শেষের পাতা
মিল্টন সমাদ্দার রিমান্ডে, ৩ মামলা
স্টাফ রিপোর্টার
৩ মে ২০২৪, শুক্রবারপ্রতারণার আশ্রয় নিয়ে জাল মৃত্যু সনদ তৈরি, আশ্রমের টর্চার সেলে মানুষজনকে মারধর ও শিশু পাচারের অভিযোগে ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ আশ্রমের চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে ৩টি মামলা হয়েছে মিরপুর মডেল থানায়। এর মধ্যে ডাক্তার না হয়েও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে জাল মৃত্যু সনদ তৈরির অভিযোগে মামলায় তিনদিনের রিমাণ্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুন্সী ছাব্বির আহমেদ বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, মিলটন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৩টি মামলা হয়েছে। জাল মৃত্যু সনদ তৈরি করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে প্রথম মামলাটি রুজু হয়। গতকাল সকালে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মিরপুর বিভাগের মিরপুর জোনাল টিমের উপ-পরিদর্শক (এসআই) কামাল পাশা বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে প্রথম মামলাটি করেন। তার আশ্রমের টর্চার সেলে মানুষজনকে মারধর করার অভিযোগে আরও একটি মামলা হয়। সর্বশেষ তার বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে তৃতীয় মামলাটি করেন রাজধানীর জিগাতলার বাসিন্দা এম রাকিব (৩৫)। এদিকে মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে অপকর্মের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গতকাল দুপুরে আদালতে মিল্টন সমাদ্দারকে হাজির করে ৭ দিনের রিমাণ্ড চান তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের উপ-পরিদর্শক মোহাম্মদ কামাল হোসেন। শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালত তার ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে বুধবার রাতে মিরপুরে অভিযান চালিয়ে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ।
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ: ডিবির সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মিল্টনের দাবি, সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ৯০০ মরদেহ দাফন করেছেন তিনি। যাদের দাফন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ৬০০ জন তার আশ্রমে মারা গেছেন।
অপরদিকে তিনি নিজে ডাক্তার না তার আশ্রমের কেউ অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে না নিয়ে নিজেই চিকিৎসা দিতেন মিল্টন সমাদ্দার। আর কেউ মারা গেলে মৃতদেহ দাফনের জন্য নিজেই তৈরি করতেন জাল সার্টিফিকেট। মিল্টন সমাদ্দারের বিষয়ে মহানগর গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, অজ্ঞাতনামা, ওয়ারিশবিহীন ব্যক্তি, শিশু এবং প্রতিবন্ধীদের নিয়ে চিকিৎসা ও সেবা প্রদানের নামে সঠিক দায়িত্ব পালন না করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া, মৃতদের সঠিক তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য মিল্টনকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে ডিবি। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে জালজালিয়াতির মাধ্যমে ৫০টি ডেথ সার্টিফিকেট দিয়েছেন তিনি। এ ৫০ ব্যক্তির মৃত্যুর সঠিক কারণ ও জাল সনদ তৈরির পেছনে মিল্টনের অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ছিল কিনা তা জানতে চাইবে ডিবি। এ ছাড়া তার সঙ্গে এসব প্রতারণায় আরও কেউ জড়িত আছেন কিনা তাও জানতে চাওয়া হবে। পাশাপাশি আশ্রমে আশ্রয় নেয়াদের মধ্যে কাউকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে হত্যা এবং তাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিক্রি করেছেন কিনা সে বিষয়েও খোঁজ নেয়া হচ্ছে।
কে এই মিল্টন সমাদ্দার: মিল্টন সমাদ্দারের জন্ম ১৯৮৪ সালে বরিশালের উজিরপুরের গুটিয়া ইউনিয়নের বৈরকাঠী গ্রামে। মিল্টন তার বাবা জন সমাদ্দারের দ্বিতীয় স্ত্রীর একমাত্র সন্তান। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া মিল্টন তিনবেলা ঠিকমতো খাবার পেতেন না। জীবিকার জন্য মানুষের জমিতে কাজ করতেন। ছোটবেলা থেকেই তার ছিল অর্থের মোহ। বিয়ে, ব্যবসা এমনকি ধর্মকেও তিনি ব্যবহার করেছেন নিজের লাভের জন্য। ২০০১ সালে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে পিতা জন সমাদ্দারকে পিটিয়ে আহত করেন। এরপর এলাকাবাসী তাকে এলাকা থেকে বেড় করে দেয়। বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমান মিল্টন। একটি ওষুধ কোম্পানিতে আড়াই হাজার টাকা বেতনে চাকরি পান। কিছুদিনের মধ্যেই ফার্মেসি কর্মকর্তা এবং হাসপাতালের নার্সদের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে শুরু করেন চুরি। এরপর এক নার্সকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর স্ত্রীর সঙ্গে মিলে গড়ে তোলেন চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার আশ্রম। আশ্রমের চেয়ারম্যান হয়ে আর পিছনে তাকানো লাগেনি তার। গাড়ি, বাড়ি, টাকা-পয়শা, লাঠিয়াল বাহিনী সবই হাসিল করেছেন তিনি। মানবতার সেবক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেয়া এই মিল্টন সমাদ্দারের প্রধান হাতিয়ার তার ফেসবুক পেজ। পাঁচটি ফেসবুক পেজে তার সঙ্গে ফলোয়ার হিসেবে যুক্ত আছেন প্রায় ২ কোটি মানুষ। রাস্তার পাশে প্রতিবন্ধী, ভবঘুরে ও অসুস্থ বৃদ্ধদের খোঁজ পেলেই তাদের উদ্ধারে তিনি দলবল নিয়ে ছুটে যান। সেসব নারী, পুরুষ ও শিশুকে নিয়ে ভিডিও তৈরি করে প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেন তিনি। এসব পোস্টে মিল্টন মানুষের অসহায়ত্ব তুলে ধরে তাদের জন্য বিত্তবানদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতেন। আর এই ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে প্রতি মাসে সহায়তা হিসাবে তার ১৬টি মোবাইল ব্যাংকিং ও ৩টি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা পড়তো অর্ধকোটি টাকা। এসব টাকায় রাজধানীর দক্ষিণ পাইকপাড়ায় গড়ে তুলেছেন ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’। সেখানে তিনি আশ্রয় দিয়েছেন ২০ জনের মতো বয়স্ক নারী-পুরুষকে। আর সাভারে কেনা জমিতে নির্মাণ করেছেন ছয়তলা ভবন। যেখানে নারী, শিশু ও বৃদ্ধ পুরুষদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মিল্টনের দাবি, সেখানেও থাকছেন ২৫৬ জনের মতো মানুষ। সহায়তার নামে পাওয়া টাকা দিয়ে এসব আশ্রয় নেয়া মানুষের সেবা করেন তিনি। বিভিন্ন সময় ফেসবুক লাইভে মিল্টন দাবি করেন, তিনি আশ্রমের দুইটি শাখায় ৮ থেকে ৯শ’ মানুষের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। তবে বাস্তবে, এই দুই শাখায় সর্বোচ্চ ৫০-৬০ জনের মতো আশ্রিত রয়েছেন। আর তাদের দেখাশোনা ও তার নার্সিং ব্যবসার কর্মীসহ এই দুটি শাখায় মোট ৬০ থেকে ৭০ জন কর্মচারী রয়েছেন বলে সত্যতা পেয়েছে পুলিশ।