শরীর ও মন
কলোরেক্টাল রোগ পাইলস নিয়ে কথা ও অপচিকিৎসা
ডা. মোহাম্মদ তানভীর জালাল
১৯ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবারসাধারণত মলদ্বারের যেকোনো সমস্যাকেই পাইলস মনে করা হয়; যা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। পাইলস ছাড়াও অনেক রোগ আছে (যেমন- মলদ্বারের ক্যান্সার) যাতে একই ধরনের লক্ষণ দেখা যায়। আমাদের মলদ্বারে সাধারণত ৩টি এনাল কুশন থাকে যা মলদ্বারের মুখ বন্ধ রাখে, যাতে বাতাস বা নরম পায়খানা যখন-তখন বের হতে না পারে। যখন এই এনাল কুশন (রক্তনালির মাংসপিণ্ডগুলো) স্বাভাবিকের তুলনায় বড় হয়ে বিভিন্ন উপসর্গ (যেমন- মলদ্বার দিয়ে রক্ত যাওয়া বা মলদ্বার দিয়ে মাংসপিণ্ড বের হয়ে আসা) তৈরি করে তখনই আমরা একে পাইলস বা হেমোরয়েড বলি।
কোন বয়সে হয়ে থাকে: যেকোনো বয়সে হতে পারে। তবে সাধারণত যুবক ও বয়স্ক মানুষের বেশি হয়। বাচ্চাদের হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
পাইলসের শ্রেণিকরণ:
* External hemorrhoids- মলদ্বারের বাইরে থাকে।
* Internal hernorrhoids- মলদ্বারের ভেতরে থাকে।
* Interoexternal haemorrhoids- মলদ্বারের ভেতর থেকে বাইরে থাকে।
অভ্যন্তরীণ পাইলস আবার ৪ প্রকার-
* গ্রেড-১: শুধু রক্তপাত হয়, ব্যথামুক্ত, কোনো মাংসপিণ্ড বের হয় না।
* গ্রেড-২: রক্তপাত হয়, ব্যথামুক্ত, মাংসপিণ্ড বের হয় কিন্তু হাতে লাগে না।
* গ্রেড-৩: রক্তপাত হয়, ব্যথামুক্ত, মাংসপিণ্ড বের হয়, হাতে লাগে। তা আঙ্গুল দিয়ে ভেতরে ঢুকাতে হয়।
* গ্রেড-৪: মাংসপিণ্ড মলদ্বার দিয়ে বের হলে তা আর ঢুকানো সম্ভব হয় না।
কারণসমূহ:
* দীর্ঘমেয়াদি কোষ্ঠকাঠিন্য বা পাতলা পায়খানা।
* শাক-সবজি ও অন্যান্য আঁশযুক্ত খাবার এবং পানি কম খাওয়া।
* মাংস জাতীয় খাবার, ফাস্টফুড, বেশি মসলাযুক্ত, ঝাল ও চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়া।
* শরীরের অতিরিক্ত ওজন।
* গর্ভাবস্থা।
* লিভার সিরোসিস।
* মল ত্যাগে বেশি চাপ দেয়া।
* ঘন ঘন পায়খানা নরমকারক ওষুধ ব্যবহার করা।
* টয়লেটে প্রয়োজনের অধিক সময় ব্যয় করা।
* বৃদ্ধ বয়স।
* বংশগত পাইলস থাকা।
* ভারী exercise করা, বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা।
* নিয়মিত টয়লেট/মলত্যাগ না করা।
পাইলস হলে বুঝার কিছু উপায়:
* পায়খানার সময় ব্যথাহীন রক্তপাত হওয়া।
* মলদ্বারের ফোলা বাইরে বের হয়ে আসতে পারে।
* জটিলতা হলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যথা হতে পারে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা:
* সাধারণত পাইলস নির্ণয়ে তেমন কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয় না।
* মলদ্বার দেখে, আঙ্গুল দিয়ে পরীক্ষা করে এবং প্রক্টোস্কোপি করে নির্ণয় করা হয়।
* তবে অন্য কোনো রোগ আছে কিনা যেক্ষেত্রে একই ধরনের লক্ষণ দেখা যায় (যেমন- পলিপ, ক্যান্সার, ওইউ) সেই সন্দেহ দূর করার জন্য full or short colonoscopy করা হয়।
এ রোগ প্রতিরোধ করার উপায়:
* শাক-সবজি বেশি খাবেন, মাংস কম খাবেন।
* ফাস্টফুড, বেশি মসলাযুক্ত, ঝাল ও চর্বিজাতীয় খাবার খাবেন না।
* পানি বেশি খাবেন, সফট ড্রিংকস খাবেন না।
* বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে বা বসে থাকবেন না।
* নিয়মিত ব্যায়াম করবেন।
* দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য বা পাতলা পায়খানা এড়িয়ে চলবেন।
* নিয়মিত টয়লেট/মলত্যাগ করুন।
* শরীরের ওজন কমান।
* অধিক সময় টয়লেটে বসে থাকবেন না।
* মলদ্বার শুষ্ক ও পরিষ্কার রাখুন।
* প্রয়োজনে রাতে ও সকালে ২ মুঠ ইসুবগুলের ভুষি পানিতে/লেবুর শরবত/দুধ/ফলের রসের সঙ্গে ভিজিয়ে খেতে পারেন।
পাইলস কি পুরোপুরি ভালো হয়, অনেকেরই প্রশ্ন?
এটা খুবই পড়সসড়হ একটা প্রশ্ন। হ্যাঁ, পাইলস অবশ্যই ভালো হয়। তবে depend করে কোন grade-এ আছে তার ওপর। চারটা grade আছে। চিকিৎসাও নির্ভর করে কোন grade-এ আছে তার ওপর। আর ভালো হওয়া নির্ভর করে proper treatment হচ্ছে কিনা, এবং সঠিক diagnosis হয়েছে কিনা তার ওপর।
আপনাকে অবশ্যই একজন ভালো colorectal surgeon-এর সঙ্গে কথা বলতে হবে। Early stage এ medicine এই ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু advanced stage এ operation লাগে। অনেকগুলো সার্জারির options আছে। প্রায় ১৫ থেকে ২০ ধরনের সার্জারি করার সুযোগ আছে। অধিকাংশ operation-B ব্যথামুক্ত ও রক্তপাতহীন। স্বাভাবিক জীবনযাপনে কোনো সমস্যা হয় না।
এটা কি আবার হতে পারে?
এটাও একটা খুবই common একটা প্রশ্ন। হ্যাঁ, হতে পারে। তবে তা নির্ভর করে সঠিক রোগ নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসা হয়েছে কিনা তার ওপর। পাশাপাশি আপনার লাইফ স্টাইল ও আপনি নিয়মকানুন মানছেন কিনা তার ওপর। সাধারণত সঠিক চিকিৎসা হলে এবং নিয়ম মেনে চললে পুনরায় হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম।
অপচিকিৎসা বা কুসংস্কার
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ‘অপচিকিৎসা’ পাইলসের হয়। ‘অপচিকিৎসা’ রোগের জটিলতাকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। ‘অপচিকিৎসা’ হলে পুনরায় রোগীকে সুস্থ করতে চিকিৎসকেরও অনেক বেগ পেতে হয়। তথাকথিত চিকিৎসক নামধারী কিছু ব্যক্তি, চিকিৎসাবিজ্ঞানের কোনো জ্ঞান ছাড়াই এইসব রোগের অপচিকিৎসা করছেন, আর হাজার হাজার ভুক্তভোগী রোগী প্রতিদিন প্রতারণার শিকার হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিষাক্ত কেমিক্যাল ইনজেকশন ও কালো রঙের পাউডার জাতীয় এক ধরনের এসিড মলদ্বারে ব্যবহার করেন। ফলে মলদ্বারের মাংসপেশিতে পচন ধরে এবং তীব্র ব্যথা-যন্ত্রণা ও দুর্গন্ধ হয়। রোগীদের প্রলুব্ধ করা হয় বিনা অপারেশনে চিকিৎসা এবং ১০০% গ্যারান্টি, বিফলে মূল্য ফেরত এই জাতীয় কথা বলে। এরপর যখন বিষাক্ত কেমিক্যাল প্রয়োগ করা হয় তখন তীব্র ব্যথা ও যন্ত্রণা শুরু হয়, তখন উপশমের জন্য অতিরিক্ত মাত্রার বিভিন্ন ধরনের ব্যথানাশক ইনজেকশন বা ওষুধ ব্যবহার করে। অনেকের পায়খানার রাস্তা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায় এবং পেটে ব্যাগ লাগানো লাগে। পায়খানার রাস্তা নতুন করে বানাতে হয়। ফলে অনেক জটিল সার্জারির প্রয়োজন হয়। অনেকের পায়খানা ধরে রাখতে সমস্যা হয়। সবসময় অনবরত চুইয়ে চুইয়ে পায়খানা বের হয়। কাপড়-চোপড় নষ্ট হয়ে যায়। প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে মলদ্বার আবার তৈরি করতে হয় যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং জটিল একটি সার্জারি। অনেক সময় অপচিকিৎসার কারণে অনেক রোগী প্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যান। অনেকের শরীরের বিভিন্ন অংশ অবশ হয়ে যায়। বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করার কারণে nerve-এ সমস্যা হয়; যার ফলে স্নায়ু দুর্বল হয়ে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে শরীর অবশ হয়ে যায়। আবার অনেকের আংশিক অবশ হয়ে যায়। কারও কারও ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। তাই এ ধরনের চিকিৎসা এখন আর করা হয় না। কারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক বেশি। অনেক সময় মলদ্বার চাপা হয়ে আসে। পায়খানা করতে সমস্যা হয়। এনাল ফিসার ও মলদ্বার সংকোচনের সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। তাছাড়া এখন অনেক ভালো চিকিৎসা হাতের কাছেই আছে। তবে পাইলসের চিকিৎসা ফবঢ়বহফ করে কোন grade-G আছে, আর proper treatment হচ্ছে কিনা। আর এজন্য আপনাকে অবশ্যই একজন ভালো colorectal surgeon-এর সঙ্গে কথা বলতে হবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক (কলোরেক্টাল সার্জারি বিভাগ) কলোরেক্টাল, লেপারোস্কপিক ও জেনারেল সার্জন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
ইমেইল: [email protected]
www.facebook.com/Dr.Mohammed TanvirJalal
ফোন: ০১৭১২৯৬৫০০৯