শরীর ও মন
পুরুষের মূত্রতন্ত্রের যৌন ও অযৌন সংক্রমণ
অধ্যাপক (ডা.) মোহাম্মদ আবদুল হাই
৪ জুলাই ২০২২, সোমবারকিডনি থেকে শুরু হয়ে ইউরেটার বা কিডনি নল বেয়ে মূত্রথলি হয়ে মূত্রনালি পর্যন্ত অংশকে মূত্রতন্ত্র বা রেচন তন্ত্র বলা হয়। এই তন্ত্রের কোনো অংশে জীবাণুঘটিত সংক্রমণ হলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, তাকেই ‘ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন’ বলে। কিডনি, মূত্রনালি, মূত্রথলি বা একাধিক অংশেই এই ধরনের সংক্রমণ হতে পারে। বেশির ভাগেরই ধারণা, মহিলারাই শুধু এই রোগে আক্রান্ত হন। কিন্তু এ ভাবনার ভিত্তি নেই। তবে পুরুষ এবং মহিলাদের মূত্রনালির মধ্যে গঠনগতভাবে পার্থক্য রয়েছে। মহিলাদের মূত্রনালি পুরুষের তুলনায় দৈর্ঘ্যে অনেক ছোট। যেখানে মহিলাদের মূত্রনালির দৈর্ঘ্য মাত্র দেড় ইঞ্চি, সেখানে পুরুষের মূত্রনালির দৈর্ঘ্য প্রায় ৭ থেকে ৮ ইঞ্চি। আবার মহিলাদের মূত্রনালির বেড় পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি এবং নালি যথেষ্ট সোজা। সে তুলনায় পুরুষের মূত্রনালী অনেকটা আঁকাবাঁকা হয়ে প্রোস্টেট গ্ল্যান্ড নামে একটি মাংসল গ্রন্থির ভেতর দিয়ে গিয়ে মূত্রথলিতে পৌঁছায় এবং এ নল মহিলাদের মতো শুধু প্রস্রাব বহন করে না, একই সঙ্গে বীর্য ও প্রোস্টেট গ্ল্যান্ডের রসও বহন করে।
লক্ষণ ১: প্রস্রাবের রং বদলে যাওয়া। বেশ কিছুদিন ধরে গাঢ়ো হলুদ বা লালচে প্রস্রাব হলে সচেতন হতে হবে। কিছু কিছু সংক্রমণ যেমন গনোরিয়া হলে প্রস্রাবের সঙ্গে বা প্রস্রাবের আগে ও পরে হলুদ রঙের পুঁজ দেখা দিতে পারে। লক্ষণ ২: প্রস্রাবের সময় জ্বালা বা ব্যথা অনুভব করা। গনোরিয়ার ক্ষেত্রে এই জ্বালা যন্ত্রণা তীব্র হয়। ক্ল্যামাইডিয়া বা অন্যান্য যৌনবাহিত রোগে জ্বালাপোড়া খুবই কম থাকে।
লক্ষণ ৩: প্রস্রাবের বেগ এলেও প্রস্রাব না হওয়া বা প্রস্রাবের পরিমাণ অত্যন্ত কমে যাওয়া। এটা তীব্র প্রদাহের লক্ষণ। লক্ষণ ৪: তলপেটে একটা অস্বস্তি বা হালকা ব্যথা অনুভব করা। ক্ল্যামাইডিয়া ইনফেকশনে অনেকেই এই ব্যথা অনুভব করেন। তবে সবার ক্ষেত্রে এই ব্যথা নাও থাকতে পারে।
লক্ষণ ৫: সংক্রমণের প্রভাবে অনেকের কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে পারে। বমি বমি ভাবও থাকে অনেকের। এইসব লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তবে এই অসুখ প্রতিরোধে কিছু অভ্যাসের দিকে বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন।
*প্রথমত শরীরের চাহিদা অনুযায়ী পানি খাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি পান করলে শরীর থেকে বর্জ্য বা জীবাণু প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়। কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় আমরা প্রতিদিন সঠিক পরিমাণ পানি পান করি না। **বেশিক্ষণ প্রস্রাব ধরে না রাখা। অনেককেই নানা কারণে প্রস্রাব আটকে রাখতে হয়। বড় বড় শহরের যানজট এবং স্বাস্থ্যসম্মত গণশৌচাগারের অভাবের কারণে অনেকেই দীর্ঘক্ষণ প্রস্রাব আটকে রাখেন। মহিলাদের ক্ষেত্রে এ সমস্যা আরও শোচনীয়।
*** প্রতি বার প্রস্রাব করার পর প্রস্রাবের জায়গা পরিষ্কার করে ধুয়ে নিন, শুধু তা-ই নয়, অপরিষ্কার অন্তর্বাস থেকেও নানা জীবাণু সংক্রমিত হয়। তাই এসব ব্যবহারের সময়ও সতর্ক থাকুন।
****অস্বাস্থ্যকর যৌন ক্রিয়া এ রোগের অন্যতম কারণ। যৌন সঙ্গীর মূত্রসংক্রমণ থাকলে যৌনতায় সাবধানতা অবলম্বন প্রয়োজন। প্রায় ক্ষেত্রেই যৌনকর্মীদের সঙ্গে মিলনের পর পুরুষরা গনোরিয়া নামের মূত্রসংক্রমণ এর সম্মুখীন হন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এক্ষেত্রে প্রস্রাবের নালি দিয়ে ঘন হলুদ পুঁজ নির্গত হয় এবং মূত্রনালিতে তীব্র জ্বালা-যন্ত্রণা থাকে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে অনেকের মূত্রনালি প্রদাহ হয়ে সরু হয়ে যায়। এতে রোগীরা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সম্মুখীন হন। অনেকেরই প্রস্রাবে তখন দীর্ঘসময় ব্যয় হয়, প্রায়ই জ্বালা যন্ত্রণা বোধ হয় এবং এক পর্যায়ে কিডনির জটিলতার সম্মুখীন হন। অনেকের মাঝে ইনফার্টিলিটি বা সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা দেখা যায়। ক্ল্যামাইডিয়া আরেকটি যৌনবাহিত রোগ, নারী-পুরুষ উভয়কেই আক্রমণ করে। এ রোগের সংক্রমণের হার অন্যান্য যেকোনো যৌনবাহিত রোগের চেয়ে বেশি। তাই এসব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ একান্তই প্রয়োজন। প্রায় সব ক্ষেত্রেই তখন স্বামী-স্ত্রী উভয়কে চিকিৎসা নিতে হয়।
নিয়মিত শাকসবজি ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার ও ফল খাওয়া উচিত। ভিটামিন সি ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সহায়তা করে। মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ শরীরের একটি জটিল সমস্যা। শুধুমাত্র সঠিক তথ্য, সচেতনতা ও কিছু উপায় অবলম্বন করলে এর সমস্যা থেকে দূরে থাকা যেতে পারে। তাই প্রয়োজন সঠিক তথ্য ও জনসচেতনতা।
লেখক: (চর্ম, যৌন ও এলার্জি রোগ বিশেষজ্ঞ), জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। চেম্বার-১২, স্টেডিয়াম মার্কেট, সিলেট। ফোন- ০১৭১২২৯১৮৮৭