ঢাকা, ১৬ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

পিয়াজ কারসাজিতে পুরনো সিন্ডিকেট

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
১২ ডিসেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার
mzamin

পিয়াজের বাজার রীতিমতো টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। হঠাৎ করে দ্বিগুণের বেশি দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের পকেট থেকে শত কোটি টাকা লুট করছেন অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চক্র। অথচ দেশের বড় বড় মোকাম, আমদানিকারকের গুদাম, পাইকারি এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের কারও কাছেই পিয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। সরকারের কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চাহিদার চেয়েও উদ্বৃত্ত বা মজুত রয়েছে ৬ থেকে ৭ লাখ টন পিয়াজ। দেশের সবচেয়ে বড় বাজার কাওরান বাজারের আড়তেও সারি সারি বস্তায় পিয়াজের স্তূপ দেখা গেছে। অথচ উদ্বৃত্ত থাকার পরেও রাতারাতিই শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে পুরনো সেই সিন্ডিকেট। তাদের কোনো শাস্তিও হয়নি। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিয়াজের সংকটের কারণে দাম বাড়েনি। ভারতের পিয়াজ রপ্তানি বন্ধের মেয়াদ বৃদ্ধির খবরকে অজুহাত হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন সিন্ডিকেট চক্র। তা-না হলে এক রাতের মধ্যে ১২০ টাকার পিয়াজ কীভাবে ২৪০ টাকা কেজি হয়। খোদ বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষও বলেছেন, কীভাবে ১২০ টাকার পিয়াজ ২৫০ টাকা হয়।

বিজ্ঞাপন
পিয়াজ ব্যবসায়ীরা দায়িত্বশীল আচরণ করেননি। তারা সুযোগ নিয়েছেন। 

তারা বলেছেন, এই মুহূর্তে দেশে পিয়াজের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। এ বছরে পর্যাপ্ত পিয়াজ উৎপাদন হয়েছে। আমদানিও হয়েছে চাহিদার চেয়ে বেশি। ফলে বাজারে এ পণ্যের কোনো সংকট নেই। তারপরও কথিত সিন্ডিকেট ভারতের পিয়াজ রপ্তানি বন্ধের দোহাই দিয়ে পরিকল্পতিভাবে এর দাম বাড়াচ্ছে। 

জাতিসংঘের পণ্য বাণিজ্য পরিসংখ্যানের তথ্যভাণ্ডার (ইউএন কমট্রেড) অনুযায়ী, পিয়াজ আমদানিতে বিশ্বে ১ নম্বর বাংলাদেশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ ৭ লাখ ২৭ হাজার টন পিয়াজ আমদানি করে। ওই বছর আর কোনো দেশ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি পিয়াজ আমদানি করেনি। ইউএন কমট্রেড অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশের পর সবচেয়ে বেশি পিয়াজ আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের আমদানির পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৬০ হাজার টন। 

এদিকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের দিক থেকেও বাংলাদেশ খুব পিছিয়ে নেই। পিয়াজ উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় আছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, পিয়াজ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। তবে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন দিয়ে চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশে চাহিদার চেয়েও ৬ থেকে ৭ লাখ টন পিয়াজ উদ্বৃত্ত থাকার কথা। তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে রবি ও গ্রীষ্মকালীন- দুই মৌসুমে মোট ২ লাখ ৪৮ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে পিয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ ৭৮ হাজার ৫০০ টন। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৪ লাখ ১৬ হাজার ৯৯৯ টন। আর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ২ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে পিয়াজের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৭ লাখ ২৫ হাজার ৭০০ টন। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, দেশে বছরে ৩৪ লাখ টনের বেশি পিয়াজ উৎপাদন হলেও জমি থেকে উত্তোলনের সময়, এরপর সংরক্ষণ ও পরিবহনের সময় উৎপাদিত মোট পিয়াজের প্রায় ২৫ ভাগ নষ্ট হয়ে যায়। এ হিসাবে ৩৪ লাখ টনের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায় ৬ থেকে ৭ লাখ টন পিয়াজ। অর্থাৎ পিয়াজের অভ্যন্তরীণ নিট উৎপাদন দাঁড়ায় ২৬ থেকে ২৭ লাখ টন। 

অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে পিয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৭ থেকে ২৮ লাখ টন। এরমধ্যে প্রতি মাসে দরকার হয় ২ লাখ টন, আর রমজান মাসে বাড়তি দরকার হয় ৩ থেকে ৪ লাখ টন পিয়াজ।

এদিকে বছরে ভারত, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পিয়াজ আমদানি করা হয়েছে ৭ লাখ টন। আর দেশে উৎপাদন ২৬ থেকে ২৭ লাখ টন। এর সঙ্গে আমদানিকৃত ৭ লাখ টন পিয়াজ যুক্ত করা হলে বছরে দেশের বাজারে পিয়াজের মোট জোগান দাঁড়ায় ৩৩ থেকে ৩৪ লাখ টন। এদিকে বছরে মোট চাহিদা ২৭-২৮ লাখ টন। অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে দেশে পিয়াজ উদ্বৃত্ত থাকছে ৬ থেকে ৭ লাখ টন। তার মানে দেশে পিয়াজের ঘাটতি বা সংকট নেই।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মনে করেন, পিয়াজের দাম বেড়েছে ব্যবসায়ীদের কারসাজির জন্য। কারণ দেশে পর্যাপ্ত পিয়াজের জোগান রয়েছে। নতুন পিয়াজও উঠতে শুরু করেছে। 
কাওরান বাজারের ভেতরে আড়তে সারি সারি বস্তায় পিয়াজের স্তূপ দেখা গেছে। আরেক আড়তদার জানান, আমরা পার্টির কাছ থেকে মাল নেই। আমরা হলাম দ্বিতীয় পর্যায়। পার্টি এলসি দিয়ে ভারত থেকে পিয়াজ আমদানি করে, তাদের কাছ থেকে আমরা কিনে নেই। এবার আমাদের কাছ থেকে ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে চতুর্থ ধাপে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছায়। তিনি বলেন, এই প্রতিটি ধাপেই পিয়াজের দাম বাড়তে থাকে। 

প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিদিন দেশে পিয়াজের চাহিদা ৭ হাজার ৬৭১ টন বা ৭৬ লাখ ৭২ হাজার কেজির চাহিদা রয়েছে। প্রতি কেজিতে গড়ে অতিরিক্ত ১০০ টাকা মুনাফা করলে দিনে মুনাফা হচ্ছে ৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ভোক্তার পকেট থেকে অতিরিক্ত মুনাফা হিসাবে সিন্ডিকেটের পকেটে যাবে এই টাকা।

কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরকার সংশ্লিষ্টদের যথেষ্ট গাফিলতি আছে। দেশে পর্যাপ্ত পিয়াজ আগে থেকেই মজুত আছে। এটা মূলত হয়েছে সুশাসনের ঘাটতির কারণে। ব্যবসায়ীরা যেমন খুশি দাম নির্ধারণ করছে, সরকারের কোনো বিধিবিধানের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। আর শাস্তিও হচ্ছে না। 

এদিকে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। পিয়াজের বাজারে নামানো হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার টিম। একইসঙ্গে সারা দেশে ব্যাপক অভিযান শুরু করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। পাশাপাশি আগের এলসি খোলা পিয়াজভর্তি ট্রাক আসতে শুরু করেছে দেশে। এ ছাড়া টিসিবি’র জন্য কেনা ৩ হাজার ৪০০ টন পিয়াজ দ্রুত ছাড়তে ভারত সরকারকে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এসব উদ্যোগের ফলে পিয়াজের দাম কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর বাইরেও বাজারে মুড়িকাটা নতুন পিয়াজ উঠতে শুরু করেছে। এর প্রভাবে দাম কিছুটা কমার আশা করা হচ্ছে।

এদিকে গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠকের ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেছেন, হঠাৎ পিয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় মাঠ পর্যায়ে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে সরকার। সচিব বলেন, যারা এসব কাজের সঙ্গে জড়িত এবং অতিরিক্ত মুনাফা পাওয়ার চেষ্টা করছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। 

ওদিকে দেশি মুড়িকাটা পিয়াজের চালান বাজারে আসতে শুরু করেছে। রাজধানীর পিয়াজ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন মুড়িকাটা পিয়াজ খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ১৩০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে পাতাসহ নতুন পিয়াজও এসেছে। দাম পড়ছে প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৮০ টাকায়। এই ধরনের পিয়াজ কিনতে ক্রেতাদের আগ্রহ দেখা গেছে। 

উল্লেখ্য, আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত পিয়াজ রপ্তানি বন্ধের মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। এমন খবরে বাংলাদেশের বাজারে রীতিমতো প্যানিক ছড়িয়ে পড়ে। ঘোষণাটি ছিল গত শুক্রবার সকালে। তখন পিয়াজের কেজি ছিল ১০০ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে। পরের দিন অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে এক রাতের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়ে প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ মানভেদে ২৪০-২৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

পাঠকের মতামত

এখন থেকে একজন সিন্ডিকেট মন্ত্রী রাখা হোক

sayeed
১২ ডিসেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ৩:০১ পূর্বাহ্ন

আট বছর কেনিয়া ছিলাম, ২ বছর আমেরিকাতে এবং বর্তমানে উগান্ডাতে। কোথাও জিনিষপত্রের দাম নিয়ে তেলেসমাতি কান্ড দেখিনি যা বাংলাদেশে প্রায়ই ঘটে। এর কারণ কি অসৎ ব্যবসায়ী আর দুর্নীতিগ্রস্থ কিছু সরকারি লোকদের সিন্ডিকেট। সরকার কে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

Mishu Mahmud
১১ ডিসেম্বর ২০২৩, সোমবার, ১০:০০ অপরাহ্ন

সিন্ডিকেটের মোকাবিলা করতে হবে জনগণের। দাম বৃদ্ধির পর পর বয়কট করতে হবে পেঁয়াজ কিনা। পেঁয়াজ ছাড়াও তরকারি খাওয়া যায় পাঁচ পূরণ দিয়ে । আমী লিবিয়াতে ছিলাম। কখনও পেঁয়াজ কখনও রসুন পাওয়া যেত না । মাসের পর মাস। আমরা ঠিকই পেঁয়াজ বা রসুন ছাড়া মাসের পর মাস তরকারি খেয়েছি। হিন্দুর সম্প্রদায় পেঁয়াজ খায় না । তারা ঠিকই মজার তরকারি খায়। তাদের কাছ থেকে রান্নার পদ্ধতি শিখার দরকার। পেঁয়াজ দীর্ঘদিন মজুদ রাখা যায় না, বয়কট করলে পেঁয়াজ পঁচার ভয়ে মজুমদার নায্য দামে বিক্রি করবে । জনগণ যদি বুঝিয়ে দিতে পারে অন্যায় ভাবে দাম বৃদ্ধির সুযোগ নাই তবে এই প্রবণতা বন্ধ হতে বাধ্য হবে তারা ।

Kazi
১১ ডিসেম্বর ২০২৩, সোমবার, ৮:০০ অপরাহ্ন

দেশটাই তো সিন্ডিকেটের কব্জায়।

Nur Abser
১১ ডিসেম্বর ২০২৩, সোমবার, ৭:৩৫ অপরাহ্ন

আমাদের সরকার বানিজ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা সবাই জানেন এদেশে পেঁয়াজ আমদানি এবং এর নিয়ন্ত্রণ কাদের কাছে আছে এসব কিছু জেনে ও যদি এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্হা না নিয়ে সিন্ডিকেট বলে জনগণকে ছয় নয় বুঝানো হয় তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে হয়তো কোন একদিন এর জনবিস্ফোরণ ঘটবে।

Kzaman
১১ ডিসেম্বর ২০২৩, সোমবার, ৬:২৯ অপরাহ্ন

সরকার সর্বক্ষেত্র ব্যর্থ এটা প্রমাণ করেছে এই কথাটা কেউ বলছেনা সবাই দায়ী করছে সিণ্ডিকেট, অসাধু ব্যবসায়ী, মজুতদার, আড়তদার এদের নিয়ন্ত্রণ করাতো সরকারেরই দায়ীত্ব। ভারত সরকাকারকেই দেখুন গত ছয় মাস আগে থেকে নিত্য পণ্য যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে তার জন্য পণ্যের মূল্যর রফতানি দর বাড়িয়ে দিয়েছে এবং সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে রফতানী বন্ধ করেছে। এ ধরণের দূরদর্শী চিন্তা আমাদের দেশের প্রধান মন্ত্রী থেকে কারও মধ্যে আছে? এজন্যই জনগণকেই এর মাশুল গুনতে হচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য ভারতেও এ বৎসর নির্বাচনের বৎসর।

Milon Azad
১১ ডিসেম্বর ২০২৩, সোমবার, ১১:৫৩ পূর্বাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status