শেষের পাতা
নানা আয়োজনে নববর্ষ বরণ
স্টাফ রিপোর্টার
১৬ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবারভোরের আলো ফুটতেই রমনার বটমূল থেকে ভেসে আসা সুরের মূর্ছনা এ নগরীতে নতুনের বার্তা নিয়ে হাজির হয়। পুরনো দিনের জরাজীর্ণতাকে মুছে ফেলে নতুনের কেতন উড়িয়ে গেয়ে উঠে- ‘আজ নিখিলের আনন্দধারায় ধুইয়ে দাও/ মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে দাও।’ হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ বর্ষবরণ। নানা আয়োজনে, নানা ঢঙে; শহর থেকে নগরে উদ্যাপিত হয় বাংলা নববর্ষ। বরাবরের মতো এবরো ভোরে ছায়ানটের শিল্পীরা গান-কবিতায় নতুন বছরকে বরণ করে নেয়। যে পরিবেশনা থেকে কামনা করা হয় বাঙালির সুখ-সমৃদ্ধি। যার পূর্ণতা পায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায়। ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’ স্লোগানে এবারো চারুকলা থেকে বাঙালির মঙ্গল কামনায় বের হয় শোভাযাত্রা। ঈদ পরবর্তী রোববারের সেই শোভাযাত্রায় হাজির ছিল আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা থেকে সবাই। সহস্র মানুষের যেই শোভাযাত্রায় হাজির ছিলেন সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রশাসন ও শিল্প-সংস্কৃতিমনা মানুষ। পোশাকে বৈশাখের বর্ণিল ছটা, হাতে-মুখে আলপনা এঁকে ও ঢাকঢোল পিটিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে সর্বস্তরের মানুষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে ভিসি প্রফেসর ড. এএসএম মাকসুদ কামালের নেতৃত্বে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। কড়া নিরাপত্তায় শোভাযাত্রাটি শাহবাগ মোড় ও শিশুপার্ক সংলগ্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় শাহবাগ মোড় হয়ে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে গিয়ে শেষ হয়। ইউনেস্কো কর্তৃক ‘মানবতার স্পর্শাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষিত মঙ্গল শোভাযাত্রার এবারের স্লোগান ছিলো ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’। বর্ণাঢ্য ও জাঁকজমকপূর্ণ এই মঙ্গল শোভাযাত্রায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ডা. দীপু মনি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মুহাম্মদ সামাদ, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (শিক্ষা) প্রফেসর ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ বিপুলসংখ্যক শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ এবং সর্বসাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করেন। শোভাযাত্রায় এবার স্থান পেয়েছে ৫টি মোটিফ। মোটিফ ৫টি হলো- পাখি, হাতি, ভোঁদর, ফুল হাতে শিশু পুতুল এবং চাকার মধ্যে চোখ নিয়ে ভিন্ন রকম একটি শিল্পকর্ম। একইসঙ্গে শোভাযাত্রায় বিভিন্ন মুখোশ, পেঁচা, ঘোড়া, পুতুল, নকশি পাখি ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি প্রদর্শন করা হয়। নিষেধাজ্ঞা থাকায় পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আগতরা কোনো ধরনের মুখোশ পরেনি। তবে চারুকলা অনুষদ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত মুখোশ হাতে নিয়ে প্রদর্শন করেছেন। ভিসি প্রফেসর ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে এবং সকলের সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও অনাবিল মঙ্গল কামনা করে বলেন, আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইউনেস্কো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই মঙ্গল শোভাযাত্রা শুধু বাঙালির সম্পদ নয়, এটি বিশ্ব সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি বলেন, অন্ধকারের বিরুদ্ধে আমরা আলোর দিশারী। অন্ধকার ভেদ করে সমাজে আলো ছড়াতে এবং সমাজের সকল কুপমণ্ডকতা দূর করতে এবার আমরা প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছি ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’। অতীতের গ্লানি, দুঃখ, জরা মুছে অসুন্দর ও অশুভকে পেছনে ফেলে নতুন কেতন উড়িয়ে বাংলা নববর্ষ-১৪৩১ সকলের জীবনে আরও সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি বয়ে আনবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এর আগে ভিসি ঐতিহাসিক বটতলায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগ আয়োজিত বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন।
এদিকে পুঁথিপাঠ, লালন সংগীত, নৃত্য, ঢাকের তালে তালে ও লোক সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্যদিয়ে নতুন বর্ষকে বরণ করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। শুরুতে পরিবেশিত হয় সমবেত সংগীত ‘তুমি নির্মল করো, মঙ্গল করো’, পরিবেশন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির শিশু সংগীত দল। পরিচালনায় ছিলেন মুহাম্মদ আনিসুর রহমান। এরপর সমবেত ‘নৃত্য এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ পরিবেশন করে স্পন্দন নৃত্যদল, নৃত্য পরিচালনা করেছেন অনিক বোস। একাডেমির নৃত্যশিল্পী এস কে জাহিদের পরিচালনায় সমবেত ঢাক নৃত্য পরিবেশন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নৃত্যদল।
এদিকে এবারের বর্ষবরণে ভিন্ন মাত্রা দেয় ‘আলপনায় বৈশাখ ১৪৩১’ শীর্ষক আয়োজন। এশিয়াটিক এক্সপেরিয়েনশিয়াল মার্কেটিং লিমিটেড, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড ও বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশন্স লিমিটেডের যৌথ উদ্যোগে দেশের তিন স্থানে এ উৎসব হয়। দেশের সর্ববৃহৎ এ আলপনা উৎসব গত ১২ই এপ্রিল প্রথমে শুরু হয় কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে। মিঠামইনের জিরোপয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরোপয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার সড়ক আলপনায় রাঙিয়ে তোলেন শিল্পীরা। যার মাধ্যমে উদ্যোগ নেয়া হয় বিশ্বের দীর্ঘতম আলপনার রেকর্ড গড়ার। এরপর, গত ১৩ই এপ্রিল খুলনার শিববাড়ি মোড় ও ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউতেও একযোগে শুরু হয় এ উৎসব। ‘আলপনায় বৈশাখ ১৪৩১’-এর ঢাকার আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।