প্রথম পাতা
সাক্ষাৎকার
সমঝোতা হলে নির্যাতন কেন?
কিরণ শেখ
১৮ মে ২০২৪, শনিবারসরকারের সঙ্গে সমঝোতার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন হেফাজতের আমীর মাওলানা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী। তিনি দাবি করেছেন, আইনি প্রক্রিয়াতেই হেফাজত নেতারা মুক্তি পেয়েছেন। বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গে হেফাজতের কোনো সমঝোতা নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি।
মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নানা ইস্যুতে কথা বলেন হেফাজত আমীর। তিনি বলেন- সত্য হলো, আমরা চাপে আছি। নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। হেফাজত রাষ্ট্রীয় বল প্রয়োগের শিকার। এর ফলে আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে, যদিও সেগুলো আমরা কাটিয়ে ওঠারও চেষ্টা করছি। সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনো আঁতাত থাকলে আমাদের নেতৃবৃন্দকে কি অন্যায়ভাবে মিথ্যা মামলা দিয়ে গণগ্রেপ্তার করে জেলে নিয়ে নির্যাতন করা হতো? রিমান্ডে নিয়ে দিনের পর দিন অকথ্য নির্যাতন করতো? আমাদের নেতৃবৃন্দ যারা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন, তাদের প্রত্যেককেই মাসের বেশির ভাগ সময় আদালতে-আদালতে হাজিরা দিয়ে যেতে হচ্ছে। এটা আরেক অমানবিক হয়রানি। ছোট কারাগার থেকে বের হয়ে যেন আরও বড় কারাগারে এসেছেন তারা! আজকে পুরো বাংলাদেশকেই বৃহৎ কারাগারে পরিণত করা হয়েছে। আমরা পুলিশি রাষ্ট্রে বসবাস করছি। বিতর্কিত আইন করে ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে। কথা বলা যায় এখন? অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ধর্মীয় স্বাধীনতাও সংকুচিত করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে।
হেফাজতের রাজনীতিতে আসার সম্ভাবনা ফের নাকচ করেছেন তিনি। বলেন, আবারো বলছি, হেফাজতের রাজনৈতিক কোনো উচ্চাভিলাষ নেই। এটি একটি অরাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক সংগঠন। নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতি আমাদের কাজের ক্ষেত্র নয়। তার মানে এই নয় যে, আমরা রাজনৈতিকভাবে অসচেতন। রাজনৈতিক ইস্যুতেও হকের পক্ষে, জুলুমের বিরুদ্ধে, মানবতার পক্ষে এবং দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় আমরা কথা বলি। বিশেষ করে যেসব সেকুলার দল ও রাজনীতিবিদ নির্বাচনী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত, তারা যেন ইসলামী মূল্যবোধ ও তৌহিদী জনতার স্বার্থবিরোধী কিছু না করেন সেজন্য আমরা প্রেশার গ্রুপ হিসেবে সক্রিয় রয়েছি। যারা ক্ষমতার লোভে বিদেশি প্রভুদের গোলামি করে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়, আমরা তাদের নসিহত করি।
নেতৃত্বের সংকটের কারণেই ৫ই মে রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বরের ঘটনার পর হেফাজতে ইসলাম আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি এমন আলোচনার ব্যাপারে হেফাজত আমির বলেন, নেতৃত্বের সংকট মূল কারণ নয়। বরং রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগ, অবর্ণনীয় নির্যাতন, অমানবিক হয়রানি ও জেল-জুলুমে ক্রমাগতভাবে হেফাজতে ইসলামকে পিষ্ট করা হয়েছে বলে অভিযোগ তার। বলেন, শত শত মিথ্যা মামলার বোঝা চাপিয়ে আমাদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। আর যেহেতু হেফাজতে ইসলাম কোনো প্রথাগত রাজনৈতিক দলের মতো নয়, সেহেতু আমাদের পক্ষে এমন পরিস্থিতিতে টিকে থাকাই আসল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপর্যয়কর সময়ে দ্বীনশিক্ষার মারকাজ কওমি মাদ্রাসাগুলো রক্ষাকেই আমরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছি। এর ফলে আমাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড সাময়িকভাবে কম ছিল। এরমধ্যেই কয়েকজন শীর্ষ নেতৃবৃন্দ পরপর ইন্তেকাল করেন। সর্বশেষ ২০২১ সালে মোদি বিরোধিতার জেরে অন্যায়ভাবে হেফাজতের নেতাদের গণগ্রেপ্তার করা হয়। হেফাজতের নেতৃত্ব ধ্বংস করে দেয়ার বহু চেষ্টা করেছে রাষ্ট্রযন্ত্র। আলহামদুলিল্লাহ, সরকার এতে ব্যর্থ হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আলেম-ওলামাদের দমিয়ে এদেশে ইসলামী নেতৃত্ব ও চেতনা নির্মূল করা সম্ভব নয়। কারণ মহান রাব্বুল আলামীনের সাহায্য আমাদের সঙ্গে রয়েছে।
হেফাজত আমীর বলেন, আমাদের আন্দোলন ছিল নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপ্রিয়। এটা আমাদের নাগরিক ও সাংবিধানিক অধিকার। আমাদের এই ধর্মীয় আন্দোলনে দল-মত নির্বিশেষে সবাই একাত্মতা পোষণ করেছিলেন। কিন্তু ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদী সেকুলার গোষ্ঠীর প্ররোচনায় সরকার বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আঁতাতের মিথ্যা অজুহাত তুলে তাণ্ডব চালায়। ৫ই মে শাপলা চত্বরে আমাদের ঐতিহাসিক জমায়েতকে নৃশংসভাবে উচ্ছেদ করে। এতে দেশে-বিদেশে সরকারের কর্তৃত্ববাদী চেহারা প্রকাশ হয়ে পড়ে।
হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর আগে ও পরে সংগঠনে দ্বন্দ্ব-গ্রুপিং প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.) জাতির রাহবার ছিলেন। উম্মাহর ক্রান্তিকালে তিনি দায়িত্ব নিয়ে সর্বজনবিদিত অভিভাবক হিসেবে আবির্ভূত হন। তার নেতৃত্বে আমরা আন্দোলন করেছিলাম। আমরা তখন এতটাই ঐক্যবদ্ধ ছিলাম যে, আমাদের নেতৃত্বে ও ঐক্যে ফাটল ধরাতে নানা ষড়যন্ত্র হয়েছিল। দেশি-বিদেশি নানা গোষ্ঠী আমাদের মধ্যে বিভক্তি ও বিভাজন সৃষ্টি করতে এমন কোনো হীন চেষ্টা নেই যা করেনি। নানাভাবে আমাদের বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আলেমদের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা নষ্ট করার চক্রান্ত এখনো বিদ্যমান। তবে যারা গোপনে সরকারের দালালি করে হেফাজতকে ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছিল, তারাই সাধারণ মানুষের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ঝরে গেছে। তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। হেফাজত এখন ঐক্যবদ্ধ। কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব বা গ্রুপিং হেফাজতে মধ্যে নেই।