ্যে ডিএমপিতে ৯৭৯, ঢাকা রেঞ্জে দুই হাজার ৪৬, ময়মনসিংহ রেঞ্জে ৮৯৮, চট্টগ্রাম রেঞ্জে এক হাজার ২৬৪, খুলনা রেঞ্জে এক হাজার ২২, বরিশাল রেঞ্জে এক হাজার ১৫৩, রাজশাহী রেঞ্জে এক হাজার ৫১২ ও রংপুর রেঞ্জে এক হাজার ৪৬৭টি।
এদিকে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় যেসব মামলা হচ্ছে সেসব মামলায় অনেক সময় একের অধিক সংখ্যক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। কিন্তু মামলায় আসামি গ্রেপ্তার খুবই কম হয়। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে সারাদেশের থানা ও আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে যৌতুক, ধর্ষণ, ধর্ষণ চেষ্টা, দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপ ও অপহরণ ধারায় মোট ১২ হাজার ৭৬৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু নারী নির্যাতনের অভিযোগে মামলা হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৬টি। বাকিগুলো শিশু নির্যাতনের অভিযোগে। নারী নির্যাতনের মামলায় মোট আসামি করা হয়েছে ২৪ হাজার ৩৩৯ জনকে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে মাত্র সাত হাজার ৮৩৫ জন। পরিসংখ্যান মতে, ৯ মাসে প্রায় ৬৮ শতাংশ আসামি গ্রেপ্তার হননি।
চলতি বছরের ২৯ জুন ঢাকার খিলক্ষেত এলাকায় স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক নারী। ওইদিন খিলক্ষেতের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বনরূপা এলাকায় গেলে সেখানে আবুল কাশেম ওরফে সুমনের নেতৃত্বে সাতজনের দল তাদের অপহরণ করে। ভুক্তভোগী নারী ও তার স্বামীকে বনরূপা এলাকার ঝোপঝাড়ের ভেতরে নিয়ে যায় অপহরণকারীরা। পরে স্বামীকে বেঁধে রেখে নারীকে ধর্ষণ করা হয়। পরে স্বামীর কাছে ৭০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন তারা। মুক্তিপণের টাকা আনার জন্য ছেড়ে দিলে তিনি বেরিয়ে এসে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন দেন। পরে পুলিশ গিয়ে ওই নারীকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। অভিযান চালিয়ে পুলিশ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে।
২৭শে অক্টোবর নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চর এলাহী ইউনিয়নের একটি দুর্গম চরে মা ও মেয়েকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
সমাজ ও অপরাধ বিজ্ঞানী ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, আমাদের দেশে নারী ও শিশুকে নিরাপদ রাখার ক্ষেত্রে আমরা যথেষ্ট পিছিয়ে আছি। কারণ আইন আছে কিন্তু সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ করতে পারছি না। এছাড়া বিভিন্ন ঘটনায় যেসব মামলা হয় সেগুলোর বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা যায়। এসব কারণে অভিযুক্ত বা অপরাধপ্রবণ ব্যক্তিরা মনে করে এসব ঘটনা ঘটালেও বিচারে দীর্ঘসূত্রিতার মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করে তার অনুকূলে রাখতে পারবেন।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন মানবজমিনকে বলেন, সবচেয়ে বড় কারণ হলো আইন আছে কিন্তু আইনের প্রয়োগ নাই, ন্যায্যতা নাই, জবাবদিহিতা নাই। সমাজ একটা অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে পার করছে। কারণ দেশে যখন স্বৈরশাসক ছিল তখনো অস্থিরতা ছিল এখনো নিঃশেষ হয়েছে- এটা বলা যাবে না। এরকম পরিস্থিতির কারণে এসব ঘটনা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধিই পাচ্ছে।