প্রথম পাতা
ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সংকটে ব্যাংকিং খাত
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২৩ জুলাই ২০২৪, মঙ্গলবার
টানা ৩দিন ধরে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় ভেঙে পড়েছে ব্যাংকিং খাত। ব্যাংকে স্বাভাবিক লেনদেন রুদ্ধ। অনেক ডিজিটাল আর্থিক সেবা প্রায় বন্ধ। বেশির ভাগ এটিএম বুথের সেবা অচল। ইন্টারনেটনির্ভর বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনে বাংলাদেশ কার্যত বিচ্ছিন্ন। আমদানি-রপ্তানি বন্ধ। অর্ডার নিয়ে বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে যোগযোগ বন্ধ। থমকে আছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। ব্যাংক বন্ধ শেয়ারবাজারের লেনদেনও হচ্ছে না। এর মধ্যে সরকারের নির্বাহী আদেশে দফায় দফায় বাড়ছে সাধারণ ছুটি। অনিদির্ষ্টকালের জন্য চলছে কারফিউ। ফলে মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়েছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। দেশের এমন প্রেক্ষাপটে দ্রুত একটি সমাধানের পথ বের করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
একাধিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, দেশের ব্যাংকগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পুরোপুরি ইন্টারনেটনির্ভর। বিদেশি ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জগুলোর মাধ্যমে প্রবাসীরা বৈধ পথে দেশের ব্যাংকগুলোয় রেমিট্যান্স পাঠান। আন্তর্জাতিক লেনদেন সিস্টেম সুইফটের মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্সের বার্তা বিটিআরসি গেটওয়ে হয়ে দেশে আসে। ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে সেসব বার্তা নিশ্চিত করা হলে তবেই ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টে রেমিট্যান্সের অর্থ জমা হয়। কিন্তু ইন্টারনেট না থাকায় রেমিট্যান্স আসা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া আমদানি-রপ্তানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার জন্য বিদেশি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ই- মেইলসহ বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হয়। এক্ষেত্রে ই-মেইলে প্রয়োজনীয় নথিপত্রও পাঠাতে হয়। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বিদেশি ব্যাংক ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এতে নতুন কোনো এলসি খোলা যাচ্ছে না।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বলেন, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় আমরা আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন। আমদানি-রপ্তানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার জন্য আমরা বিদেশি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। প্রতিদিন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়। বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে বাংলাদেশ। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সেটা হাত ছাড়া হচ্ছে। কারফিউয়ের মধ্যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে হলে কর্মীদের বিশেষ ব্যবস্থায় উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। ইন্টারনেট বন্ধের সিদ্ধান্ত দীর্ঘায়িত হলে দেশের অর্থনীতির পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক করার দাবি জানান তিনি।
ইন্টারনেট সার্ভিস বন্ধ থাকায় ব্যাংকগুলোর ডিজিটাল সেবার অনলাইন লেনদেন বন্ধ রয়েছে। বেশির ভাগ গ্রাহক এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলন করতে পারছেন না।
মগবাজারের বাসিন্দা মনিরুল ইসলাম বলেন, আমার যে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রয়েছে সেই ব্যাংকের এটিএম বুথ কাজ করছে না। হাতে নগদ টাকা যা ছিল তা শেষ। বাড়ির বিদ্যুৎ বিল দিতে হবে, এখন কীভাবে দেবো ভেবে পাচ্ছি না।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ছাত্রদের আন্দোলন শুরুর আগে হাতে কিছু নগদ টাকা ছিল। সেই টাকাও শেষ। ব্যাংক থেকে টাকা তুলবো কিন্তু সরকারের সাধারণ ছুটির কারণে ব্যাংকও বন্ধ।
এদিকে ইন্টারনেট সার্ভিস বন্ধ থাকায় আর্থিক ডিজিটাল সেবা পেতে সমস্যা হচ্ছে। যেসব ব্যাংকের এটিএম সেবা লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক বা ল্যান দিয়ে চলছে, সেগুলো চালু আছে। অন্যদিকে যেসব এটিএম ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে চলে সেগুলো অচল হয়ে পড়েছে।
পাশাপাশি বেশির ভাগ পয়েন্ট অব সেলসও (পিওএস) অকার্যকর হয়ে গেছে। অনেক ব্যাংক গ্রাহকদের কাছে মেসেজ পাঠিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছে। অনেক ব্যাংক জানিয়েছে, তাদের এটিএম সেবা চালু আছে। তবে ইন্টারনেট না থাকায় অ্যাপনির্ভর সেবা পুরোপুরি বন্ধ।
এদিকে বিকাশ, নগদ, উপায় ও এমক্যাশ-এর মতো এমএফএস গ্রাহকদের অনেকেই এখন অ্যাপনির্ভর হয়ে পড়েছেন। ইন্টারনেট না থাকায় এসব গ্রাহক সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন। এসব গ্রাহক আর্থিক লেনদেন করতে পারছেন না। ইন্টারনেট না থাকায় ব্যাংক থেকে এমএফএস-এ অর্থ স্থানান্তর বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এমএফএস সেবার গ্রাহকরা আগের মতো নম্বর চেপে ইউএসএসডি’র মাধ্যমে সেবা নিতে পারছেন। বিকাশে *২৪৭#, নগদে *১৬৭# চেপে সেবাটি নিতে পারছেন। কিন্তু সবাই এভাবে সেবা নেয়ার চেষ্টা করায় এতে সেবাটি পেতে ভোগান্তি তৈরি হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মুনসুর বলেন, কারফিউ বেশিদিন চলতে পারে না। অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, করোনাকালীন বাসায় বসে কাজ করার সুযোগ ছিল। কিন্তু এখন সে সুযোগও নেই। এর দ্রুত সমাধান দরকার।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি রেজোয়ানুল রহমান বলেন, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রপ্তানি এখন হুমকির মুখে। রপ্তানির বাজার আগে থেকেই নিম্নমুখী ছিল। বর্তমান পরিস্থিতি আরও ঘি ঢেলে দিয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বিদেশি ক্রেতা ও ব্র্যান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। পণ্য জাহাজীকরণের তারিখ পার হয়ে গেলে তারা পণ্য নিতে চাইবেন না। তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো- ক্রেতাদের দেশের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও তারা অন্য দেশে রপ্তানির অর্ডার দিতে পারেন। জাতীয় স্বার্থে বর্তমান পরিস্থিতির সমাধান চান এই ব্যবসায়ী নেতা।