ঢাকা, ৯ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শরীর ও মন

জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে তামাকপণ্যের দাম বৃদ্ধি জরুরি

প্রফেসর ডা. মো. হাবিবে মিল্লাত

(১ মাস আগে) ১৯ মার্চ ২০২৪, মঙ্গলবার, ৭:৩৭ অপরাহ্ন

mzamin

বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তয়স্ক মানুষ বিড়ি-সিগারেট, জর্দা-গুলসহ অন্যান্য ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য ব্যবহার করেন। ফলশ্রুতিতে প্রতি বছর ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করছে তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে। পাশাপাশি তামাকের কারণে বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয় (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো সহ)। তামাকের কারণে চলমান এই মৃত্যুর মিছিল এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি দেশের উন্নয়ন এবং প্রবৃদ্ধির যে অন্যতম অন্তরায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের এই হুমকি মোকাবিলা করতে হলে আমাদের সুনির্দিষ্ট ভাবে তামাকজাত পণ্যের কর এবং দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে তামাকের ব্যবহার কমাতে হবে।           

দেশে কয়েক মাস পরেই ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা হবে। কর আহরণ করা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বাজেট অনেকটাই করের উপর নির্ভরশীল। তামাকজাত পণ্যের ওপর করারোপের বিষয়টি শুধু রাজস্ব আহরণের স্বার্থেই করা হয় না, এর সাথে জড়িত রয়েছে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার দিকটি। তামাক আন্তর্জাতিকভাবে স্বাস্থ্যের জন্যে একটি ক্ষতিকর পণ্য হিসেবে স্বীকৃত।

বিজ্ঞাপন
আমাদের দেশেও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাকের ব্যবহার কমানোর জন্যে আইন রয়েছে। তবে ভোক্তা পর্যায়ে তামাকের ব্যবহার কমানোর একটি অন্যতম স্বীকৃত ও আদর্শ উপায় হচ্ছে মূল্য বৃদ্ধি করা। সেটা সুনির্দিষ্ট করারোপের মাধ্যমে হতে পারে এবং স্বাভাবিক ভাবেই তামাকজাত পণ্যের দাম বাড়ালে মানুষের তামাকপণ্য কেনার ক্ষমতা কমে এবং তামাক ব্যবহারের প্রবণতা হ্রাস পায়। ফলে তামাকজনিত অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর ঝুঁকিও হ্রাস পায়। 

এদিকে তামাকের ব্যবহার কমলেও তামাকপণ্যের ওপর উচ্চ হারে আরোপিত করে রাজস্ব বাড়বে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। তামাক ব্যবহারকারী শীর্ষ দেশগুলোতেও এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে এর সুফল পাওয়া গেছে। কিন্তু অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে তামাক পণ্যের দাম নাগালের মধ্যেই। যা দেশের অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী ও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তামাকের ব্যবহারকে সহজলভ্য করে তুলছে। তাই সুনির্দিষ্ট ভাবে তামাকের দাম বাড়ালে এবং করারোপ করলে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা এই ব্যবহারকারীরা তামাক পণ্য কেনা থেকে বিরত থাকবে। ফলে তামাক নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। 

বাংলাদেশে বিড়ি/সিগারেট এবং অন্যান্য তামাকপণ্যের দাম যে হারে বাড়া উচিত সেই হারে বাড়ছে না। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি ও মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম বাড়েনি। ২০১৬ সালের তুলনায় ২০২২ সালে খানা প্রতি মাসিক গড় আয় বেড়েছে ১০৩ শতাংশ, মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৯৩ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি বেড়েছে প্রায় ৯ শতাংশ এবং এগুলো তামাকপণ্যকে আরো সহজলভ্য করে তুলছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বর্তমানে ১০০ প্যাকেট সিগারেট ক্রয়ে ব্যক্তির আয়ের যতটুকু ব্যয় করতে হয় তা আগের তুলনায় ১৫ শতাংশ কম, যা এই নিম্নস্তরের সিগারেটে উল্লেখযোগ্য হারে মূল্যবৃদ্ধির পরামর্শ দেয়। নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম না বাড়ায় এ খাত থেকে বড় ধরনের রাজস্বও হারাচ্ছে সরকার। 

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন স্তরের সিগারেটের ১০ শলাকার একেকটি প্যাকেটের যে মূল্য ঘোষণা করা হয়েছিল, বাজারে তার থেকে বেশি মূল্যে সিগারেট বিক্রি করা হয়েছে। যেমন: নিম্ন স্তরের (সবচেয়ে কমদামি) ১০ শলাকার সিগারেটের একটি প্যাকেটের মূল্য ৪০ টাকা লেখা থাকলেও তা বাজারে খুচরা বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকায়। অথচ সিগারেট কোম্পানিগুলো রাজস্ব বোর্ডকে কর দিয়েছে ঘোষিত খুচরা মূল্য হিসাবেই অর্থাৎ ৪০ টাকা হিসাবে। সব স্তরের সিগারেটের জন্যই এটা প্রযোজ্য ছিল। যার ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সিগারেট কোম্পানিগুলো প্রায় ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েছে এবং একই কর ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকায় চলতি অর্থ বছরেও সরকার আরো বড় পরিমাণে রাজস্ব হারাচ্ছে। 

এদিকে তামাক কোম্পানিগুলোও কিছু ভ্রান্ত তথ্য ছড়ায় যে, নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম বাড়ানো হলে কম আয়ের ব্যবহারকারীরা যারা সিগারেট ব্যবহার করছে তাদের সিগারেট ব্যবহার আগের মাত্রায় ধরে রাখার জন্য দৈনন্দিন খাদ্যপণ্য ক্রয় করা কমিয়ে আনবে। কিন্তু ২০২১ সালে ‘উন্নয়ন সমন্বয়’ পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে এই সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। আবার অনেকেই এই যুক্তি দেন যে সিগারেট ব্যবহারকারীরা বিড়ির দিকে ঝুঁকবে। কিন্তু অতীতে নিম্ন বা মধ্যম স্তরের সিগারেটের দাম বাড়িয়ে এমন কিছু দেখা যায় না। বরং গত পাঁচ বছরে ক্রমাগত ভাবে বিড়ি বিক্রি কমছে এবং নিম্নস্তরের সিগারেটের বিক্রি অব্যাহত ভাবে বাড়ছে। সর্বোপরি তামাকজাত পণ্যের ওপর উচ্চ হারে করারোপ সরকারের জন্য উল্লেখযোগ্য হারে রাজস্ব বৃদ্ধি করতে পারে।   

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমরা যদি বিদ্যমান কর ব্যবস্থার সংস্কার করে সুনির্দিষ্ট করারোপ করি এবং সব ব্র্যান্ডের সর্বনিম্ন মূল্যবৃদ্ধি করি তা হলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আয় করা যাবে, যা বর্তমানে সংগৃহীত রাজস্বের চেয়ে ২৮ শতাংশ বেশি। যা দীর্ঘ মেয়াদে প্রায় ৫ লাখ ৩৮ হাজার  প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রায় ৫ লাখ ৪১ হাজার তরুণ জনগোষ্ঠীর অকাল মৃত্যুরোধ করা সম্ভব হবে। একই সাথে তামাক কর থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব, স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন এবং তামাক বিরোধী সচেতনতা তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি তামাক ব্যবহার কমাতে সাহায্য করবে, যা দীর্ঘমেয়াদে জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক উন্নতিতে ভূমিকা রাখবে।

তদুপরি উচ্চমাত্রার দাম এবং কর মানুষকে তামাকজাত পণ্য ব্যবহার থেকে নিরুৎসাহিত করবে, বিশেষ করে তরুণ এবং দরিদ্র ব্যবহারকারী যাদের ক্রয়ক্ষমতার ওপর মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ে। উচ্চ তামাক কর আরোপের ফলে তামাক ব্যবহারের প্রবণতা কমে আসবে এবং তামাকজনিত অসংক্রামক রোগ ও মৃত্যু হ্রাস পাবে।  বাংলাদেশে তামাকজনিত অসংক্রামক রোগের মৃত্যুর ঝুঁকি কমিয়ে আনতে সুনির্দিষ্ট ভাবে তামাকের মূল্যবৃদ্ধি এবং কর বৃদ্ধি করা একটি জরুরি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বাজেটে সব স্তরের সিগারেটের দাম নির্ধারণ করে থাকে। তাই আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে নিম্নস্তরের (কম দামি) সিগারেটের দাম বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সাথে বিড়ি এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের উপর কর ও মূল্যবৃদ্ধি করাও জরুরি। 
দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে তামাকজাতপণ্যে কর বৃদ্ধি এবং এর মাধ্যমে তামাকের ব্যবহার রোধ করা একটি ব্যয় সাশ্রয়ী

পদক্ষেপ। দেশের নীতি-নির্ধারকদের উচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে দেশের অর্থনীতি এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাকপণ্যে উচ্চ হারে কর আরোপ করা, যা দেশের রাজস্ব বৃদ্ধি করতে এবং ধূমপায়ীর সংখ্যা কমাতে সহায়তা করবে এবং সর্বোপরি  দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে অগ্রগামী করবে। 

(লেখক:  সাবেক সংসদ সদস্য,  প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন।)

শরীর ও মন থেকে আরও পড়ুন

শরীর ও মন সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status