অনলাইন
বার্ধক্যের মুখে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ এশিয়ার একাধিক দেশ
মানবজমিন ডিজিটাল
(১১ মাস আগে) ১২ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার, ২:৩৫ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৩:৫৫ অপরাহ্ন

বাংলাদেশের ঢাকার একজন ৫২ বছর বয়সী ক্যাফে ম্যানেজার জহিরুল ইসলাম সারাজীবন তার পরিবারকে সহায়তা করার জন্য কাজ করেছেন। সেইসঙ্গে বার্ধক্যের জন্য সামান্য কিছু সঞ্চয় করেছেন। অবসর গ্রহণের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ইসলাম আর হয়তো সাত -আট বছর কাজ করতে পারবেন। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এরপর হয়তো কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে’। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বয়স্ক জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে আট বছর পর জহিরুল ইসলাম ৬০ বছরে পা দেবেন। সামান্য সঞ্চয় এবং পেনশন না থাকায় মেগাসিটিতে তার সন্তানদের ওপর নির্ভর না করে স্ত্রীর সঙ্গে গ্রামে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন তিনি। আসলে সন্তানদের কাছে বোঝা হতে চান না জহিরুল এবং তার স্ত্রী। জহিরুল ইসলামের বার্ধক্যের উদ্বিগ্নতা লাখ লাখ প্রবীণ দক্ষিণ এশীয়দের সংগ্রামকে প্রতিফলিত করে। যাদের কোনও সঞ্চয়, আয়, সামাজিক নিরাপত্তা বা স্বাস্থ্য বীমা নেই।আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা সমন্বিত দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলটিতে যুবারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে চালিত করে, তবুও বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এই অঞ্চল জুড়ে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা এবং শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিছু ক্ষেত্রে আবার দ্রুতহারে।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো সতর্ক করছে যে, উন্নয়নশীল এশীয় দেশগুলো তাদের দ্রুত বার্ধক্য জনসংখ্যার জন্য যথেষ্ট কাজ করছে না। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ অ্যালবার্ট পার্ক মহাদেশের বার্ধক্য জনসংখ্যার উপর একটি সাম্প্রতিক ওয়েবিনার আলোচনার সময় বলেন, ‘আমি মনে করি এশিয়ার বয়স্ক ব্যক্তিদের নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা একটি অত্যন্ত জরুরি নীতিগত চ্যালেঞ্জ’।
এশিয়ার জনসংখ্যার বার্ধক্যগত সমস্যা নিম্ন আয়ের জনসংখ্যার মধ্যে বিশেষভাবে পরিলক্ষিত, যখন উন্নত অর্থনীতি একই ধরনের জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের মুখোমুখি। এডিবি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘এই অঞ্চল জুড়ে একটি বড় উদ্বেগ হলো- বয়স্ক জনসংখ্যাকে পর্যাপ্তভাবে সমর্থন করার জন্য ব্যবস্থা নেয়ার আগেই সমাজকে বার্ধক্য গ্রাস করবে। সঠিক নীতি ও কর্মসূচির সাথে এই প্রবণতা ঠেকানো যেতে পারে’।
এডিবি এবং অন্যান্য সংস্থাগুলো ৬০ বা ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সের লোকদের শতাংশের হিসাব করে জনসংখ্যার বার্ধক্য পরিমাপ করে। একটি জনসংখ্যাকে প্রায়শই ‘বার্ধক্য’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যখন তার ৬৫ বছর বা তার বেশি বার্ধক্যগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ৭% ছাড়িয়ে যায়, ১৪ % বা তার বেশি হলে বলা হয় ‘বয়স্ক’ এবং যখন এটি ২০ % এর উপরে পৌঁছে যায় তখন বলা হয় ‘অতি বয়স্ক’।
বিশ্বের ১৪ শতাংশ
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল অনুসারে, বিশ্বব্যাপী ২০২২ সালে ৬০ বা তার বেশি বয়সী ১.১ বিলিয়ন লোক ছিল, যা বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ১৪% প্রতিনিধিত্ব করে। ২০৫০ সালের মধ্যে সংখ্যাটি দ্বিগুণ হয়ে ২.১ বিলিয়ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা মোট বিশ্ব জনসংখ্যার ২২%। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এশিয়ায় অনুরূপ বৃদ্ধি জরিপ করেছে। তাদের দাবি ১.২ বিলিয়ন বয়স্ক লোক বা জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশের জন্য স্বাস্থ্য ও সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচিতে বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা ‘উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে’। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ এবং শ্রীলঙ্কায় ২০৫০ সালের মধ্যে বয়স্ক লোকদের সংখ্যা ২০% এর বেশি থাকবে। শুধুমাত্র আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানে বয়স্ক জনসংখ্যা তুলনামূলকভাবে ১০% এর কম থাকবে।
জাতিসংঘের মতে, জনসংখ্যার বার্ধক্য শুধুমাত্র দক্ষিণ এশিয়ায় সীমাবদ্ধ নয়। মধ্য এশিয়ায়, বয়স্ক মানুষের সংখ্যা , বর্তমানে ১০%-এর কম সেটি গড়ে ১৫%-এ উন্নীত হবে, যা এই অঞ্চলের জনসংখ্যাকে ‘বার্ধক্য’ থেকে ‘বয়স্ক’তে উন্নীত করবে। তুরস্কে এই হার গত বছর প্রথমবারের মতো ১০% শীর্ষে ছিল, সেইসঙ্গে বেড়েছিল উদ্বেগ। কারণ দেশটি তার বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য প্রস্তুত নয়। এজিয়ান জেরিয়াট্রিক্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মেভলুট উলগেন বলেছেন, ‘তুরস্কে বয়স্ক মানুষের জন্য বীমা ব্যবস্থাকে বোঝা হিসাবে দেখা হয়। আর তাই তুরস্কের সমাজতাত্ত্বিক এবং জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্থানীয় এবং জাতীয় উভয় পর্যায়েই অধিকার-ভিত্তিক বার্ধক্য নীতিগুলো বাস্তবায়ন করা দরকার’।
দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া জুড়ে জনসংখ্যার পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক প্রবণতা অনুসরণ করে: সেখানে স্বাস্থ্যসেবা, চিকিৎসা পরিষেবা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রগতি হচ্ছে। তা সত্ত্বেও মানুষ দীর্ঘজীবী হয়।
আয়ু বাড়ছে , কমছে জন্মহার
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বাংলাদেশের গড় আয়ু প্রায় ৪৭ থেকে বেড়ে ৭২-এর উপরে পৌঁছেছে। ইতিমধ্যে, দেশটির প্রজনন হার কমেছে। আগে নারী প্রতি সন্তান জন্মের হার ছিল সাত, এখন তা দুইয়েরও কম। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ নয় যেখানে বয়স্ক জনসংখ্যা রয়েছে। শ্রীলংকায়, জনসংখ্যার ১৭% এরও বেশি ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী। এই পরিসংখ্যান দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলংকাকে সবচেয়ে বেশি 'বয়স্কদের দেশ' করে তুলেছে। বিশ্বের বৃহত্তম যুব জনসংখ্যার আবাসস্থল ভারতেও বার্ধক্য বাড়ছে। ৬০ বা তার বেশি বয়সী ভারতীয়দের সংখ্যা গত তিন দশকে প্রায় তিনগুণ বেড়ে ১৫০ মিলিয়নেরও বেশিতে পৌঁছেছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ভয়েস অফ আমেরিকার সাথে একটি সাক্ষাৎকারে এজওয়েল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারপার্সন হিমাংশু রথ উল্লেখ করেন, ‘ভারতে ‘সবচেয়ে বয়স্ক’ লোকের সংখ্যা - যাদের বয়স ৮০ বা তার বেশি- তাদের সংখ্যাও বাড়ছে, যার ফলে অনেককেই কয়েক দশক ধরে আয়, পেনশন বা পারিবারিক সহায়তা ছাড়াই বাঁচতে হবে। যখন মানুষ ৮০ থেকে ৯০ বছরের বেশি বাঁচে তখন অনেক ক্ষেত্রেই পরিবার তাদের পরিত্যাগ করে। বয়স্ক ব্যক্তিদের যত্ন নেওয়া ক্লান্তিকর। সন্তানেরা তাদের বৃদ্ধ বাবা-মায়ের যত্ন নেওয়া নিয়ে হতাশ এবং বিরক্ত বোধ করে। '
প্রবীণদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা
এজওয়েল ফাউন্ডেশন বলছে, তাদের লক্ষ্য হলো ‘বয়স্কদের করুণার সাথে দেখার মানসিকতা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে’। ৮০,০০০ স্বেচ্ছাসেবকদের একটি নেটওয়ার্কের সাথে গ্রুপটি প্রবীণদের চিকিৎসা ও আইনি পরামর্শ প্রদান করে এবং তাদের দ্বিতীয় চাকরি খুঁজে বের করতে সাহায্য করে। হিমাংশু রথ বলছেন, ‘প্রতিটি সমাজে এবং সমস্ত পরিস্থিতিতে আমাদের বয়স্ক মানুষদের সম্মান দিতে হবে। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে’। আয় ও পেনশনের অভাব থেকে শুরু করে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা পর্যন্ত ভারতে বয়স্ক মানুষেরা অগণিত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, এশিয়া জুড়ে এই সমস্যাগুলো বেড়ে চলেছে। এডিবি রিপোর্ট অনুসারে, উন্নয়নশীল এশীয় দেশগুলোতে বয়স্ক মানুষদের ৪০% -এর পেনশনের কোনও অ্যাক্সেস নেই, ৬০ % নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা পান না এবং ৪৩% -এর দীর্ঘমেয়াদী যত্নের অভাব রয়েছে। এডিবির প্রধান অর্থনীতিবিদ পার্ক বলেন, ‘আমি মনে করি এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। সরকার সেই সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে পারে। কারণ সময়ের সাথে সাথে সমাজ একটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে’।
আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার দুটি সর্বকণিষ্ঠ জনসংখ্যার দেশ যার গড় বয়স যথাক্রমে ১৭ এবং ২০ বছরের বেশি। তরুণ জনসংখ্যার দেশগুলোকে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে পার্ক সতর্ক করে বলেছেন যে, ‘তাদের এখন থেকেই সতর্ক হতে হবে। মনে রাখতে হবে দেশে বয়স্ক জনসংখ্যা বাড়ার আগে তাদের হাতে প্রস্তুতির জন্য এখনো কিছুটা সময় আছে’।
সূত্র : ভয়েস অফ আমেরিকা
পাঠকের মতামত
আমাদের দুঃখ একটাই গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা না থাকা ।
পাকিস্তানের শোষনে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু কম ছিল, ধীরে ধীরে গড় আয়ু বেড়ে ৭২। এটাই আমাদের স্বাধীনতার সুফল। যাই হোক উন্নত দেশের মানুষের গড় আয়ু ও তদ্রুপ। এসব দেশে অবসর গ্রহণের বয়স ও ৬০ এর পর, কেউ কেউ ৬৫ বছর পর্যন্ত কাজ করে যায়। এর দুটি কারণ: ১। অবসর বা বেকার জীবন থেকে মুক্তির জন্য। ২। আর্থিক প্রয়োজনে । অবসর ভাতায় সংসার চলে না। দ্রব্যমূল্য বেড়েছে । বিশেষ করে ঘর ভাড়া আকাশচুম্বী । বাংলাদেশে অন্তত ঘর ভাড়া সীমিত। তা ছাড়াও প্রতিটি লোকের পৈতৃক ভিটাতে ঘর করে থাকতে পারে, বিলাসবহুল না হলেও। আমি ৭৩ বছরেও কাজ করছি । উন্নত দেশের মানুষ অবশ্য বয়সের তুলনায় কর্মক্ষম, সুস্থ সবল থাকে ।