শেষের পাতা
যাকাত আপনার ওপর ফরজ বুঝবেন যেভাবে
আতিকুর রহমান নগরী
৩ এপ্রিল ২০২৪, বুধবারআল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কোরআনে হাকিমে ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের বৈধ উপার্জন এবং আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে যে শস্য উৎপন্ন করি তা থেকে আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় (যাকাত দাও) করো।’-বাকারা, আয়াত নং-২৬৭। ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি ‘যাকাত’। মুসলমানের বৈধ উপার্জন থেকে একটি ‘নির্দিষ্ট পরিমাণ’ আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় করার নাম ‘যাকাত’।
সূরা বাইয়্যিনাহ’র ৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তাদের এ মর্মে আদেশ করা হয়েছে যে, তারা একাগ্রচিত্তে শুধুমাত্র আল্লাহতায়ালার এবাদত
করবে, যথাযথভাবে সালাত আদায় করবে, যাকাত প্রদান করবে, আর এটাই হলো সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন।’ যাকাতের গুরুত্ব ইসলামে অপরিসীম। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদে ঘাটতি কিংবা সম্পদ হ্রাস পায় না, বরং যাকাতের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র হয়, বৃদ্ধি লাভ করে। যাকাত আদায়কারীর পুরস্কার হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি, আখেরাতে মুক্তি ও জান্নাত।
যাকাত দেয়াকে করুণা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। মালের নেসাব পরিমাণ যাকাত আদায় করা ‘দয়া নয়’ বরং ‘গরিবের হক’। ইসলামী শরিয়তমতে, সুষ্ঠুভাবে যাকাত বণ্টন করা গেলে দরিদ্রমুক্ত একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক সমাজ কিংবা রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব। যাকাত ধনী ও গরিবের মধ্যকার বৈষম্য কমিয়ে আনে।
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘যারা সোনা ও রূপা পুঞ্জীভূত করে রাখে, আর তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তুমি তাদের বেদনাদায়ক আজাবের সংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা গরম করা হবে, অতঃপর তা দ্বারা তাদের কপালে, পার্শ্বে এবং পিঠে সেঁক দেয়া হবে। (আর বলা হবে) ‘এটা তা-ই যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে, সুতরাং তোমরা যা জমা করেছিলে তার স্বাদ উপভোগ কর।’-আত-তওবা, আয়াত নং- ৩৪-৩৫।
নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক সকল মুসলিম নর-নারীর ওপর যাকাত ফরজ। কোনো ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার পর চাঁদের হিসাবে পরিপূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হলে তার ওপর পূর্ববর্তী বছরের যাকাত প্রদান করা ফরজ। অবশ্য কোনো ব্যক্তি যাকাতের নিসাবের মালিক হওয়ার পাশাপাশি যদি ঋণগ্রস্ত হয়, তবে ঋণ বাদ দিয়েও নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তার ওপর যাকাত ফরজ হবে। যাকাত ফরজ হওয়ার পর যদি কোনো ব্যক্তি তা প্রদান না করে অর্থ-সম্পদ খরচ করে ফেলে তাহলেও তার পূর্বের যাকাত দিতে হবে।
যাকাত কার ওপর ফরজ-
বর্তমানে দেশের হিসেবে সাড়ে সাত ভরি সোনা বা সমপরিমাণ অর্থ কারও কাছে পূর্ণ এক বছর থাকলে তার ওপর যাকাত ফরজ। এখন ২২ ক্যারটে ভরি ধরা হলে আর প্রতিগ্রাম সোনার বর্তমান বাজারমূল্য ধরে সে হিসেবে গণনা করলে ৮৫গ্রাম/৭.৫ ভরি স্বর্ণের দাম যা আসে তাই যাকাত হিসেবে আদায় করতে হবে। অর্থাৎ আড়াই শতাংশ হারে যাকাতের টাকা পরিশোধ করতে হবে ।
রূপার নিসাব হলো দেশীয় পরিমাপে সাড়ে ৫২ ভরি, তা থেকে ৪০ ভাগের ১ ভাগ যাকাত দেয়া ফরজ।
নগদ টাকার যাকাতের হিসাব-
কাগজের তৈরি নোটের ওপরও যাকাত দিতে হবে। কারণ এ নোটগুলো রূপার বদলেই চলমান, সুতরাং এগুলো রূপার স্থলাভিষিক্ত হবে এবং এর মূল্য রূপার নিসাবের সমপরিমাণ হলে, তাতে যাকাত আদায় করতে হবে।
নগদ অর্থ, টাকা-পয়সা, ব্যাংকে জমা, পোস্টাল সেভিংস, বৈদেশিক মুদ্রা (নগদ, এফসি অ্যাকাউন্ট, টিসি, ওয়েজ আর্নার বন্ড), কোম্পানির শেয়ার, মিউচ্যুয়াল ফান্ড, ঋণপত্র বা ডিবেঞ্চার, বন্ড, সঞ্চয়পত্র, জমাকৃত মালামাল (রাখী মাল), প্রাইজবন্ড, বীমা পলিসি (জমাকৃত কিস্তি), কো-অপারেটিভ সমিতির শেয়ার বা জমা, পোস্টাল সেভিংস সার্টিফিকেট, ডিপোজিট পেনশন স্কিম কিংবা নিরাপত্তামূলক তহবিলে জমাকৃত অর্থের যাকাত প্রতি বছর যথানিয়মে প্রযোজ্য হবে।
চাকরিজীবীর বেতনের একটি অংশ নির্দিষ্টহারে কর্তন করে ভবিষ্যৎ তহবিলে জমা করা হলে ওই অর্থের ওপর যাকাত ধার্য হবে না। কারণ ওই অর্থের ওপর চাকরিজীবীর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ভবিষ্যৎ তহবিলের অর্থ ফেরৎ পাওয়ার পর যাকাত আওতাভুক্ত হবে। ঐচ্ছিকভাবে ভবিষ্যৎ তহবিলে বেতনের একটা অংশ জমা করা হলে তার ওপর যাকাত প্রযোজ্য হবে অথবা বাধ্যতামূলক হারের চাইতে বেশি হারে এই তহবিলে বেতনের একটা অংশ জমা করা হলে ওই অতিরিক্ত জমা অর্থের ওপর বছরান্তে যাকাত প্রযোজ্য হবে। চাকরিজীবীর অন্যান্য সম্পদের সাথে এই অর্থ যোগ হয় নিসাব পূর্ণ হলে যাকাত প্রদান করতে হবে।
পেনশনের টাকাও হাতে পেলে যাকাত হিসাবে আসবে। মানত, কাফ্ফারা, স্ত্রীর মাহরের জমাকৃত টাকা, হজ ও কোরবানির জন্য জমাকৃত টাকার ওপরেও বছরান্তে যথা নিয়মে যাকাত দিতে হবে। ব্যাংক জমা বা সিকিউরিটির (ঋণপত্র বা ডিবেঞ্চার, বন্ড, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি) ওপর অর্জিত সুদ ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ উপার্জন নয় বিধায় যাকাত যোগ্য সম্পদের সঙ্গে যোগ করা যাবে না। অর্জিত সুদ বিনা সওয়াবের উদ্দেশ্যে কোনো জনহিতকর কাজে ব্যয় করতে হতে পারে। তবে মূল জমাকৃত অর্থের বা সিকিউরিটির ক্রয় মূল্যের ওপর যাকাত প্রদান করতে হবে। ব্যাংক জমার ওপর বৈধ মুনাফা প্রদান করা হলে ওই মুনাফা মূল জমার সঙ্গে যুক্ত করে যাকাতযোগ্য অন্যান্য সম্পত্তির সাথে যোগ করতে হবে।
যাদের ওপর যাকাত ফরজ: ইসলামী শরীয়া অনুযায়ী এমন প্রত্যেক মুসলমান নর ও নারীর ওপর যাকাত আদায় করা ফরজ, যাদের মধ্যে নিম্নোক্ত শর্তাবলী পাওয়া যায়- ১. মুসলিম ২. স্বাধীন ৩. আকেল হওয়া ৪. বালেগ হওয়া ৫. নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা ৬. পূর্ণাঙ্গ মালিকানা থাকা ৭. সম্পদের মালিকানা পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হওয়া ।
(সুতরাং অমুসলিম, পরাধীন ক্রীতদাস, উন্মাদ (পাগল), অপ্রাপ্তবয়স্ক নাবালেগ, নিসাবের চেয়ে কম পরিমাণে সম্পদের অধিকারী, যৌথসম্পত্তিতে এককভাবে নিসাব পরিমাণে সম্পদের মালিক না হওয়া, নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ একবছর মালিকানায় না থাকলে তার ওপর যাকাত ফরজ নয়)।