ঢাকা, ১৯ মে ২০২৪, রবিবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

ডেঙ্গুতে এত মৃত্যু কেন?

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, রবিবার
mzamin

এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ৭০০ ছাড়িয়েছে। দিন যত যাচ্ছে, দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির ততই অবনতি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগী বাড়লেই মৃত্যু বাড়বে। প্রশ্ন হলো- ডেঙ্গুতে এত মৃত্যুর কারণ কী?

জানতে চাইলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগীরা হাসপাতালে দেরিতে আসছেন। মৃত্যুর আরেকটি কারণ হিসেবে বাংলাদেশের আবহাওয়াকেও দায়ী করেছেন তারা।

বাংলাদেশে ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ বিস্তারের জন্য জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী মনে করছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বিশেষজ্ঞরাও। এটিকে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপদের হাতছানি বলে মন্তব্য করেন তারা।
বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৬৫ সালে। তখন এই রোগটি ঢাকা ফিভার নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে রোগটির সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। ২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গু শনাক্ত হলেও ২০২২ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ ছিল। সেই বছরে দেশে সর্বোচ্চ মারা যায় ২৮১ জন।

বিজ্ঞাপন
তখন এটাই ছিল সর্বোচ্চ প্রাণহানি। এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু খুবই দ্রুত বাড়ছে। ইতিমধ্যে ৭০০ প্রাণহানি ছাড়িয়েছে। আক্রান্তও প্রায় দেড় লাখ। 

দেশে জুন থেকে সেপ্টেম্বর- এই চার মাসকে ডেঙ্গুর ভর মৌসুম ধরা হয়। কারণ, এ সময় বর্ষাকাল শুরু হওয়ায় বৃষ্টির পানি বিভিন্ন স্থানে জমে থাকে। আর এই প্রাদুর্ভাব চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তাই এই সময়টাকে ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশার প্রজননকাল ধরা হয়। কিন্তু এবার মৌসুম শুরুর আগেই ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। অবশ্য বছরের শুরু থেকেই ডেঙ্গুর বিস্তার দেখে স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃপক্ষ আশঙ্কাময় ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন এবং সবাইকে সতর্ক করে আসছিলেন। 

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দিতে সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য বিভাগের পরিকল্পনায় ঘাটতি ছিল। তাদের অভিমত, এক সময় বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগটিকে ‘মৌসুমি রোগ’ বলে মনে করা হতো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বছরজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভাইরাসটিও আগের তুলনায় শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। অথচ সংশ্লিষ্টরা সেদিকে নজর না দেয়ায় এর ভাইরাস মারাত্মক হয়ে উঠেছে। 

ডেঙ্গুতে মৃত্যু কেন বেশি জানতে চাইলে দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, এবার ডেঙ্গুতে বেশি মৃত্যুর কারণ মনে হচ্ছে রোগীরা হাসপাতালে দেরিতে আসছেন। ফলে হাসপাতালে মৃত্যুর হার বেড়ে যাচ্ছে। তবে হাসপাতালগুলো মৃত্যুর প্রতিটি কারণ বিশ্লেষণ করলে বৈজ্ঞানিক তথ্য পাওয়া যাবে। এখনো আমরা বৈজ্ঞানিক কোনো তথ্য পাইনি। তিনি বলেন, হাসপাতালগুলোতে রোগী ব্যবস্থাপনায় তেমন সময় দেয়া হয় না। ফলে গবেষণার ক্ষেত্র খুবই কম। সিটি করপোরেশন মশা মারা আর স্বাস্থ্য বিভাগ চিকিৎসা সামলানোর দায়িত্বে রয়েছে। অথচ তারা কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে পরস্পরকে দায়ী করে বক্তব্য দিচ্ছে। মশা দমনে দেশজুড়ে বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এমনকি এখন মশা দমনে ব্যবহৃত ওষুধের কার্যকারিতা আছে কিনা, তা কারও জানা নেই। আর স্বাস্থ্য বিভাগ এখন পর্যন্ত ভাইরাসজনিত রোগ ডেঙ্গু নিয়ে কোনো কার্যকর গবেষণা করতে পারেনি। এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর আরেকটি কারণ হিসেবে বাংলাদেশের আবহাওয়াকেও দায়ী করেন এই বিশেষজ্ঞ। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ণসহ বিভিন্ন কারণে এখন সারা বছরই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু চলতি বছরে মে মাসের শেষ দিক থেকে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সম্প্রতি জানিয়েছে, ঢাকার প্রায় সবাই ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার এক থেকে তিনদিনের মধ্যেই প্রায় ৮০ শতাংশ মৃত্যু হচ্ছে। বাকিদের মধ্যে চার থেকে ১০ দিনের মধ্যে মৃত্যু হচ্ছে ১৪ শতাংশের আর ১১ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে মৃত্যু হচ্ছে বাকি ৬ শতাংশের। বর্তমানে দেশের ৬৪টি জেলাতেই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। 
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন রয়েছে ডেন-১, ২, ৩ ও ৪। এবার এই চার ধরনের মধ্যে একাধিক ডেন থাকলেও চলতি বছরে ডেন দুই এবং তিনের সংক্রমণ বেশি হচ্ছে। গতবার যেটা ছিল তিন এবং চার। তবে একাধিক সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত রোগীদের সিভিয়ারিটি বেশি হয় এবং যত বেশি সিভিয়াটি থাকে, তত মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়তে থাকে।

ডেঙ্গুতে মৃত্যু এত বেশি কেন জানতে চাইলে খ্যাতিমান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, রোগীরা হাসপাতালে দেরিতে আসছেন। বিশেষ করে নারীরা দেরিতে ট্রিটমেন্ট নেন। নারীরা পরিবারের অন্য সদস্যদের কেয়ার করতে গিয়ে নিজেদের কথা ভুলে যান। কালক্ষেপণ করে হাসপাতালে আসেন। নারীরা রোদে কম যান। ফলে নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একটু কম। এসব কারণে তাদের বেশি মৃত্যু হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিয়ে বলেন, ডেঙ্গু জ্বর হলে কালক্ষেপণ না করে দ্রুতই রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

ডেঙ্গু রোগীদের ৬২ শতাংশ ডেন-২ দ্বারা আক্রান্ত: চলতি বছর দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আগের সব রেকর্ড এরইমধ্যে ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্তদের বেশির ভাগই ডেঙ্গু সেরোটাইপ-২ বা ডেন-২ দ্বারা আক্রান্ত বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। ডব্লিউএইচও প্রকাশিত বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সার্বিক অবস্থা নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৬২ শতাংশই সেরোটাইপ-২ বা ডেন-২ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এ ছাড়া ডেন-৩ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে ২৯ শতাংশ এবং ডেন-২ ও ডেন-৩ দ্বারা একসঙ্গে আক্রান্ত হয়েছে ১০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগী। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের জরিপের তথ্যের বরাতে ডব্লিউএইচও এ তথ্য জানিয়েছে। ৩২৫ জনের ডেঙ্গু রোগীর ওপর চালানো জরিপে এ তথ্য পাওয়া যায়। গত ২৮শে আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা অন্য বছরের তুলনায় আগেই বাড়তে শুরু করেছিল। চলতি বছর ডেঙ্গুতে একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৯৫৯ জন। এ ছাড়া একদিনে সর্বোচ্চ ২১ জনের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশে ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ বিস্তারের জন্য জলবায়ু সংকট এবং এল নিনো আবহাওয়া পরিস্থিতি দায়ী বলে মনে করছেন সংস্থাটির বিশেষজ্ঞরা। এটিকে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপদের হাতছানি বলে মন্তব্য করেন তারা।

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status