শেষের পাতা
ছেলেকে হত্যার পর বাবার আত্মহত্যা
নেপথ্যে কী?
স্টাফ রিপোর্টার
৯ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবাররাজধানীর আগারগাঁওয়ের তালতলা মোল্লাপাড়া এলাকায় ছেলে মোদাব্বির রহমান সাদাফ (১৬)কে হত্যার পর নিজে ফ্যানের সঙ্গে ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বাবা মশিউর রহমান (৫০)। এ ঘটনায় মেয়ে সিনথিয়ার অবস্থা সংকটাপন্ন। তাকে শ্যামলীর ডক্টরস কেয়ার হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভর্তি করা হয়েছে। গত রোববার বিকাল ৪টায় শেরেবাংলা নগর থানার অন্তর্গত মোল্লাপাড়া এলাকার ১৭১নং বাড়ির দ্বিতীয় তলার দক্ষিণ পাশের ফ্ল্যাটে এ ঘটনা ঘটে। জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল পেয়ে পুলিশ গিয়ে সন্ধ্যায় তাদের লাশ উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছে। পুলিশ বলছে, মোটা অঙ্কের টাকার ঋণের বোঝা ও রাজধানীর দক্ষিণখানে কেনা একটি জমির দখল না পাওয়া নিয়ে হতাশায় ভুগছিলেন মশিউর। এ হতাশা থেকেই হয়তো এমন ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারেন মশিউর।
গতকাল সরজমিন মোল্লাপাড়া এলাকার ১৭১নং বাড়িতে দেখা যায়, সুরতহাল ও ক্রাইম সিন আলামত সংগ্রহের পর শেরে-বাংলা নগর থানা পুলিশ ওই ফ্ল্যাটটিতে তালা দিয়ে রেখেছে। বাসাটির দেখভালের দায়িত্বে থাকা কেয়ারটেকার মো. মোস্তফা বলেন, তিন বছর ধরে মশিউর রহমান ওই বাড়ির দ্বিতীয় তলার দক্ষিণ পাশের একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন। ফ্ল্যাটের ৩টি রুম। দুটি রুমে তারা থাকতেন এবং মাঝখানের একটি রুম দুই তরুণীর কাছে সাবলেট দিয়েছেন। রোববার দুপুরে মশিউর রহমানের স্ত্রী মজিদা খাতুন ডলি টিউশনি করাতে বাসা থেকে বের হন। বিকাল ৪টার দিকে তিনি বাসায় ফেরেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে দরজায় ধাক্কাধাক্কি, ডাকাডাকি ও কলিং বেল টিপে সাড়া না পাওয়ায় আত্মীয়-স্বজনদের ডেকে দরজা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন। ম্যানেজারের নির্দেশে আমি (কেয়ারটেকার) নিজেও সেখানে যাই। সাড়া না পেয়ে পেছন দিক দিয়ে গ্রিল ডিঙ্গিয়ে রান্না ঘরের জানালা দিয়ে মেয়েটিকে লাঠি দিয়ে নাড়া দেই। দেখি সে জীবিত আছে। কিন্তু উঠতেও পারছিল না, কথাও বলতে পারছিল না। পরে মা ডলি দরজা ভাঙার কথা বলেন। দরজা ভেঙে ভেতরে গিয়ে দেখি মেয়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। ভেতরের রুমে মশিউর রহমান ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলছেন। আর বিছানায় পড়ে আছে ছেলের লাশ। এরপর পুলিশকে খবর দেয়া হয়। মেয়ে সিনথিয়াকে হাসপাতালে নেয়া হয়। তিনি বলেন, কখনো তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো গ্যাঞ্জামের খবর পাইনি। রোববারও তো দেখলাম মশিউর চকলেট নিয়ে বাসায় ফিরছে। ম্যানেজার ভাড়া চাইছিল। বলছিল আজকে রাতে দেবে।
বাড়িটির ম্যানেজার আব্দুল মালিক ভূঁইয়া বলেন, নিহত মশিউর রহমান বগুড়ার গাবতলী উপজেলার বাউতলার কুদ্দুস মণ্ডলের ছেলে। মশিউর রহমান ডিপ্লোমা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। একটি ডেভেলপার কোম্পানিতে চাকরি করতেন। পাশাপাশি শেয়ার ব্যবসা করতেন। স্ত্রী মজিদা খাতুন ডলি একসময় একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তবে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে এলাকায় টিউশনি করেন। ম্যানেজার বলেন, মশিউর রহমান শেয়ার ব্যবসায় ক্রমাগত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছিলেন। আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। শুনেছি নিজের ভাগ্নের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। সেই টাকা ফেরত দেয়ার জন্য চাপে ছিলেন। তাছাড়া তিনি নাকি একটি প্লট কিনেছেন। কিন্তু সেটিও বেদখলে থাকায় চাপে ছিলেন তিনি।
মশিউরের স্বজনরা বলছেন, মশিউর রহমানের ছেলে নিহত মোদাব্বির হোসেন সাদাবের মোহাম্মদপুরে ঢাকা উদ্যান কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। মেয়ে সিনথিয়া শেরে-বাংলা নগরের একটি স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। মশিউর একটি ডেভেলপার কোম্পানিতে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি করতেন। পাঁচ-ছয় বছর আগে চাকরি ছেড়ে শেয়ার বাজারে লগ্নি করেন। তবে তেমন লাভবান হতে পারেননি তিনি। এ ছাড়া চার-পাঁচ বছর আগে দক্ষিণখান এলাকায় রতন নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১৪ লাখ টাকায় চার শতকের মতো জমি কেনেন মশিউর। পরবর্তী সময়ে জানতে পারেন, জমির দলিল ভুয়া। জালিয়াতি করে রতন ওই জমি তার কাছে বিক্রি করেছিলেন। এটি জানার পর জমির টাকা ফেরতের জন্য চাপ দেন মশিউর। জমির বর্তমান মূল্য ৩২ লাখ টাকা। রতন ১০ লাখ টাকা ফেরত দিতে রাজি হন। কিন্তু সেই টাকা দিচ্ছি-দেবো করে ঘোরাতে থাকেন। কিছুদিন ধরে রতন মশিউরের ফোনও রিসিভ করছিলেন না। একদিকে টাকা ফেরত না পাওয়া, অন্যদিকে শেয়ারবাজারে ব্যবসা মন্দা যাওয়ায় আর্থিক টানাপড়েনে পড়েন মশিউর। এই আর্থিক অনটনেই কিছুদিন ধরে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
মশিউরের স্ত্রী মজিদা খাতুন ডলি বলেন, সংসারের খরচ জোগাতে চার শিক্ষার্থীকে টিউশন পড়ান তিনি। তিন শিক্ষার্থীর বাসায় গিয়ে পড়াতে হয়। আরেকজন বাসায় এসে পড়ে যায়। রোববার দুপুর দেড়টার দিকে তিনি বাসা থেকে টিউশনির জন্য বের হন। এ সময় তার স্বামী ও দুই সন্তান বাসায় ছিলেন। বিকাল পৌনে ৪টার দিকে তিনি বাসায় ফিরে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ পান। পরে ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীর সহায়তায় পেছনের জানালার কাছে যান। সেখান থেকেও ডেকে সাড়া মেলেনি। একপর্যায়ে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখেন এক কক্ষে মেয়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। আরেক কক্ষের মেঝেতে ছেলের নিথর দেহ এবং সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দেয়া অবস্থায় মশিউর ঝুলছেন। তখন মেয়েকে নিয়ে শ্যামলী ডক্টরস কেয়ার হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভর্তি করি। পরে পুলিশ এসে বাবা ও ছেলেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। মজিদা খাতুন বলেন, দুই সন্তানের পড়ালেখার খরচ চালিয়ে সংসারের ব্যয় বহন করা আমাদের জন্য খুব কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। আমি প্রাইভেট পড়িয়ে ৮ হাজার টাকা আয় করি এবং তা সংসারে ব্যয় করি। এতেও সচ্ছলতা ফেরেনি। এসব কারণে আমার স্বামী কিছুদিন ধরে হতাশায় ভুগছিলেন। হতাশা থেকেই হয়তো ছেলেকে হত্যার পর আত্মহত্যা করেছেন। মেয়েকেও হত্যার চেষ্টা করেছিলেন। সিনথিয়া অচেতন হয়ে পড়ায় তিনি হয়তো ভেবেছিলেন মেয়ে মারা গেছে।
শেরে-বাংলা নগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আহাদ আলী বলেন, বাবা-ছেলের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় নেপথ্যের কারণ খুঁজছে পুলিশ। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ছেলেকে হত্যার পর নিজে আত্মহত্যা করেন মশিউর। মেয়েটিকে অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সুরতহাল শেষে দুজনের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। ওসি বলেন, ঘটনাস্থল থেকে মশিউর রহমানের হাতে লেখা একটি সুইসাইড নোট উদ্ধার করা হয়েছে। ওই নোটে লেখা ছিল, ‘বাসায় দুই তরুণী সাবলেট থাকেন, তারা এ হত্যার সঙ্গে জড়িত নন। তারা অনেক আগেই ছুটিতে বাড়িতে গিয়েছেন। তাদের যেন হয়রানি করা না হয়।’ পাশাপাশি বাসার একটি টেবিলের ওপর থেকে কালো রঙের একটি দড়ি উদ্ধার করা হয়েছে। ওসি বলেন, ঋণ থাকার কথা শুনেছি। শেয়ার বাজারেও নাকি তার টাকা লগ্নি করা ছিল। সব মিলিয়ে তিনি হতাশায় থাকতে পারেন। তবে এসব তথ্যের সত্যতা যাচাই করা হবে। তাছাড়া মশিউর কেন এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন, আদৌ তিনি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিনা সেটিও তদন্তের আগে বলা ঠিক হবে না। চিরকুটটি মশিউরের লেখা কিনা সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, মশিউর ছেলে ও মেয়েকে হত্যার চেষ্টা করে নিজে রশিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন। ভাগ্যগুণে বেঁচে যাওয়া মেয়ে সিনথিয়ার অবস্থা আশঙ্কাজনক। সিনথিয়া সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে।
দুখী দেশের দুখী নাগরিক, আল্লাহ দেশটির সহায় হোন, আমীন।