শরীর ও মন
অসহনীয় গরমে যেমন হতে পারে ঈদের পোশাক ও খাবার
ডা. মো. বখতিয়ার
৫ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবারএবার ঈদের উৎসব প্রচণ্ড গরমের সময়ে। তাই ঈদে কেমন হবে পোশাক সেই দিকে নজর রাখা জরুরি। পোশাকে বিশেষ করে শিশুরা অস্বস্তিবোধ করে থাকে। তাই ঈদের পোশাক নির্বাচন করার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যাতে পোশাক শিশুর জন্য আরামদায়ক হয়। তবে এ সময় সবচেয়ে মানানসই হলো সুতির কাপড়। এতে গরম কম লাগবে, সেই সঙ্গে সারা দিনের ঘোরাফেরায় মোটেই অস্বস্তি লাগবে না, আরামও পাওয়া যাবে। রোদ হোক কিংবা বৃষ্টি পোশাকটি যেন ঠিকঠাক উৎসবের আমেজ এনে দেয়।
সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আবহকে গুরুত্ব দিয়ে পোশাক নির্বাচন করা উচিত। বিশেষ করে গরমের এই সময়ে ছেলে শিশুদের জন্য সুতির পাঞ্জাবি, হাফ হাতা শার্ট, সফ্ট কাপড়ের মধ্যে টি-শার্ট এবং মেয়ে শিশুদের জন্য নানান রকমের ব্লক ও অ্যামব্রয়ডারি করা ড্রেস যেমন গাউন, সালোয়ার-কামিজ, স্কার্ট, টপ্স, ফতুয়া ইত্যাদি পরা ভালো। আর ঈদে ছেলেদের পোশাকের ক্ষেত্রেও সুতি কাপড়ের তৈরি পাঞ্জাবি বা শার্ট ও ফতুয়ার সঙ্গে পায়জামা পরা আরামদায়ক ও ফ্যাশনেবল। এ ছাড়া ঈদে মেয়েদের জামা কেনার ক্ষেত্রে সুতি, লিলেন কমফোর্টেবল কাপড় বেছে নেওয়া ভালো। আবার অনেকে ঈদে শাড়ি পরতে পছন্দ করে।
সে ক্ষেত্রে গরমে স্বস্তি পেতে হালকা রঙের শাড়ি যেমন সুতির ব্লক, টাঙ্গাইলের শাড়ি, অ্যাপ্লিকের শাড়ি, ছাপা শাড়ি, ব্লক-বাটিকের সুতি ট্রেন্ডি শাড়ি অথবা পাতলা সাটিন বা জর্জেটের শাড়িও উপযোগী। এতে ঈদের সারা দিন অনেক আরাম পাওয়া যায়। জরি, জারদৌসি, চুমকির ব্যবহারে শাড়িতে অভিজাতভাব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
গরমের সময় পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে কাপড়ের মতোই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো এর রঙ। সেক্ষেত্রে কনট্রাস্ট কালারের পাশাপাশি রঙের ‘ম্যাচিউরড টোন’-এর পরিমিত ব্যবহার সবচেয়ে ভালো।
অন্যদিকে দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পর ঈদের দিনের খাবার নিয়ে সাবধানতা অবলম্বন জরুরি। ঈদের পুরো সময়েই থাকে খাবারের নানা আয়োজন। তবু কোন বেলায় কত ক্যালরি ও পুষ্টি পাওয়া যাচ্ছে, তা জানাটাও অত্যন্ত জরুরি। কারণ, অতিরিক্ত তেল খাবারের পুষ্টিমান কমাতে পারে, তাই খাওয়ার আগে খাবারের পুষ্টি ও খাদ্যমান নিয়ে সজাগ থাকতে হবে।
ঈদে খাদ্যাভ্যাস কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। আবার যারা সুস্থ আছেন তাদের এই সুস্থতা বজায় রাখতে কীভাবে চলা উচিত তাও অনেকের চিন্তার ব্যাপার। কারণ যখন রমজান মাস আসে তখন সবাই নিয়মিত অভ্যাস থেকে হঠাৎ করে রোজায় অভ্যস্ত হয়ে যাই। রোজার এই সময়ে শরীরে এক ধরনের নিয়ম পরিবর্তন হয়ে যায়। আগে যেমন ৩ বেলা খাওয়া-দাওয়া করতাম; কিন্তু এক মাস রোজার কারণে তা হয় না। আবার যখন ঈদের দিন থেকে আগের নিয়মে খাওয়া- দাওয়া শুরু করি তখন শরীরের যে মেটাবলিজম সিস্টেমগুলো থাকে তা ব্যালেন্স করতে সমস্যা হয়। এ ছাড়াও ঈদের দিন থেকে অনেকে ভাজাপোড়া, ফাস্ট ফুড, রিচ ফুড ও মুখরোচক খাবারসহ নানা খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে ফুড পয়জনিং, অ্যাসিডিটি ও গ্যাস্ট্রিক সমস্যাসহ অনেক সময় পাতলা পায়খানা হতে পারে।
ঈদের দিন রীতি অনুযায়ী অনেক রিচ ফুড খাওয়া হয়। এদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই সেমাই, পায়েশ, জর্দাসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার খাওয়া হয়। কেউ আবার গরুর গোশ্ত, লুচি-পরোটা খিচুড়ি খায়। তিনি কী খাচ্ছেন সেদিকে খেয়াল রাখেন না। আবার মিষ্টি ও ঝালজাতীয় খাবার একসঙ্গে খাওয়া উচিত নয়। এজন্য এক জাতীয় খাবার খাওয়ার পর অন্য খাবার খাওয়ার আগে তা হজম হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তা না হলে হজমজনিত সমস্যাসহ বুক জ্বালা-পোড়া এবং পাতলা পায়খানা হতে পারে।
এখন যেহেতু গরমকাল তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে অসুস্থজনিত ব্যক্তি এবং শিশুদের ক্ষেত্রে। কারণ অতিরিক্ত গরমে শরীর থেকে অনেক ঘাম বের হয়ে যায়। যাদের রক্তচাপজনিত সমস্যা রয়েছে সে ক্ষেত্রে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার অনেকের স্ট্রোক এবং হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই দুপুর বেলা খাবার সময় জ্যুস, স্যালাইন, ডাবের পানি, বেলের শরবত ও তরমুজ খাওয়া ভালো। মোট কথা সবদিক থেকে চিন্তা করে আমাদের খাবারগুলো এমন হতে হবে যাতে পুষ্টিগুণ বিদ্যমান। বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের ফল, যেগুলোতে পটাশিয়াম, সোডিয়াম ও ফসফরাস থাকে, যা মানুষের জন্য খুব উপকারী।
ঈদের দিন থেকে অনেকে ভাজাপোড়া, ফাস্ট ফুড, রিচ ফুড ও মুখরোচক খাবারসহ নানা খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন, যা ঠিক নয়। সব খাবারই পরিমাণমতো এবং নিয়ম করে সঠিক সময়েই খাওয়া উচিত। প্রয়োজনে কয়েক ঘণ্টা পর খেতে পারেন। এই সময়ে খাদ্য তালিকায় সুস্থ থাকার জন্য অবশ্যই সবজি, ফ্রুটস সালাদ, সালাদ খাওয়া সবচেয়ে উত্তম হয়। সঙ্গে লেবুর শরবত, টক দই এবং তরল জাতীয় খাবার খেতে পারেন। এতে পানিশূন্যতার সমস্যা হওয়ার শঙ্কা থাকবে না। আর শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি চিনি, বেকারির খাবার, কোমল পানীয় যাতে মাত্রা ছাড়া না খায় এবং কোনো জিনিসই যেন অতিরিক্ত না খায় সেদিকে নজর রাখতে হবে।
রোজার সময়ে খাবারের বিষয়ে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ থাকে। কিন্তু ঈদের দিনেই সেমাই, পায়েস, জর্দা, পোলাও কোর্মাসহ কত টক-ঝাল-মিষ্টি, তৈলাক্ত বা ভাজাপোড়া খেয়ে অসুস্থবোধ করতে পারেন। তাই সবার জন্যই খাবার হওয়া উচিত কম মসলাযুক্ত, কম তৈলাক্ত, ভালোভাবে রান্না করা। তবে এই সময়ে মূল সমস্যাটা হলো খাবারের পরিমাণে। অনেকেই একসঙ্গে প্রচুর পরিমাণে তৈলাক্ত বা চর্বিযুক্ত খাবার খেয়ে হজম করতে পারেন না। আবার পর্যাপ্ত পানি পান না করার কারণে অনেকে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগেন। একে রোজায় পানি কম পান করা হয়, সবজি কম খাওয়া হয়, ভাজাপোড়া খাওয়া হয় বেশি, ঈদেও এই ধারা বজায় থাকে। প্রচুর পানি পান করতে হবে, যাতে কোষ্ঠকাঠিন্য না হয় এবং খাবারের পরিমাণ বজায় রাখাটা খুবই জরুরি।
যারা মাঝবয়সী বা বয়োবৃদ্ধ বা যাদের অন্যান্য শারীরিক সমস্যা আছে, যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগ ইত্যাদি, তাদের খাবারের ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি। পোলাও-বিরিয়ানি কম খাওয়া ভালো, ভাত খাওয়াই ভালো। ডায়াবেটিস রোগীকে অবশ্যই মিষ্টিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। আর যাদের রক্তে কোলেস্টেরল বেশি বা উচ্চ রক্তচাপ আছে অথবা হার্টের সমস্যা আছে অথবা যারা মুটিয়ে যাচ্ছে, তাদের অবশ্যই তেল ও চর্বি এড়িয়ে যেতে হবে।
কিডনির সমস্যা থাকলে প্রোটিনজাতীয় খাদ্য, যেমন, মাছ-মাংস অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দিনে দুই টুকরোর বেশি নয়। এদের অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নেয়া উচিত।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক ও গবেষক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক, খাজা বদরুদজোদা মডার্ন হাসপাতাল, সফিপুর, কালিয়াকৈর, গাজীপুর।