ঢাকা, ১১ অক্টোবর ২০২৪, শুক্রবার, ২৬ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ রবিউস সানি ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

সন্তানকে খুঁজতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ বাবা দুর্বিষহ জীবন

ফাহিমা আক্তার সুমি
২ অক্টোবর ২০২৪, বুধবারmzamin

পঞ্চান্ন বছর বয়সী হামিদ আলী। ফেরি করে হাঁড়ি-পাতিল বিক্রি করতেন। পরিবার নিয়ে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাইনদী নতুন মহল্লার একটি বাসায় 
ভাড়া থাকেন। ২০শে জুলাই শনিবার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চালাকালীন সময়ে বিকালে সন্তানের খোঁজে যান। এ সময় চারিদিকে ভয়াবহ গোলাগুলি চলছিল। উপর থেকে টহল দিচ্ছিল হেলিকপ্টার। ঢাকা-চিটাগাং রোডের মূল সড়কে ওঠার আগেই একটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় হামিদের হাতে। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে স্বজনরা হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে তার হাতে একটি অপারেশন হয়। জীবনে বেঁচে ফিরলেও অচল হয়েছে হামিদের বাম হাতটি। অচল হাত নিয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটছে তার। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি।

হামিদ আলী মানবজমিনকে বলেন, পেটের মধ্যে গুলিটা বিদ্ধ হলে হয়তো আমি আর বেঁচে ফিরতাম না। আমার সংসারে আমিই ছিলাম একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে আমার সংসার। সতেরো বছর বয়সী একমাত্র ছেলে অন্তরকে খুঁজতে গিয়ে আমার হাতে গুলি লাগে। সে আগে বেকার ছিল। আমি অসুস্থ থাকায় সংসার চলে না দেখে একটি পাখির দোকানে কাজ শুরু করেছে। আমি ঘুরে ঘুরে ফেরি করে হাঁড়ি-পাতিল বিক্রি করতাম। এখানে চার হাজার টাকা দিয়ে টিনের চালের একটি রুম ভাড়া করে থাকি। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মেঘনা থানায়। অভাবের কারণে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ঢাকায় চলে আসি। পাঁচ বছর ধরে থাকি ঢাকায়। গ্রামে কোনো জায়গা-জমি নেই যে কিছু উপার্জন করে সংসারের খরচ চালাবো। আমার স্ত্রী বাসা বাড়িতে কাজ করেন। সে শারীরিক প্রতিবন্ধী, চোখে কম দেখে। প্রায় ৮০-৯০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এই হাত আবার অপারেশন করে সোজা করতে হবে। হাতের রগ কাটায় বাঁকা হয়ে থাকে সবসময়। চিকিৎসক বলেছেন আরেকটি অপারেশন করা লাগবে। তবে কখনো সচল হবে কিনা সেটির নিশ্চয়তা নেই।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ২০শে জুলাই আমার ছেলে প্রতিদিনের মতো আন্দোলনে যায়। সেদিন বাইরের পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ ছিল। চারদিকে বৃষ্টির মতো গুলি। হেলিকপ্টার থেকেও ছোড়া হচ্ছিল গুলি। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। নিজের জীবনের মায়া ভুলে সন্তানের খোঁজে বিকাল পাঁচটার দিকে বাইরে যাই। ঢাকা-চিটাগাং রোডে উঠতে না উঠতেই একটি গুলি এসে আমার হাতে লাগে। প্রথমে আমাকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যায় মানুষ। পরে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে একটি এক্সেরে করা হয়। রিপোর্টে দেখা যায় হাত ঠিক আছে। পরে সেখান থেকে চিকিৎসকরা অন্য হাসপাতালে যেতে বলেন। সেখানে হাতের একটি অপারেশন হয়। হাতের রগ কেটে ফেলতে হয়। গুলিটা হাতে লাগার পর পেট ঘেঁষে চলে যায়। পেটে খুব একটা ক্ষত না হলেও হাতের পরিস্থিতি খারাপ হয়। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল। সেদিন আমার সামনে কয়েকজন মারা গিয়েছে। ভেবেছিলাম তাকে বাসায় নিয়ে আসি না হলে কিনা কী হয়। রাজু নামে পাশের বাসার একজন মারা গেছে তাকে আমি ছেলেকে খুঁজতে যাওয়ার আগে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ধরে নিয়ে আসি।

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনদী নতুন মহল্লার ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে তার স্ত্রী রিনা বেগম চোখেমুখে হতাশা নিয়ে দরজার সামনে বসে আছেন। ঘরের ভেতরে বিছানায় শুয়ে হাতের ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন হামিদ। সেখানে দুই সন্তানকে নিয়ে টিনের চালের একটি রুমে ভাড়া থাকেন। হামিদ আলীর স্ত্রী রিনা বেগম বলেন, ঘটনা শুনে গিয়ে দেখি তার হাতের অবস্থা খুবই খারাপ। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল জামা-কাপড়। এটি দেখে আমি ভেবেছিলাম সে আর বাঁচবে না। আমার স্বামীর জীবনটা ফিরে পেয়েছে। রাত হলে তার হাতের মধ্যে অনেক জ্বালা-যন্ত্রণা করে। মেডিসিন খেয়ে ব্যথা কমাতে হয়। দুইটা আঙ্গুল ছাড়া পুরো হাতটিই অচল। হাতটি সোজা করতে পারে না সবসময় বাঁকা হয়ে থাকে। যখন হাতের মধ্যে ব্যথা শুরু হয় তখন সহ্য করতে না পেরে বটি নিয়ে হাত কেটে ফেলতে যায়। ঘর থেকে দা-বটি লুকিয়ে রাখতে হয়েছে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটায় সেজন্য। বাসা-বাড়িতে মাঝে মাঝে কাজ করি। একমাত্র ছেলেকে একটি পাখির দোকানে কাজ দিয়েছি। আমি নিজে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। আমার একটা কার্ড করতে পারলে অনেক ভালো হতো। এখনো অনেক ওষুধ খেতে হয়। আরেকটি অপারেশন করতে হবে। আমার স্বামীর এক হাত তো অচল হয়ে কখনো ঠিক হবে কিনা জানি না। কীভাবে চলবে আমাদের সংসার।  
 

পাঠকের মতামত

যাদের জীবনের বিনিময়ে এই নূতন বাংলাদেশ পেলাম এবং অনেকের অংগহানী হয়েছে অনেকে কষ্টে জীবন যাপন করছেন তাদের চিকিৎসা এবং তাদেরকে সহায়তা সহযোগিতা না করলে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাবে।

ডাঃ মীর মাহমুদ হোসেন
২ অক্টোবর ২০২৪, বুধবার, ৩:১১ অপরাহ্ন

সরকার কে অবশ্যই দায়িত্ব নিতে হবে।

রহমান
২ অক্টোবর ২০২৪, বুধবার, ১০:৩১ পূর্বাহ্ন

সরকার, এঁদের ভুলে যাবেন না প্লিজ - ইনি কী আপনাদের লিস্টে আছেন? কোন সাহায্য কী পেয়েছেন?

Towhidul HASSAN
২ অক্টোবর ২০২৪, বুধবার, ৭:৫৩ পূর্বাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status