শরীর ও মন
চুল গজানোর চিকিৎসা নিয়ে কথা
অধ্যাপক ডা. এসএম বখতিয়ার কামাল
৬ অক্টোবর ২০২৪, রবিবারজরিপে প্রকাশ পুরুষরা ৩৫ বছরে পা দেয়ার সময় তাদের প্রায় ৪০% চুল পড়তে শুরু করে, ৮০ বছর বয়সে সেটি ৭০%-এ গিয়ে থাকে। মহিলাদের ক্ষেত্রে ৬০ বছর বয়সে চুল পড়ার পরিমাণ হয় প্রায় ৮০%। সৌভাগ্যবশত, ওষুধ ও প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতির ফলে আজ এর চিকিৎসা করে নতুন চুল গজানো সম্ভব। চুল পড়া ও পাতলা হয়ে যাওয়ার চিকিৎসা হিসেবে বিভিন্ন মাথায় লাগানোর টপিকাল সল্যুশন (ঃড়ঢ়রপধষ ংড়ষঁঃরড়হং), খাওয়ার ওষুধ ও নন-সার্জিক্যাল (হড়হ-ংঁৎমরপধষ) প্রক্রিয়া আছে।
প্লেটলেট সমৃদ্ধ প্লাজমা (পিআরপি) থেরাপি
প্লেটলেট সমৃদ্ধ প্লাজমা থেরাপি/পিআরপি (চষধঃবষবঃ জরপয চষধংসধ ঞযবৎধঢ়ু) এদের মধ্যে একটি জনপ্রিয় চিকিৎসা পদ্ধতি কারণ এটি নন-ইনভেসিভ (হড়হ-রহাধংরাব) ও ননু-সার্জিক্যাল (হড়হ-ংঁৎমরপধষ) এবং ধারাবাহিকভাবে ভালো ফল দেয়।
মেসোথেরাপি বনাম পিআরপি
মেসোথেরাপি দুদিক থেকে পিআরপির থেকে আলাদা: প্রথমত, এতে ইনজেকশনগুলো অনেক অগভীর (াবৎু ংঁঢ়বৎভরপরধষ)। তাছাড়া পিআরপি ইনজেকশনে প্লেটলেট ব্যবহৃত হয়, কিন্তু মেসোথেরাপি ইনজেকশনে ব্যবহৃত হয় তরলীকৃত (ফরষঁঃবফ) ওষুধ যেমন মিনক্সিডিল, ভিটামিন, বিভিন্ন নিউট্রিয়েন্ট (হঁঃৎরবহঃং) এবং গ্রোথ ফ্যাক্টর (মৎড়ঃিয ভধপঃড়ৎং)।
-পিআরপি ও মেসোথেরাপি দুটিই ১৯৭০-এর দশক থেকে শুরু করা হয়েছে। কিন্তু পিআরপির নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা হয়েছে অনেক বেশি। মেসোথেরাপি ১৯৭০ নাগাদ চালু হলেও এর নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা নিয়ে বৈজ্ঞানিক তথ্য এখনো অপ্রতুল। চর্মবিশেষজ্ঞরা মেসোথেরাপির থেকে পিআরপিকে বেশি কার্যকরী মনে করেন।
* পিআরপি মেসোথেরাপির তুলনায় কম সময়সাপেক্ষ, খরচের দিক দিয়েও সাশ্রয়কর।
* পিআরপি খুব নিরাপদ কারণ এতে ক্লায়েন্টের নিজের প্লেটলেট ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে মেসোথেরাপিতে বিভিন্ন উপাদানের মিশ্রণ ইনজেকশন দেয়া হয়, যার কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে।
* পিআরপি হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টের সঙ্গেও ব্যবহার করা যায় কিন্তু মেসোথেরাপি যায় না।
পিআরপি বনাম স্টেম সেল থেরাপি
প্লেটলেটের মতো স্টেম সেলও আহত ও প্রদাহশীল টিস্যু (ঃরংংঁব) সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে। স্টেম সেল শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী যে কোনো কোষে পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। এদের এই বহুমুখিতার জন্য এরা সম্প্রতি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মাথার চামড়ায় অর্থাৎ স্ক্যাল্পে (ংপধষঢ়) ইনজেকশন দিলে এই স্টেম সেল সেখানকার আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলোর স্থান অধিকার করে নেয়। অতএব, সাধারণভাবে যে টিস্যু সেরে উঠতে পারে না তাদের ক্ষেত্রে স্টেম সেল প্রয়োগ করা যেতে পারে। চুল পড়ার জন্য ব্যবহৃত পিআরপি ও স্টেম সেল থেরাপির প্রধান তফাৎগুলো হলো:
* পিআরপিতে প্লেটলেট রিচ প্লাজমা ক্লায়েন্টের নিজের দেহ থেকে নেয়া হয়। স্টেম সেল থেরাপিতে স্টেম সেল সংগ্রহ করা হয় গবেষণাগারে, ইঁদুরের লোম ও সবুজ আপেলের মরণশীল ভ্রূণ থেকে।
* ক্লায়েন্টের নিজের প্লেটলেট ও প্লাজমা ব্যবহার করার ফলে পিআরপি চিকিৎসা সাধারণত শরীর প্রত্যাখ্যান করে না। স্টেম সেল থেরাপিতে এই ঝুঁকি থাকে।
* যেহেতু পিআরপিতে সেন্ট্রিফিউজ (পবহঃৎরভঁমব) করার পর অবিলম্বে প্লেটলেটগুলো ইনজেকশন দিয়ে দেয়া হয়, তাই আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে এতে জীবিত প্লেটলেটের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে।
পিআরপি বনাম হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট একটি ইনভেসিভ সার্জিক্যাল প্রক্রিয়া যাতে মাথার স্ক্যাল্প থেকে এক ফালি চামড়া ও তার সংলগ্ন হেয়ার গ্রাফটগুলো (যধরৎ মৎধভঃং) (সাধারণত মাথার পাশের বা পেছনের দিকে থেকে নিয়ে) যেখানে চুল পড়ে গেছে সেখানে প্রতিস্থাপন করা হয়। অর্থাৎ স্ক্যাল্পের এক অংশ থেকে চুল নিয়ে অন্য অংশে সরিয়ে দেয়া হয়, যেখানে এই চুল নতুনভাবে গজাতেও পারে, বা নাও পারে।
তফাৎ হলো:
* পিআরপি নন-ইনভেসিভ ও নন-সার্জিক্যাল, এতে বড়জোর লোকাল অ্যানাস্থেসিয়া (ষড়পধষ ধহবংঃযবংরধ) দিয়ে অসাড় করা যেতে পারে। হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট তা নয়।
* হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টে স্ক্যাল্পের ত্বক হেয়ার গ্রাফটকে প্রত্যাখ্যান করে দিতে পারে, তাহলে এই চিকিৎসা বিফল হয়ে যাবে। পিআরপিতে ক্লায়েন্টের নিজের প্লেটলেট ব্যবহার হওয়ার ফলে এই সম্ভাবনা কম।
* এই দুটি প্রক্রিয়ার দুটি ভিন্ন ধরনের উপকারিতা আছে। যে জায়গায় চুল পড়ে টাক হয়ে গেছে এবং নতুন চুল আর গজানোর সম্ভাবনা নেই, সেখানে পিআরপির কার্যকারিতা কম, হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টই একমাত্র বিকল্প। পিআরপি কেবল হেয়ার ফলিকলকে উজ্জীবিত করে এবং স্ক্যাল্পের স্বাস্থ্য উন্নতি ঘটিয়ে পাতলা হয়ে যাওয়া ও প্রতিস্থাপিত চুলকে নতুনভাবে গজাতে সাহায্য করে।
পিআরপি চিকিৎসা বনাম মিনক্সিডিল
মিনক্সিডিল ওষুধটি খাওয়া যেতে পারে বা মাথায় লাগানো (ঃড়ঢ়রপধষষু ধঢ়ঢ়ষরবফ) যেতে পারে। চুল পড়ার চিকিৎসায় এর মাত্রা ও ব্যবহার পদ্ধতি একজন চর্ম বিশেষজ্ঞের থেকে জেনে নেয়া উচিত। মিনক্সিডিল একটি ধমনীপ্রসারক (াধংড়ফরষধঃড়ৎ)। পিআরপি ও মিনক্সিডিল দুটিই নতুন চুল গজানোর কার্যকরী চিকিৎসা, তবে স্টাডিতে প্রমাণিত হয়েছে যে একসঙ্গে পিআরপি ও মিনক্সিডিল ব্যবহার করলে শুধু মিনক্সিডিলের চেয়ে বেশি ভালো ফল হয়।
একটি স্টাডিতে ২০-৫০ বছর বয়স্ক পুরুষদের, যারা অ্যান্ড্রোজেনিক অ্যালোপেশিয়ায় (ধহফৎড়মবহরপ ধষড়ঢ়বপরধ) (অর্থাৎ বয়সজনিত চুল পড়া) ভুগছেন, তাদের দুটি দলে ভাগ করা হয়। একটি দলকে পিআরপি দিয়ে চিকিৎসা করা হয়, অন্যটিকে মিনক্সিডিল (৫-১০%) ব্যবহার করতে দেয়া হয়। ফলাফলে দেখা যায় যে পিআরপি দিয়ে চিকিৎসিত দলে ৭৬% ব্যক্তি লাভ পেয়েছেন, কিন্তু মিনক্সিডিল ব্যবহারকারী দলে মাত্র ৪৮% ব্যক্তি লাভ পেয়েছেন। বহু স্টাডি এই মতামতে উপনীত হচ্ছে যে পিআরপি ও মিনক্সিডিল মিলিতভাবে আরও ভালো ফল দেয়। সাধারণত, মিনক্সিডিলের সঙ্গে পিআরপি সংযুক্ত করে চিকিৎসা করা হয়।
পিআরপি বনাম ফিনাস্টেরাইড
ফিনাস্টেরাইড একটি ৫ আলফা রিডাক্টেজ এনজাইমের ইনহিবিটর (৫-ধষঢ়যধ ৎবফঁপঃধংব বহুুসব রহযরনরঃড়ৎ) যা পুরুষদের চুল পড়ার চিকিৎসায় ১ মি. গ্রা. ডোজে অনুমোদিত। মিনক্সিডিলের মতো এটিও মুখে খাওয়া যায় বা মাথায় লাগানো যায়।
প্রধান তফাৎগুলো হলো:
* ফিনাস্টেরাইড কেবল পুরুষদের জন্য অনুমোদিত, কিন্তু পিআরপি মহিলা ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই কার্যকরী।
* পিআরপি খুবই নিরাপদ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন। ফিনাস্টেরাইড সব সময় একা কাজ করে না। অল্প কিছু ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিবৃত হওয়ার ফলে অনেকে এই ওষুধটি নিতে সংকোচবোধ করেন।
চুল পড়ার জন্য পিআরপি বনাম লেজার
* পিআরপিতে ক্লায়েন্টের রক্তের প্লেটলেট ব্যবহৃত হয়; এই প্লেটলেট সেন্ট্রিফিউজ ও সক্রিয় করে ইনজেকশন দেয়া হয়, এতে গ্রোথ ফ্যাক্টর তৈরি হয়ে চুল পড়া কমায় ও চুলের বৃদ্ধি ঘটায়। লেজার চিকিৎসায় একটি বিশেষ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (ধিাবষবহমঃয) আলো স্ক্যাল্পের সংশ্লিষ্ট অংশে ফেলে সেখানকার রক্ত চলাচল বাড়িয়ে চুল পড়া কমানোর চেষ্টা করা হয়।
* লেজার ত্বকের প্রদাহ কমাতে পারে ও চুলের কোষে এনার্জি (বহবৎমু) (এটিপি) সরবরাহ বাড়াতে পারে। অন্যদিকে পিআরপি চুলের কোষকে উজ্জীবিত করে বিভিন্ন গ্রোথ ফ্যাক্টর সরবরাহ করে।
* তুলনামূলকভাবে দেখলে দুটি চিকিৎসা পদ্ধতি একইভাবে চুল পড়া প্রতিরোধ করে স্ক্যাল্পে রক্ত চলাচল বাড়িয়ে দেয়। তবে প্লেটলেট রিচ প্লাজমা অনেক তাড়াতাড়ি ফলাফল দেয়।
লেখক: চিফ কনসাল্ট্যান্ট কামাল হেয়ার অ্যান্ড স্কিন সেন্টার।
চেম্বার: বিটিআই সেন্ট্রা গ্রান্ড, দ্বিতীয় তলা, গ্রীন রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। প্রয়োজনে- ০১৭১১৪৪০৫৫৮