প্রথম পাতা
‘মায়ের কবরে তুই মাটি দিবি না?’
রিপন আনসারী, মানিকগঞ্জ থেকে
১১ মে ২০২৪, শনিবার
‘মাকে রেখে কেন চলে গেলি রে বাবা। মায়ের কবরে তুই মাটি দিবি না? আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো, কে বলবে, আম্মু তুমি খাইছো?’ এ আর্তনাদ চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত পাইলট আসিম জাওয়াদ রিফাতের মা নিলুফা আক্তারের। একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই কখনো চিৎকার করে, কখনো নীরবে কাঁদছেন আবার কখনো কখনো মূর্ছা যাচ্ছেন। মানিকগঞ্জ শহরের নগর ভবন সড়কের গোল্ডেন প্লাজায় সপ্তম তলা থেকে নিহত পাইলটের মায়ের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠছে সেখানকার পরিবেশ।
স্বজনরা কেউ তার মুখে খাবার তুলে দিতে গেলে তাদেরকে বলছেন, ছুটিতে বাড়িতে এলে আমার বাবা আমাকে ছাড়া খেতে বসতো না। একা একা ছাদে দিয়ে যেতে দিতো না। সব সময় আমার খেয়াল রাখতো। বলতো আম্মু তুমি ভাত খাও, আম্মু নাস্তা খাও। আমি না খেলে আমার বাবা খেতো না। এখন কে বলবে আম্মু তুমি খাইছো? ছেলের উদ্দেশ্যে তিনি বিলাপ করে বলছেন, তুই না আসলে আমি খাবো না বাবা, বলেই মূর্ছা যাচ্ছেন মা নিলুফা আক্তার। এদিকে বিমান দুর্ঘটনায় রিফাতের নিহতের খবর পাওয়ার পরপরই বৃহস্পতিবার দুপুরে তার চিকিৎসক বাবা আমান উল্লাহ চট্টগ্রাম চলে যান।
জাওয়াদ স্ত্রী ও ছোট ছোট দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে নিজের কর্মস্থল চট্টগ্রামে বসবাস করতেন। গ্রামের বাড়ি সাটুরিয়া উপজেলার গোপালপুর হলেও মূলত পরিবার নিয়ে মানিকগঞ্জ শহরে বসবাস করছেন। শুক্রবার বেলা ১২টার দিকে রিফাতের মরদেহ আনা হয় মানিকগঞ্জে। তার মামা বাংলাদেশ বেতারের মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি সুরুজ খান জানান, দুর্ঘটনার পরপরই তাদের কাছে খবর আসে। এরপর থেকেই জাওয়াদের মা ও পরিবারের সদস্যদের কান্না আর আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে সে ভাষাও হারিয়ে ফেলেন সবাই। নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে পুরো পরিবারটি।
তিনি বলেন, জাওয়াদের ছোটবেলা থেকেই পাইলট হওয়ার স্বপ্ন ছিল। সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক অ্যান্ড স্কুল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর প্রশিক্ষণ শেষে বিমান বাহিনীতে যোগদান। প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন মেধাবী জাওয়াদ। পেশাগত জীবনে পেয়েছেন সোর্ড অব অনারসহ বিভিন্ন সম্মাননা। পাইলট হওয়ার স্বপ্নপূরণ পায় সে খুব খুশি ছিল। কিন্তু জীবনে আরও বড় হওয়ার আশা অকালেই নিভে গেল। খালা পারভীন আক্তার বলেন, আমার ভাগ্নের মতো একজন সোনার ছেলে এ যুগে পাওয়া কঠিন। ছুটিতে বাড়িতে এলেই আমার কাছে ছুটে আসতো। ওর জন্য খাবার আয়োজন করতে গেলে আমাকে রান্না করতে দিতো না। বলতো তোমার কষ্ট হবে। যে কয়দিন বাড়ি থাকবো বাইরে খেয়ে নেবো। এমন মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। খালাতো ভাই শিমুল বলেন, জাওয়াদ শুধু আমাদের পরিবার নয়, বাংলাদেশের একজন চৌকস অফিসার ছিলেন। সবকিছুতেই সে ছিল পারদর্শী। ওর মৃত্যুতে আমরা পুরো পরিবার শোকাহত।
নানার কবরে শায়িত জাওয়াদ: শুক্রবার বেলা ১২টার দিকে বিমান বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে আসিম জাওয়াদের মরদেহ নামানো হয় মানিকগঞ্জ শহীদ মিরাজ তপন স্টেডিয়ামে। এর আগে সকাল থেকে পরিবারের সদস্য ও এলাকার বিপুলসংখ্যক বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ স্টেডিয়ামে অপেক্ষা করেন তার মরদেহ দেখার জন্য। বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে বিমান বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার রান করে স্টেডিয়ামে। ছেলের মরদেহ প্রথমে তার মাকে দেখানো হয়। এসময় মায়ের আর্তচিৎকারের ভারী হয়ে উঠে মানিকগঞ্জ শহীদ মিরাজ তপন স্টেডিয়ামটি। পরিবারের প্রত্যেকটা সদস্য এসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন। এসময় নিহত পাইলটের অবুঝ দুই শিশু ও স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে বিলাপ করতে থাকেন নিলুফা আক্তার।
জুমার নামাজ শেষে বেলা ২টার দিকে শহীদ মিরাজ তপন স্টেডিয়ামে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় শহরের সেওতা কবরস্থানে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সেখানে তার নানা মরহুম আব্দুর রব খানের কবরেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন পাইলট আসিম। বিমান বাহিনী, সেনাবাহিনী ও নৌ-বাহিনীর সদস্যরা এসময় উপস্থিত ছিলেন। আসিম জাওয়াদ ২০১১ সালে চাকরিতে যোগদান করেন। তার গ্রামের বাড়ি সাটুরিয়া উপজেলার গোপালপুর গ্রামে।
পাঠকের মতামত
আবদুল্লাহ মঈন-ঠিক বলেছেন ভাই। সাধারণ মানুষের কোনো মূল্য নাই। যার টাকা বেশি তার তত সম্মান বেশি।
আমি তাজ্জব বনে যাই, দেখি গরীব হওয়ায় মানুষের জীবনের কোন দাম নাই এই সমাজে। আর ধনী হলে কত দাম দেয় এই সমাজ। আমি আরো তাজ্জব বনে যাই যখন দেখি আমিও মানুষ, এই ধনী শ্রেণীও মানুষ, আমি কত বিপদে থাকি কত ভাবে নৃশংস হয়ে মারা যাই, কোন খোজ নাই, কিন্তু বৈষম্যের সমাজ যাদের নিয়ে নাচে, আমিও সেখানে তাল মিলাই।
মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা করি। কিন্তু কথা প্রশিক্ষণরত বিমানে ফ্লাই হবার আগে বিমানের ইঞ্জিন নিশ্চয় চেক করেই তারা বিমানে উঠছে, কথা হল চেকটা ঠিকমতো করেনি? সিডিউল মেইনটেইন করলে ক্রটি দেখা যেত, তাহলে কি যথাযথ ভাবে ইঞ্জিন রক্ষণা বেক্ষণ হয়না?
Very unfortunate and sad. My thoughts and prayers are with his family. May Allah bless his heart and put him in heaven...