অনলাইন
চট্টগ্রামের আতুরার ডিপো চামড়ার আড়তের সেই জৌলুস আর নেই
স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে
(১ সপ্তাহ আগে) ১৬ জুন ২০২৪, রবিবার, ১:০৫ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:০১ অপরাহ্ন
![mzamin](uploads/news/main/114645_ctg.webp)
চট্টগ্রাম নগরের আতুরার ডিপো। পুরো চট্টগ্রামের গরু-ছাগলের চামড়ার প্রায় ৮০ শতাংশ এখানকার আড়তে সংরক্ষণ করা হয়। এক সময় চট্টগ্রামের মোট ২২ টি ট্যানারি এই আড়তগুলোর উপর নির্ভর করে চলতো। তবে সময়ের সাথে সাথে জৌলুস হারিয়েছে এখানকার আড়তগুলো। প্রায় দেড় শতাধিক আড়তের মধ্যে এখন মাত্র ১২ টি অবশিষ্ট আছে। একইসাথে বন্ধ হয়ে গেছে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ২১ টি ট্যানারি। এখন মাত্র একটি ট্যানারির কার্যক্রম চলছে। ২০১৮ থেকে ২০২০ সালে চট্টগ্রামে কোরবানির পশুর চামড়া বেচাকেনায় চরম বিপর্যয় দেখা দেয়। সেসময় বিক্রি করতে না পেরে মৌসুমি ব্যবসায়ী ও কোরবানি দাতারা পথেঘাটে হাজার হাজার চামড়া ফেলে দিয়েছিলেন। এরপর থেকে চট্টগ্রামে চামড়া শিল্পে ধ্বস নামে।
হাশেম স্টোরের মালিক আবুল হাশেম নামে এক চামড়া ব্যবসায়ী মানবজমিনকে বলেন, ১৯৪৫ সালে আতুরার ডিপোতে চামড়া শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। বর্তমানে একটি ছোট্ট আড়ত আছে তার। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার বাসিন্দা এই বৃদ্ধ বলেন, এক সময় এখানে প্রায় শতাধিক আড়ত ছিল। এই আড়তের উপর নির্ভর করে চট্টগ্রামের ট্যানারিগুলো চলত। ঢাকার অনেক ট্যানারিও এই আতুরার ডিপোর উপর নির্ভরশীল ছিল। তবে এখন আমাদের সেই অবস্থা আর নেই। বিভিন্ন সময় লস খেতে খেতে সর্বস্বান্ত হয়ে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন সবাই। বিশেষ করে ২০১৫ সাল থেকে আমাদের ব্যবসায় ধ্বস নামে। আর ২০১৮-২০ সালে চূড়ান্ত সর্বনাশ হয়েছে। বিশেষ একটি সিন্ডিকেট এই ব্যবসা শেষ করে দিয়েছে। তবুও অনেক কষ্ট করে আমরা এখনও টিকে আছি।
হাশেম বলেন, সাধারণত বিভিন্ন মৌসুমি সংগ্রহকারী, এতিমখানা ও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ চামড়া সংগ্রহ করে এখানে নিয়ে আসেন। আর আমরা সেগুলো সংরক্ষণ করে পরে ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করি। চট্টগ্রামে এক সময় ২৩ টি ট্যানারি ছিল। সেগুলোতে আমরা মাল দিতাম। এখন আমাদের ব্যবসা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ট্যানারিগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন রিপ লেদার নামে একটা মাত্র ট্যানারি আছে চট্টগ্রামে। সেটাও এখানকার মাত্র দুইজন থেকে চামড়া নিচ্ছে। তারা এলডব্লিউজি'র (লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ) সনদের কথা বলে বাকিদের কাছ থেকে চামড়া নেয় না। ফলে বিভিন্ন ভোগান্তি নিয়েই আমাদেরকে ঢাকার ট্যানারিতে চামড়া দিতে হয়। আর তারা বিভিন্ন অজুহাতে আমাদের টাকা আটকে রাখে।ফলে পুঁজি হারিয়ে আড়তদাররা এই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন।
আরেক আড়তদার সুমন ট্রেডার্সের মালিক মোহাম্মদ সুমন বলে, এবার সরকার ঢাকার জন্য প্রতি ফুট ৬০ টাকা ও আমাদের জন্য ৫০ টাকা চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু ট্যানারি মালিকরা সেটা ৪০ টাকাও দেন না।আর পেমেন্ট কিছু বকেয়া রেখে দেয়। আগের বছরগুলোতে ঢাকার ট্যানারিগুলোর কাছে বিক্রি করা চামড়ার প্রায় ১০ কোটি টাকার মতো এখনও বকেয়া। এসব টাকা আদায়েই আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। আর আমাদেরকে তো মৌসুমি ব্যবসায়ী ও এতিমখানা -মাদ্রাসা থেকে নগদে চামড়া কিনতে হয়।
তিনি বলেন, এখন ৭৪ কেজি একটি লবণের বস্তা কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ২০ টাকায়। গতবার সেটার দাম ছিল ৮০০ টাকা। কিন্তু গতবারের চেয়ে এবার চামড়ার দাম বাড়েনি। প্রতিটি চামড়ায় ৯ থেকে ১০ কেজি করে লবণ দিতে হয়। একটি কাঁচা চামড়া কেনার পর সেটিকে বিক্রির উপযোগী করতে আরও ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা খরচ করতে হয়। এখন সরকার অন্তত এই সময়ে লবণে বিশেষ ভর্তুকি দিতো, তাহলে আমরা কিছুটা উপকৃত হতাম।
চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ মাহবুব বলেন, আড়তদাররা ভালো থাকলে শ্রমিকরাও ভালো থাকে। কিন্তু দিন দিন বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে আড়তদাররা ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন। ফলে বেকার হয়ে যাচ্ছেন শ্রমিকরা। আগে কুরবানির মৌসুম ছাড়াও নিয়মিত এখানে ৩-৪ শত শ্রমিক কাজ করতো। আর এখন সেই সংখ্যা ৪০-৫০ জনে দাঁড়িয়েছে। তবে কুরবানির সময় একসাথে কয়েক হাজার মানুষ কাজ করে।
তিনি বলেন, সরকার চামড়া শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিশেষ কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। বিভিন্ন সময় শুনি, আমাদেরকে প্রণোদনা দেয়া হবে। কিন্তু সেই প্রণোদনা আর আমরা পাইনা। আর কারা পায় সেটাও জানি না। প্রণোদনা না পায়,অন্তত চামড়ার ন্যায্য মূল্য পেলে তো হয়।
এদিকে এতো সব প্রতিবন্ধকতার পরও চামড়া ব্যবসাকে বাঁচিয়ে রাখা আতুরার ডিপোর আড়তদাররা আগামীকালের ঈদুল আযহার চামড়া সংগ্রহের জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছেন ৩০-৪০ জন মৌসুমি আড়তদার। সব মিলিয়ে এবার আতুরার ডিপোতে প্রায় অর্ধশত আড়তদার কুরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণে যুক্ত হচ্ছেন। এবার এই আড়তে সাড়ে ৩ লাখ চামড়া সংরক্ষণের পরিকল্পনা নিয়েছেন তারা।
চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুর মোহাম্মদ বলেন, এবার আতুরার ডিপোর আড়তে কমপক্ষে সাড়ে ৩ লাখ চামড়া সংরক্ষণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সরাসরি কোরবানি দাতা এবং মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে এগুলো এখানে আসবে। আর এবার কোরবানির পশুর চামড়া প্রক্রিয়াজাতের জন্য লবণ কিনতে হচ্ছে চড়া দামে।এ কারণে এবারও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা খুব একটা লাভের প্রত্যাশা করতে পারছেন না। আমরা সরকারের কাছ থেকে বিশেষ সহযোগিতা চাচ্ছি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মুসলিম উদ্দিন মানবজমিন’কে বলেন, একসময় দেশের সবচেয়ে বেশি ট্যানারি ছিল চট্টগ্রামে। আতুরার ডিপোর এই আড়তই ছিল এখানকার একমাত্র চামড়া সংরক্ষণ সেন্টার। আতুড়ার ডিপোতে চামড়া ব্যবসায় জড়িত ছিল প্রায় ১৫০ জন আড়তদার। আর চামড়া সম্পর্কিত পেশায় সম্পৃক্ত ছিল প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। আর এখন ধীরে এটা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এখন এখানে নিয়মিত আড়তদার আছেন ১২ জন। আর মৌসুমি আড়তদার আছেন ৩০-৪০ জন।
তিনি বলেন, এখানকার চামড়া শিল্পকে আবারও উজ্জীবিত করতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যবসায়ীদের সহজে ঋণ নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আর দেশের টানেলগুলোকে সহজেই ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ পাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পেলে। এই সনদ ছাড়া তো চামড়া ইউরোপ আমেরিকায় যায় না। সেখানে চামড়ার মূল্য পাওয়া যায়। আর এই সনদ অধিকাংশ ট্যানারিতে না থাকায় আমাদের চামড়াগুলো পাঠানো হচ্ছে চায়নায়। তারা তো ভালো দাম দেয় না।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, এবারের ঈদে চামড়া যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদেরকে কীভাবে সহযোগিতা করা যায়, সেটা দেখছি। আর যে সব মাদ্রাসা এতিমখানা কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে, তাদেরকে বিশেষ ভবে সহযোগিতা করা হবে।
পাঠকের মতামত
সম্পূর্ণ ভারত জড়িত