প্রথম পাতা
আনার হত্যা
শিলাস্তির সঙ্গে কম দামে স্বর্ণ দেয়ার টোপও দিয়েছিল শাহীন
শুভ্র দেব
২৭ মে ২০২৪, সোমবার
আনোয়ারুল আজিম আনার কলকাতার বন্ধুর বাসা থেকে বের হয়ে সঞ্জীবার ওই ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন দুটি টোপ পেয়ে। বন্ধু আকতারুজ্জামান শাহীন তাকে তরুণী শিলাস্তির সঙ্গ ও কম দামে স্বর্ণ দেয়ার টোপ দিয়েছিল। ওই ফ্ল্যাটটি ১১ মাসের চুক্তিতে বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে ভাড়া নিয়েছিলেন শাহীন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, রিমান্ডে থাকা শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্যা সাইদ এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ থেকে ডিবি এমপি আনার ঢাকা থেকে কলকাতা এবং বন্ধুর বাসা থেকে ওই ফ্ল্যাটে যাওয়ার আগে ও পরে কী কী ঘটেছে সেটি নিশ্চিত হয়েছে। এ ছাড়া শিমুল ভূইয়া এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ১৬ বছর আগের পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল লাল পতাকা) প্রধান নেতা ডা. মিজানুর রহমান টুটুল হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে। আনার হত্যার সঙ্গে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে টুটুল নিহত হওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। ডিবির ধারণা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, স্বর্ণ চোরাচালান, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মতো বিষয় এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে থাকলেও শুধুমাত্র আকতারুজ্জামান শাহীন, আমানুল্যা সাইদরা সামাজিক রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক শক্তিশালী অবস্থানরত এমপি আনারকে হত্যা করা সম্ভব নয়। এর পেছনে তৃতীয় কোনো অদৃশ্য শক্তি রয়েছে। এ বিষয়ে বেশ কিছু ক্লু, তথ্য প্রমাণ ও কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম পাওয়া গেছে। সেগুলো নিয়ে তদন্ত চলছে। খুব শিগগিরই ওই বিষয়ে বিস্তারিত বেরিয়ে আসবে।
ডিবি জানিয়েছে, ১২ই মে সন্ধ্যা ৭টার দিকে বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের মণ্ডল পাড়া লেনের বাসায় যান এমপি আনার। পরের দিন বন্ধুর বাসা থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে বিধাননগর স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে এসে পৌঁছান। সেখান থেকে বন্ধুকে ফোন দিয়ে বলেন তার জরুরি প্রয়োজনে রুপি লাগবে। তাই তাকে রুপি পাঠাতে হবে। বন্ধু গোপাল তখন এমপি আনারকে বলেন, এখন নির্বাচনের সময় রুপি বহন করা ঠিক হবে না। যেকোনো ঝামেলায় পড়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু আনার এমনভাবে চাইছিলেন গোপাল রুপি পাঠাতে বাধ্য হন। পরে তিনি তার ম্যানেজারকে দিয়ে ৪ লাখ ২০ হাজার রুপি বিধাননগর স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে পাঠান। ওই ম্যানেজার আনারকে এসে বলেন, স্যার এটি পাঠিয়েছেন। রুপি হাতে নিয়ে আনার সাদা রংয়ের একটি গাড়িতে উঠে গুপ্তা সুইটের সামনে যান। সেখানে আগে থেকে দাঁড়ানো ছিল লাল রংয়ের একটি গাড়ি। গাড়ির চালক ছিলেন রাজা নামের এক ব্যক্তি। আর গাড়ির ভেতরে ছিলেন আমানুল্যা সাইদ। সেই গাড়ি আনারকে নিয়ে রওয়ানা হয়ে কিছুদূর সামনে গিয়ে মোস্তাফিজকে গাড়িতে তুলে। তারপর তারা চলে যায় সঞ্জীবার ওই ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাটে পৌঁছার পর আনারকে হালকা নাস্তা ও চা দেয়া হয়। সে সময় ফ্ল্যাটে আমানুল্যা, মোস্তাফিজ, ফয়সাল, জিহাদ, শিলাস্তি উপস্থিত ছিলেন। নাস্তা করার পর আনার আমানুল্যাকে বলেন, আমার স্বর্ণ দাও, চলে যাবো আমি। দেরি হয়ে যাচ্ছে, আরও কাজ আছে আমার। তখন মোস্তাফিজ আনারকে একটি কক্ষের দিকে ডেকে বলেন, আপনি এদিকে আসেন। এমপি উঠে ওই কক্ষের দিকে রওয়ানা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোস্তাফিজ এমপি আনারের চোখেমুখে ক্লোরোফর্ম স্প্রে করে। সঙ্গে সঙ্গে অচেতন হয়ে যান আনার। তখন বিষয়টি শাহীনকে জানানো হয়। শাহীন তাদেরকে নির্দেশ দেন আগে তাকে নগ্ন করে ছবি তুলতে। তার কাছে থাকা সমস্ত টাকা, রুপি হেফাজতে নাও। নগ্ন ছবি ও রুপি নেয়ার অনেকক্ষণ পরেও যখন আনারের জ্ঞান ফিরেনি তখন তারা আবার শাহীনকে ফোন দিলে সে বলে তাহলে শেষ করে দাও এবং কোনো তথ্য প্রমাণ যাতে না থাকে। পরে আনারকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। এরপর লাশ গুমের জন্য কসাই জিহাদ আনারের দেহকে টুকরো টুকরো করে।
তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শাহীন আগে থেকে আনারকে বলেছিল ওই ফ্ল্যাটে স্বর্ণ রাখা আছে। টাকা নিয়ে গেলে স্বর্ণ নিতে পারবে। এজন্য আনার ওই পরিমাণ রুপি সঙ্গে নিয়েছিল। এ ছাড়া তাকে নারী সঙ্গেরও লোভ দেখানো হয়েছিল। আলোচনায় ১৬ বছর আগের হত্যাকাণ্ড: ডিবি’র তদন্ত ও আমানুল্যা সাইদের রিমান্ডে দেয়া তথ্য অনুযায়ী একটি নাম ঘুরে ফিরে আসছে। সেটি হলো ডা. মিজানুর রহমান টুটুল। তিনি ২০০৮ সালের ২৭শে জুলাই পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। টুটুল পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান নেতা ছিলেন। ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী গ্রামের বাসিন্দা টুটুলের বিরুদ্ধে রাজশাহী, পাবনা ও উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন থানায় দুই শতাধিক মামলা ছিল। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় তিনি চরমপন্থী সংগঠনে জড়িয়ে পড়েন। ঘটনার দিন রাতে নওগাঁর রাণী নগর উপজেলায় কালিগ্রাম ঈদগা মাঠে পুলিশের সঙ্গে চরমপন্থিদের গোলাগুলির সময় তিনি মারা যান বলে তখন দাবি করেছিল পুলিশ। চরমপন্থিদের গোপন বৈঠকের খবর পেয়ে এক অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে পুলিশের একটি বিশেষ দল সেখানে পৌঁছালে তাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে চরমপন্থিরা। এ সময় গোলাগুলিতে গুরুতর আহত হন টুটুল। পরে সেখান থেকে উদ্ধার করে রাণীনগর হাসপাতালে নিয়ে গেলে তিনি মারা যান। তবে টুটুলের মা নভেরা খাতুন ঝিনাইদহ প্রেস ক্লাবে গিয়ে সাংবাদিকদের জানান, তিনি জানতে পেরেছেন, শুক্রবার রাতে র্যাব তার ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে। সাংবাদিকদের কাছে ছেলের প্রাণভিক্ষা চেয়ে তিনি বলেছিলেন, অন্যায় করলে তার ছেলের রাষ্ট্রীয় আইনে বিচার হবে, তাকে যেন ক্রসফায়ার দেয়া না হয়। নভেরা খাতুন তার ছেলেকে র্যাব ধরে নিয়ে গেছে এমন দাবি করলেও র্যাবের পক্ষ থেকে এমন কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করা হয়নি বলে জানানো হয়।
ডিবি’র সূত্রগুলো বলছে, নিহত টুটুল আকতারুজ্জামান শাহীনের চাচাতো ভাই এবং আমানুল্যা সাইদের ভগ্নিপতি। রিমান্ডে আমানুল্যা সাইদ জানিয়েছে, বন্দুকযুদ্ধে টুটুল নিহত হওয়ার পেছনে আনারের সম্পৃক্ততা ছিল। টুটুলকে সরিয়ে দেয়ার জন্য আনারই পরিকল্পিতভাবে কাজটি করিয়েছে। শাহীন ও আকতারুজ্জামান বিষয়টি জানতেন। দীর্ঘদিন ধরে সেই ক্ষোভ তারা মনে মনে পুষেছিলেন। একদিকে তাদের দলের প্রধান নেতা অন্যদিকে তাদের স্বজন। তাই আনারের এমন কর্মকাণ্ড মেনে নিতে পারেননি শাহীন ও আমানুল্যা। তদন্ত কর্মকর্তাদের আমানুল্যা বলেছেন, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শাহীন তাকে ভগ্নিপতি ও দলের প্রধান নেতা হত্যার প্রতিশোধের বিষয়টি সামনে এনে মোটিভেট করেছেন। আনার হত্যাকাণ্ডের পেছনে টুটুল নিহত হওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা।
কলকাতায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে ডিবি’র টিম: ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের টিম আনার হত্যার তদন্তের জন্য কলকাতা গিয়ে পৌঁছেছেন। টিমে আরও রয়েছে ওয়ারি বিভাগের ডিসি আঃ আহাদ ও এডিসি শাহিদুর রহমান। সেখানকার সিআইডি’র সঙ্গে তারা যৌথভাবে আনার হত্যার তদন্ত করবেন। তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন, লাশ গুমের জলাশয়, কসাই জিহাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। গতকাল দুপুর ১২টার আগেই তারা দমদম বিমানবন্দরে গিয়ে পৌঁছান। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন হারুন অর রশীদ। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড শাহীনকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আইজিপি’র মাধ্যমে আবেদন করা হবে। ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হবে। তিনি বলেন, শাহীন এই হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী। যেহেতু ঘটনাটি দেশের বাইরে কলকাতায় ঘটেছে, তাই আমরা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত জায়গাটি আগে পরিদর্শন করতে চাই। এরপর গ্রেপ্তার হওয়া জিহাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করবো। এর জন্য আমরা কলকাতা পুলিশের সহযোগিতা চাইবো। এদিকে, হত্যার ‘পরিকল্পনাকারী’ আকতারুজ্জামান শাহীনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে কলকাতার সিআইডি। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম লিখেছে, মার্কিন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই, কিন্তু ভারতের আছে। তাই শাহীনকে ভারতে প্রত্যর্পণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে, কারণ অপরাধটি সেখানে ঘটেছে। এ মামলার অন্যতম আসামি শাহীন, এমপি আনোয়ারুল আজিমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে পরিচিত। আসামি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে থাকেন। তার মার্কিন নাগরিকত্ব আছে।
পাঠকের মতামত
সন্তানসন্ততির প্রতি খেয়াল রাখা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ এ নির্মম ঘটনা থেকে তা অনুধাবন করা যায়।
পরনারী এবং অবৈধ সম্পদের লোভ মানুষকে ধ্বংস করে। এ ঘটনা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে হেদায়াত দান করুন, আমীন।