ঢাকা, ৯ এপ্রিল ২০২৫, বুধবার, ২৬ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

দেশ বিদেশ

সিপিডি’র তথ্য- ১১ জেলায় বন্যায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
৭ অক্টোবর ২০২৪, সোমবার

 দেশের পূর্বাঞ্চলের বন্যায় ১১ জেলায় ১৪ হাজার ৪২১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা বা প্রায় ১.২০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির এই অঙ্ক ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১.৮১ শতাংশের সমান। সবচেয়ে বেশি ৩৫ ভাগ ক্ষতি হয়েছে কৃষি ও অবকাঠামো খাতে। আর জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়েছে নোয়াখালীর। এ ছাড়া সরকারি খাতের চেয়ে বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বেসরকারি খাতে। দুর্গত জেলাগুলোর ৪৬ লাখ মানুষ এ দুর্যোগে ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন। রোববার রাজধানীর ধানমণ্ডিতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) কার্যালয়ে ‘পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া: সিপিডি’র বিশ্লেষণ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডি’র গবেষণা ফেলো মুনতাসির কামাল। উপস্থাপনা করেন সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
গত ১৯শে আগস্ট শুরু হওয়া এই বন্যা ক্রমাগত ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে আসা পানির প্রবাহে হয়েছিল। বন্যায় দেশের পূর্বাঞ্চলের ১১ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, খাগড়াছড়ি, কঙবাজার, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে সিপিডি এ তথ্য জানিয়েছে।
সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, আগস্ট মাসের মাঝামাঝিতে কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরসহ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যায় ১৪ হাজার ৪২১ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে, যা জিডিপি’র ০.২৬ শতাংশ। এরমধ্যে কৃষি ও বন খাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে, যার পরিমাণ ৫ হাজার ১৬৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এটি মোট ক্ষতির ৩৫.৮৫ শতাংশ। তিনি বলেন, অবকাঠামো খাতে ৪ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা ও ঘরবাড়িতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা। জেলা হিসেবে নোয়াখালীতে সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে। এ জেলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৪ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। এরপর আছে কুমিল্লা জেলা, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ফেনীতে ২ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা, চট্টগ্রামে ১ হাজার ৬৭৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, লক্ষ্মীপুরে ১ হাজার ৪০৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা, মৌলভীবাজারে ৫০৬ কোটি টাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৪৪ কোটি টাকা, হবিগঞ্জে ১৪৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, খাগড়াছড়িতে ১২৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা, কঙবাজারে ১০০ কোটি টাকা এবং সিলেট জেলার ২০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে হিসাব করেছে সিপিডি।
সিপিডি’র প্রতিবেদন বলছে, পূর্বাঞ্চলের ওই বন্যায় সামগ্রিকভাবে মোট ক্ষয়ক্ষতির ৫৩ শতাংশ হয়েছে বেসরকারি খাতে। আর ৪৭ শতাংশ হয়েছে সরকারি খাতে। সবচেয়ে বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়েছে নোয়াখালীতে ২৯.০৭ শতাংশ, কুমিল্লায় ২৩.৫১ শতাংশ, ফেনীতে ১৮.৬১ শতাংশ ও চট্টগ্রামে ১১.৬৩ শতাংশ। সিপিডি আরও বলছে, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও ফেনীতে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ক্ষতি হয়েছে।
সিপিডি’র গবেষণায় আরও দেখা গেছে, অবকাঠামো খাতে ক্ষতি হয়েছে ৪ হাজার ৬৫৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা বা ৩২.২৭ শতাংশ ও আবাসন খাতে ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার ৪০৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা বা ১৬.৬৯ শতাংশ।
গবেষণায় বলা হয়, এই ক্ষতির পরিমাণ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১.৮১ শতাংশ। জিডিপি’র নিরিখে, এটি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের খসড়া জিডিপি’র ০.২৯ শতাংশ ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য অনুমিত জিডিপি’র ০.২৬ শতাংশ। মোট ক্ষতির মধ্যে ২৮.৬৮ শতাংশ সড়কের, ২০.৯৯ শতাংশ শস্যের, ১৬.৬৯ শতাংশ আবাসনের, ১০.৯১ শতাংশ মৎস্যের এবং ৮.৫৩ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে অন্যান্য খাতে।
সিপিডি বলছে, ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর মধ্যে লক্ষ্মীপুরে মাথাপিছু সরকারি সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৬২ টাকা ১০ পয়সা, নোয়াখালীতে ৯২ টাকা ১০ পয়সা, কুমিল্লার মানুষ ১৩৬ টাকা ৭০ পয়সা ও সিলেটে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৩২০ টাকা।
সরকারি অর্থ বণ্টনে এমন ব্যবধান নিয়ে প্রশ্ন তুলে সিপিডি বলেছে, হয় এটা বণ্টনে সমস্যা, নয়তো তথ্য সংরক্ষণ পদ্ধতিতে বড় ধরনের ত্রুটি আছে।
সিপিডি’র গবেষক মুনতাসির কামাল বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে মাথাপিছু সাহায্যের ওই হিসাব তারা করেছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ত্রাণ হিসেবে চাল, খাবার, শিশুখাদ্য, পশু খাবার ও নগদ অর্থ সহায়তা দেয়ার তথ্য দিয়েছে। এই চারটি বিষয় নিয়েই প্রতিবেদনটি করেছে সিপিডি।
সংস্থাটি বলছে, বন্যায় নোয়াখালী জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সরকারি উদ্যোগে সবচেয়ে বেশি ত্রাণ গেছে ফেনী জেলায়, যার আর্থিক পরিমাণ ১৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা। 
ফেনীতে বন্যাদুর্গত মানুষের সংখ্যা ১০ লাখ, আর নোয়াখালীতে ১৬ লাখ চার হাজার ৩০০ জন। নোয়াখালীতে ত্রাণ গেছে ১৪ কোটি ৯০ লাখ টাকার, যা জেলাগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
কুমিল্লায় ১০ লাখ ৯০ হাজার মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; এ জেলা ১৪ কোটি ৯০ লাখ টাকার ত্রাণ সহযোগিতা পেয়েছে।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তিন জেলার মধ্যে ফেনীতে মাথাপিছু সহায়তার পরিমাণ ১৬৫ টাকা ৮০ পয়সা, কুমিল্লায় ১৩৬ টাকা ৭০ পয়সা, নোয়াখালীতে ৯২ টাকা ৯০ পয়সা।
অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত জেলা হবিগঞ্জে মাথাপিছু সহযোগিতার পরিমাণ ৬ হাজার ৪৫০ টাকা। এ জেলায় ২০ হাজার ৮৪০ জন বন্যাদুর্গত হয়েছিলেন। আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাথাপিছু সহযোগিতার পরিমাণ ১ হাজার ৮৪ টাকা, চট্টগ্রামে ৩ হাজার ৯৪৭ টাকা, আর সিলেটে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৩২০ টাকা।
ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ তুলে ফাহমিদা খাতুন বলেন, নোয়াখালীতে ১৬ লাখ ৪৩ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ৪ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। সে হিসাবে প্রতিজন মানুষ পেয়েছেন গড়ে প্রায় ৯৩ টাকা।
অথচ সিলেটে বন্যা দুর্গতের সংখ্যা সাড়ে ৯ হাজার, ক্ষতির পরিমাণ ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সেখানে ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৪ কোটি ৬০ লাখ টাকার। প্রতিজনে গড়ে ত্রাণ পেয়েছে ১৫ হাজার ৩২০ টাকা।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতার ঘাটতি ছিল। এ কার্যক্রমে জনপ্রতিনিধি থাকা দরকার ছিল কিনা তা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কোনো ব্যক্তি একাধিকবার ত্রাণ পেয়েছেন, আবার অনেকেই পাননি। এ ছাড়া অনেকেই ত্রাণসামগ্রী বিক্রি করে দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
সিপিডি’র রিসার্চ ডিরেক্টর খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সামনের দিনের দুর্যোগ সহযোগিতার যে কাঠামো, তাতে পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা মনে করি, দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রে সরকারের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি থাকা দরকার। তাদের কাজ হবে দুর্যোগের ফলাফল থেকে যেন মানুষেরা বেরিয়ে আসতে পারে, তেমন একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা।
এর আগে জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় অফিস (ওসিএইচএ) জানিয়েছে, দেশে গত চার মাসে (মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত) প্রাকৃতিক দুর্যোগে ১ কোটি ৮৩ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব দুর্যোগের মধ্যে ছিল ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা। সবচেয়ে বেশি ৫৯ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে সাম্প্রতিক বন্যায়। 
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক জরুরি শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) জানায়, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় অন্তত ৫৬ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ২০ লাখের বেশি শিশু স্বাস্থ্যগত ও মানসিক নানা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বন্যায় এখন পর্যন্ত ৫২ জনের বেশি মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

দেশ বিদেশ সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status