প্রথম পাতা
রায় নিয়ে মার্কিন দূতাবাসের উদ্বেগ
আদিলুর এলানের ২ বছরের কারাদণ্ড
স্টাফ রিপোর্টার
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শুক্রবারতথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারার মামলায় মানবাধিকার সংগঠন অধিকার’র সম্পাদক আদিলুর রহমান খান শুভ্র ও সংগঠনটির পরিচালক এএসএম নাসির উদ্দিন এলানের ২ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে তাদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। গতকাল ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এএম জুলফিকার হায়াত এই রায় ঘোষণা করেন। এটা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের প্রথম মামলা। রায় ঘোষণার পর আদিলুর রহমান খান ও নাসির উদ্দিন এলানকে কারাগারে পাঠানো হয়।
বিকাল সোয়া ৩টার দিকে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের এজলাস থেকে পুলিশ বেষ্টনীতে কারাগারে নেয়ার সময় আদালতের করিডোরে আদিলুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা ন্যায়ের জন্য কাজ করেছি। এ রায়ের বিরুদ্ধে আমি সন্তুষ্ট নই। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবো। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা গুম হওয়া মানুষের হয়ে কাজ করেছি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। রাষ্ট্র যদি এজন্য শাস্তি দেয় আমরা তা আইনগতভাবে মোকাবিলা করবো।
দুই পক্ষের আইনজীবী যা বলেন: আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর নজরুল ইসলাম।
মামলার রায় পর্যবেক্ষণ করতে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম উপস্থিত ছিল। উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকার সংগঠনের নেতৃবৃন্দও। আলোচিত এই মামলার রায় ঘিরে ঢাকার আদালতের এজলাসের সামনে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। দুপুর পৌনে ২টার দিকে পুলিশ সদস্যদেরকে আদালতের এজলাসের সামনে অবস্থান নিতে দেখা যায়।
২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে পুলিশি অভিযানের পর সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অভিযোগ তুলেছিল যে, পুলিশের অভিযানে ‘বহু মাদ্রাসার ছাত্র নিহত’ হয়েছে। এনিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা প্রচারণাও চলে। তখন মানবাধিকার সংস্থা অধিকার তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, শাপলা চত্বরে পুলিশের অভিযানে ৬১ জন নিহত হয়েছে। এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে সরকারের তরফ থেকে। এরপর মামলা করা হয় মানবাধিকার সংস্থা অধিকার’র দুই শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
এর আগে গত ২৪শে আগস্ট রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে এই মামলার রায়ের জন্য ৭ই সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেন আদালত। তবে ওইদিন রায় প্রস্তুত না হওয়ায় পরবর্তীতে ১৪ই সেপ্টেম্বর নতুন দিন ধার্য করা হয়। সেদিন এডভোকেট রুহুল আমিন ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, আশা করি রায়ে দু’জনই বেকসুর খালাস পাবেন।
আদিলুর রহমান খান পেশায় সর্বোচ্চ আদালতের আপিলেট ডিভিশনের আইনজীবী হিসেবে কর্মরত। ছাত্রজীবন থেকে তিনি বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আর পরিচালক নাসির উদ্দীন এলান অধিকার’র পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের আগে সাংবাদিকতা পেশায় জড়িত ছিলেন।
২০১৩ সালে দায়ের হওয়া এই মামলার আসামি অধিকার’র সম্পাদক আদিলুর রহমান এবং সংগঠনটির পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলান।
২০১৩ সালের ৫ই মে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের সরিয়ে দেয়ার ঘটনায় ৬১ জন নিহত হওয়ার কথা দাবি করেছিল অধিকার। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এই সংখ্যাটি ১৩ বলে জানানো হয়। ঘটনাটি নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগে ওই বছরের ১০ই জুন সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। একই বছরের ১০ই জুলাই তালিকাটি চেয়ে অধিকারকে চিঠি দেয় তথ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু তালিকা দিতে অস্বীকৃতি জানায় অধিকার। পরে ১০ই আগস্ট গ্রেপ্তার হন অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খান। পরদিন সংগঠনটির কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে কম্পিউটারে পাওয়া যায় ৬১ জনের নামের তালিকা। নিম্ন আদালত জামিন নাকচ করলে হাইকোর্ট ওই বছরের ৯ই অক্টোবর ছয় মাসের জামিন মঞ্জুর করেন আদিলুর রহমানের।
তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর ৩২ জনকে সাক্ষী করে আদিলুর ও এলানের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয়। ১২ই সেপ্টেম্বর দুই আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। ২০১৪ সালের ৮ই জানুয়ারি শুরু হয় বিচার কাজ। কিন্তু উচ্চ আদালতে আসামিদের আবেদনের প্রেক্ষিতে তিন বছরের জন্য স্থগিত হয়ে যায় বিচারকাজ। পরে ২০১৭ থেকে শুরু হয় শুনানি।
অধিকার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রায়ে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের উদ্বেগ
অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক নাসির উদ্দিন এলানকে আইসিটি মামলায় কারাদণ্ড দেয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস। গতকাল এক বিবৃতিতে দূতাবাসের পক্ষ থেকে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র মানুষের অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রচার ও সুরক্ষায় মানবাধিকারকর্মী এবং সুশীল সমাজ সংগঠনগুলোর কার্যক্রমকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। আমাদের ‘২০২২ কান্ট্রি রিপোর্ট অন হিউম্যান রাইটস ইন বাংলাদেশ’ প্রতিবেদনে ‘অনলাইন এবং অফলাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা’ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো ‘বিশেষ সরকারি বিধিনিষেধের সঙ্গে পরিচালিত’ হওয়ার কথা তুলে ধরা হয়েছে। ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস মানবাধিকার সংগঠন অধিকার’র সম্পাদক আদিলুর রহমান খান এবং পরিচালক এএসএম নাসির উদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে রায়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং মনে করছে এটি মানবাধিকারকর্মী এবং সুশীল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক ভূমিকা পালনের সক্ষমতাকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে। যেই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, অধিকার কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিবেদন তৈরি করেছে। গণতন্ত্রের অপরিহার্য অংশ হিসেবে আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজকে অব্যাহতভাবে সমর্থন করি এবং মৌলিক অধিকার নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টার বিরোধিতা করি।