শেষের পাতা
চোখের আলো হারিয়ে ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখছেন নবী
ফাহিমা আক্তার সুমি
২ নভেম্বর ২০২৪, শনিবারসৈয়দ হাসিবুন নবী। একটি বেসরকারি টেলিভিশনে কর্মরত। জুলাই অভ্যুত্থানে নিয়মিত সংবাদ সংগ্রহের কাজে সরব ছিলেন। ৫ই আগস্ট প্রতিদিনের মতো সংবাদ সংগ্রহে বের হয়ে সাভার রেডিও কলোনি সংলগ্ন ভেতরের গলিতে অবস্থান নেন। এ সময় গাড়ি থেকে নেমে এক পুলিশ সদস্য তার সামনে এসে শটগান তাক করে ধরেন। পরিচয়পত্র দেখিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দেন। গাড়িতে থাকা অপর এক পুলিশ কর্মকর্তা সাংবাদিক পরিচয় জেনেও গুলি ছোড়ার নির্দেশ দেন। মুহূর্তেই নবীকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন সেই পুলিশ সদস্য। এতে তার চোখ, মাথা, মুখ, বুকসহ শরীরের অন্যান্য স্থানে ৯২টি ছররা গুলি বিদ্ধ হয়। দীর্ঘদিন জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। নবীর ডান চোখে একটি গুলি বিদ্ধ হয়ে নিভে যায় আলো। শরীরে বিদ্ধ গুলির যন্ত্রণায় ছটফট করছেন।
সৈয়দ হাসিবুন নবী মানবজমিনকে বলেন, গত ৬ই আগস্ট থেকে ৫ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। এরমধ্যে তিনটি অপারেশন হয়েছে। এখন ১৫ দিন পরপর হাসপাতালে যেতে হয়। চিকিৎসকরা বলেছেন, আমার যে কন্ডিশন তাতে ডান চোখে আমি আর কোনো দিন দেখতে পাবো না। লাস্ট অপারেশনের পরে চোখে সবকিছু ঝাপসা দেখি। এই চোখের কারণে বাম চোখেও কিছুটা চাপে আছে। চিকিৎসকরা বলেছেন, সময় লাগবে অনেক, এভাবে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। যদি সামর্থ্য থাকে তাহলে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নেয়ার পরামর্শও দিয়েছেন। আমার স্ত্রী ও তিন বছরের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। দশ বছর আগে মা হোসনে আরা স্ট্রোক করে মারা যান। বাবা এস এম গোলাম মোর্তজা একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। তিনিও মাঝে মধ্যে আমাদের সঙ্গে থাকেন। বাবা অবসরে আসার পরে এখন পর্যন্ত কোনো পেনশনের টাকা-পয়সা পাননি। দুই ভাইবোনের মধ্যে আমি বড়। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পর আমি বোনের বাড়িতে থাকি। আমার এমন দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে গত মাসে সাভারে আমার বাড়িতে ডাকাতি হয়। সে সময় ঘরে থাকা স্বর্ণালংকারসহ অন্যান্য মালামাল ডাকাতি করে নিয়ে যায়। দীর্ঘ সময় হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। তিন মাস ধরে ঘরে বসে আছি কাজ করার শক্তি পাচ্ছি না। অফিস আমাকে সাপোর্ট দিয়েছে।
সেদিন ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, প্রতিদিনের মতো গত ৫ই আগস্ট সংবাদ সংগ্রহ করতে সাভার রেডিও কলোনি বাসস্ট্যান্ডে অবস্থান নেই। এ সময় পুলিশের তিনটি গাড়ি আসে। হাইওয়েতে না দাঁড়িয়ে ভেতরের গলির রাস্তায় গিয়ে মোবাইল দেখছি। হঠাৎ মেইন রোড থেকে গাড়ি থেকে নেমে ডিভাইডার ক্রস করে এসে একজন পুলিশ সদস্য শটগান তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। তখন আমার হাতে মাইক্রোফোন, আইডি কার্ড ছিল। তারপরও আমি হাত উঁচু করে চিৎকার করে বলি আমি সাংবাদিক, মাছরাঙ্গা টেলিভিশনে কাজ করি। এভাবে তাকে দ্বিতীয়বার আবার বলি আমাকে ফায়ার করবেন না। তখন আমার আশেপাশে কোন পথচারী, শিক্ষার্থী এমন কেউ ছিল না দোকানপাটও সব বন্ধ। এ সময় ওই পুলিশ সদস্য গাড়িতে থাকা এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বলে, স্যার ইনি তো সাংবাদিক। এ কথা বলার পর গাড়ি থেকে নির্দেশনা আসে আমাকে শুট করার। যখনই এই কথা শুনি তখন ভয়ে কাঁপছিলাম। সাহস নিয়ে আবার তাদের সাংবাদিক পরিচয় দেই। এ সময় পুলিশের ওই কর্মকর্তা খুব অশ্লীল গালি দিয়ে বলে ওঠে, বলেছি না শুট করতে। তখন খুব কাছ থেকে আমাকে লক্ষ্য করে শটগান দিয়ে শুট করে। চোখ, মুখ, মাথা, কপালসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ৯২টি ছররা গুলি বিদ্ধ হয়। এ সময় আমি রাস্তার পাশে ফুটপাথে পড়ে যাই। আমাকে গালি দিয়ে বলে, দৌড় দে। আমার চোখ ও শরীর দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিলো। ভেবেছিলাম আমার চোখ মনে হয় বের হয়ে গেছে। সিঁড়িতে রক্ত ভেসে যাচ্ছিলো। সেখানে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা অবস্থায় আরেকটি ফায়ার করে তখন আমার শরীরে আরও কিছু গুলি লাগে।
তিনি বলেন, পুলিশের গাড়ি থেকে পরে আরেক ব্যক্তি সিভিলে নেমে আসে। তার হাতে একটা স্নাইপার ছিল। তখন মনে হয়েছে এইবার আমাকে মেরে ফেলবে। এ সময় আমি উঠে দৌড়ানোর চেষ্টা করি। কিছুটা দূরে গেলে আরেকটি গুলির শব্দ শুনতে পাই। হঠাৎ বাম পাশে ঘাড়টা ঘুরিয়ে দেখি হলুদ রঙ্গের পাঞ্জাবি পরা এক তরুণ আমার পায়ের কাছে এসে উপুড় হয়ে পড়ে গেল। তার মাথার পেছন দিক থেকে গুলি লেগে চোখ বরাবর বেরিয়ে যায়। এ সময় আমি আরেকটি গলিতে চলে যাই। একজন চা দোকানি আমাকে চিনতে পেরে জাপটে ধরে। একজন ভাড়াটিয়া আমাকে চিনতে পেরে বাসার মধ্যে নিয়ে যায়। পরে তারা এনাম মেডিকেলে নিয়ে যায়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আমার গুলি লাগে। সারাদিন-সারা রাত থাকলেও সেখানে আমার তেমন কোনো চিকিৎসা হয়নি। পরে এলাকার একটি বেসরকারি মেডিকেলে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নেই। তারা ঢাকার জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে পাঠায়। চোখে ১টা, মাথায় ১টা, দাঁতের চোয়ালে ১টা, গলার মধ্যে শ্বাসনালীর পাশে ২টা ও বাকিগুলো শরীরের হাতে, বুকে, পেটেসহ বিভিন্ন জায়গায়। কোথাও কোনো গাড়ি বা এম্বুলেন্স পাওয়া যাচ্ছিলো না। পুরো রাত চেষ্টা করে কয়েকগুণ ভাড়া দিয়ে একটা গাড়ি ম্যানেজ করে ভোর ৪টায় চক্ষুবিজ্ঞানে গিয়ে পৌঁছাই। সেখানে দুপুর আড়াইটায় আমার প্রথম অপারেশন হয়। কোনো গুলি আমার শরীর থেকে বের করা সম্ভব হয়নি। গুলিগুলো বিদ্ধ হয়ে খুব গভীরে চলে যায়।
সৈয়দ হাসিবুন নবী বলেন, স্বপ্ন ছিল একমাত্র সন্তানকে নতুন বছরে স্কুলে ভর্তি করবো। বাবারও বয়স হয়েছে তার জন্য অনেক কিছু করার ইচ্ছা ছিল যেহেতু অল্প বয়সে মা মারা যাওয়ায় তার জন্য কিছুই করতে পারিনি। আমাদের গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী। বাবার চাকরির সুবাধে ছোটবেলা থেকেই ঢাকাতে থাকি। বাবা পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করতেন। তিনি অবসরে আসার পরে কোনো পেনশন পান না। এমন অমানবিক ঘটনা আমার সঙ্গে ঘটবে ভাবিনি। জীবনটা এমন অনিশ্চিত হবে কল্পনা করিনি। আমি আদৌ কি এই চোখে কখনো দেখতে পাবো? আমি কি কাজে ফিরতে পারবো? আলোহীন চোখে এভাবেই আমাকে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হবে। আমি আগের মতো স্বাভাবিক হতে পারছি না, একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। শরীরে এতগুলো গুলির ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারি না। সামনের দিনগুলোতে সংসারের খরচ কীভাবে চালাবো। বৃদ্ধ বাবাকে কীভাবে দেখবো, একমাত্র সন্তানকে কীভাবে মানুষ করবো। ওরা আমার জীবনটাকে অন্ধকার করে দিয়েছে।
কি ভাবে সহমর্মিতা জানাই, আল্লাহপাক তোমাদের এই ত্যাগ কবুল করুণ। রাষ্ট্র তোমাদের পাশে সর্বোচ্চ সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিবে এই কামনা করি।
রাষ্ট্রকে অবশ্যই দায়িত্ব নিতে হবে।