প্রথম পাতা
একটি পিটিআই প্রতিবেদন
বাংলাদেশের গণতন্ত্র লাইফ সাপোর্টে
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শুক্রবারআগামী বছরের নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণের আগেই বাংলাদেশ একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক সংকটের মুখে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বেশ ভঙ্গুর। স্বাধীনতার প্রথম কয়েক দশকেই একাধিক অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থান দেখে বাংলাদেশ। হত্যা করা হয় দেশটির প্রথম রাষ্ট্রপতিকে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে একদলীয়, সামরিক, গণতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচারী- সবধরনের শাসন ব্যবস্থাই দেখা গেছে। ভারতের সরকারি সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানায়- বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা এখন অনেকটাই রাশিয়ার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। একদল অলিগার্ক প্রচুর আর্থিক সুবিধা ভোগ করছে এবং বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রাখার জন্য প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের কথা রয়েছে। এর আগে দেশের প্রধান বিরোধী দল ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’- একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সরকারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। তারা একের পর এক বিশাল সমাবেশ নিয়ে রাজপথে সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে সর্বশেষ অবাধ ও সুষ্ঠু বলে বিবেচিত নির্বাচনটি হয়েছিল ২০০৮ সালে। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন শেখ হাসিনা। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনগুলো ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত। ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করেছিল বিরোধী দলগুলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া সহ প্রধান উদারপন্থি গণতান্ত্রিক দেশগুলো একটি নতুন ভোটের আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু ভারত, রাশিয়া এবং চীন নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা বলেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে, তখন চীন ও রাশিয়া বর্তমান সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। শেখ হাসিনার উপর সামপ্রতিক মার্কিন চাপ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত বলেছেন যে, তার দেশ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। আবার রাশিয়াও বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের হস্তক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে।
একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়তো বাংলাদেশের স্বৈরাচারী শাসন বন্ধ করতে পারবে এবং এর মধ্য দিয়ে বৃহত্তর জবাবদিহিতার পথও প্রশস্ত হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন সংকটময় সময় পার করছে এবং দেশের বেকারত্ব ক্রমশ বাড়ছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার বেশির ভাগই তরুণ। এখন একটি কার্যকর গণতন্ত্রই বাংলাদেশের সামনে একমাত্র আশা। যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মানলে আগামী নির্বাচন বয়কট করতে পারে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। তারা সম্ভবত দেশব্যাপী বিক্ষোভ অব্যাহত রাখবে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধীরা অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে বিরোধীদের দমন, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং ব্যাপক ভোট কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল তাদের এক জরিপে ৫০টি আসনের মধ্যে ৪৭টিতেই একাধিক অসঙ্গতি খুঁজে পেয়েছিল। শেখ হাসিনা জোর দাবি করেছেন যে, তার শাসনামলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণেই জনগণ তার সঙ্গে রয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘ থেকে শুরু করে মার্কিন অর্থনীতিবিদ জেফ্রি শ্যাসও তার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন।
যদিও বাংলাদেশের পুলিশ, বিচার বিভাগ এবং রাষ্ট্রীয় আমলাদেরকে শেখ হাসিনার প্রতি অনুগত হিসেবে দেখা হয়। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আরও ব্যবস্থা নেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। এরমধ্যে আছে, নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি এবং সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে ঘোষিত বিশেষ ভিসা নীতি।
এক সময় নির্বাচন বাংলাদেশে উৎসবের কারণ ছিল। কিন্তু এখন লক্ষ লক্ষ তরুণ দেখছেন যে, তাদের নিজের নেতা নির্বাচন করার মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। আবার বাকস্বাধীনতাবিরোধী কঠিন আইন তাদের ক্ষমতাবানদের সমালোচনা করার ক্ষমতা হ্রাস করেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং সমালোচক ও বিরোধী ব্যক্তিদের কারাদণ্ডসহ নৃশংস কৌশল অনুসরণের অভিযোগ এনেছে।
হিউম্যান রাইট্স ওয়াচের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ৬০০ জনেরও বেশি মানুষ নিখোঁজ হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীগুলো ২০১৮ সাল থেকে ৬০০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত রয়েছে। সুইডিশ অনুসন্ধানী সংবাদ সাইট নেত্র নিউজ ঢাকা সেনানিবাসে আয়নাঘর নামে একটি গোপন কারাগার খুঁজে পায়। সেখানে এই নিখোঁজ ব্যক্তিদের আটক করে রাখা হয়েছে অভিযোগ করেছে তারা। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং এর ছয়জন প্রাক্তন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দুই প্রাক্তন পুলিশ কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের উপরও ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট। নিউ ইয়র্ক টাইমস সমপ্রতি এক রিপোর্টে দাবি করেছে যে, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ রাজনৈতিক হয়ে উঠেছে। দেশে লাখ লাখ বিরোধী নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিচার চলছে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে ১৯৮টি মামলা চলছে আদালতে। একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল যিনি বলেছিলেন যে, ইউনূস বিচারিক হয়রানির শিকার
হয়েছেন তাকেও বরখাস্ত করা হয়েছে।
‘দ্য ওয়ার্ল্ড জুরিস্ট প্রজেক্ট’-এর আইনের শাসন সূচকে ১৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৭তম। ফ্রিডম হাউস বাংলাদেশকে ‘পার্টলি ফ্রি’ বা আংশিক স্বাধীন দেশের শ্রেণিতে রেখেছে। সর্বশেষ বিশ্ব প্রেস ফ্রিডম সূচকে বাংলাদেশ ছিল ১৬৩তম অবস্থানে, যা আফগানিস্তান (১৫২) এবং কম্বোডিয়ারও (১৪৭) পেছনে। এদিকে বর্তমান সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সিঙ্গাপুর এবং অন্যান্য দেশে বাড়ি কিনেছেন এবং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন বলে জানা গেছে।