খেলা
‘ফায়ারম্যান’ আকিল
স্পোর্টস ডেস্ক
১২ জুন ২০২৪, বুধবার
পোর্ট অব স্পেনের এক অপরাধপ্রবণ এলাকা ল্যাভেন্টিল। ত্রিনিদাদের এই শহরেই জন্ম আকিল হোসেনের। শহরের কোনো কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জীবন জড়িয়ে যেতে পারতো তারও, হতে পারতেন ড্রাগ ডিলারদের একজন। তবে আকিল এখন বিশ্বকাপের মঞ্চে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অন্যতম ভরসা। বিশ্বকাপে নিজেদের শেষ ম্যাচে উগান্ডার বিপক্ষে ১১ রানে ৫ উইকেট নিয়ে হয়েছেন প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ। ল্যাভেন্টিলে আকিলকে বন্দুকের নলের মুখেও পড়তে হয়েছিল। আকিল বলেন, ‘একবার আমার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বাইরে বসেছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করি আমার এক বন্ধুর বুকে একটি লাল আভা। আমি এটি সরানোর চেষ্টা করছিলাম। ভেবেছিলাম এটি একটি আলোই শুধু। তারপর যখন বুঝতে পারি যে এটি বন্দুক থেকে আসা লেজারের আলো তখন আমরা দিগ্বিদিক পালাতে থাকি।’ আকিলের ইচ্ছে ছিল ফায়ারফাইটার হওয়ারও, আবার ঝোঁক ছিল ক্রিকেটের প্রতিও। তিনি বলেন, ‘আমি জানতাম ক্রিকেট খেললে আমাকে সেরা হতে হবে। এটা আমার পরিবারকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনার একটি উপায় হতে পারে। যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে ডাক পেলাম, তখন নিজেকে বলেছিলাম যে আমি অবশ্যই এই সুযোগটি নিতে যাচ্ছি। নিজেকে বললাম, দৌঁড়াও আকিল!’ ১৩ বছর বয়সে আকিল রোমান ক্যাথলিক চার্চ পরিচালিত ত্রিনিদাদের ফাতিমা কলেজে ভর্তি হন। এরপর কুইন্স পার্ক ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে মাঠে নামার সুযোগ পান তিনি। এই দু’টি এমন প্রতিষ্ঠান যেখানে মাত্র কয়েক দশক আগেও আকিলের মতো আফ্রো-ত্রিনিদাদীয়দের জন্য জায়গা ছিল না। জেমস কুইন্স পার্ক ক্রিকেট ক্লাব ছিল শ্বেতাঙ্গ ও বিত্তবানদের জন্য। আকিল প্রতিকূলতাকে এমনভাবে জয় করেছিলেন যা ইতিহাসকে পাল্টে দিয়েছে। কুইন্স পার্ক সিসি এবং ফাতিমা কলেজ এখনও ধনী ও অভিজাতদেরই প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আকিলের সাফল্য এই দুই প্রতিষ্ঠানে কৃষ্ণাঙ্গদের দুয়ার খুলে দিয়েছে। কুইন্স পার্ক ক্রিকেট ক্লাবে কাইরন পোলার্ড এবং সুনীল নারাইনের সঙ্গে সখ্য হয় আকিলের। সেখানেই জীবনের মোড় ঘুরে যায় তার। সুনীল নারাইন আকিলকে শহরের একটি ফ্ল্যাটে থাকতে দেন। আকিলকে কাজ দেন পোলার্ড। এর মাধ্যমে আকিল প্রথমবার ল্যাভেন্টিলের পরিবেশ থেকে বের হওয়ার সুযোগ পান। ২০১২ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রতিনিধিত্ব করেন আকিল এবং ওই বছরই ত্রিনিদাদের প্রথম-শ্রেণির ক্রিকেটে তার অভিষেক হয়। ২০১২-১৩ মৌসুমে তিনি প্রথম-শ্রেণির এক ম্যাচে দশ উইকেট নেন ও সেঞ্চুরি করেন। তিনি ওই মৌসুমেই ছয়বার পাঁচ উইকেট শিকারের গৌরব অর্জন করেন। ২০১৪ সালে ত্রিনিদাদের হয়ে এক ম্যাচে দু’টি হ্যাটট্রিক করে রেকর্ড গড়েন আকিল। এমন দুর্দান্ত শুরুর পরও হঠাৎ থমকে যায় সব। ২০১৫ সালে তিনি ১৩টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলতে পারলেও পরের পাঁচ বছরে মাত্র ২টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলার সুযোগ পান আকিল। এরমধ্যে অবশ্য করোনা মহামারীর ধকলও ছিল। বিভ্রান্ত এবং হতাশ হয়ে আকিল ক্লাব খোঁজার জন্য বার্বাডোজে যান। অবশেষে ২০২১ সালে ত্রিনিদাদের হয়ে একটি দারুণ মৌসুম শুরু করেন আকিল। এই মৌসুমে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৩৬ উইকেট নিয়ে ‘ত্রিনবাগো নাইট রাইডার্সে’র চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ডাক পান উইন্ডিজ জাতীয় দলে। ২০২১ সালে উইন্ডিজদের বাংলাদেশ সফর কপাল খুলে দেয় আকিলের। জাতীয় দলের দশজন খেলোয়াড় কোভিডের জন্য বাংলাদেশ সফর থেকে নাম প্রত্যাহার করে। এসময় দুর্বল একটি স্কোয়াড সফরে আসে, আকিল দলের সঙ্গে থাকার সুযোগ পান। আকিল যখন জাতীয় দলে ডাক পান তখন তার জীবনের কঠিনতম সময় যাচ্ছিল। আকিলের বাবা মারা যান সফরের ঠিক আগমুহূর্তে। আকিল তার বাবাকে স্মরণ করে বলেন, ‘বাবা ছিলেন একজন নিখুঁত রোল মডেল। তিনি আমার খেলার জন্য কোন হুমকি ছিলেন না। আমার মাথার ওপর কোনো শৃঙ্খলার লাঠি ঝুলিয়ে দেননি তিনি। আমি আমার মতো ক্রিকেট খেলেছি এবং স্বপ্নের পিছু ছুটছি। আমাকে কোনো কিছুতে বাধা না দেয়াটা আমার এ জায়গায় আসার জন্য যথেষ্ট ছিল। তিনি আমার জীবনকে আমার প্যাটার্নে সাজাতে দিয়েছেন। আমাকে অন্য কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি।’ আকিলের জীবনের প্রথম চাওয়া ছিল ফায়ার ফাইটার হওয়া। আকিল বলেন, ‘আমি সবসময় একজন ফায়ারম্যান হতে চেয়েছিলাম। যদিও আমার জীবন অন্যদিকে ঘুরে গেছে কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা ছিল ফায়ারম্যান হওয়ার।’ ১৩ই জুন ত্রিনিদাদের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নামছে আকিলের দল, নিজের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ত্রিনিদাদেই আবারো ঝলসে উঠতে চান ল্যাভেন্টিলের ‘ফায়ারম্যান’।
(ক্রিকইনফো থেকে ভাষান্তর: শেরিফ ফারুকী)