প্রথম পাতা
অনিয়মে ডুবছে সেন্ট্রাল হাসপাতাল
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
২৫ জুন ২০২৩, রবিবারনানা অনিয়মে ডুবছে সেন্ট্রাল হাসপাতাল। পরিচালনা পর্ষদের দ্বন্দ্বে গুণগত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ রোগীরা। পরিচালনা পর্ষদের দ্বন্দ্ব ও অতিরিক্ত মুনাফার লোভে হাসপাতালটিতে সেবার মান এখন ব্যাপক নিম্নগামী। হাসপাতালের বিরুদ্ধে গত কয়েক বছর ধরে নানা অনিয়ম ও অবহেলার অভিযোগ উঠছে অহরহ। প্রথিতযশা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এম আর খানের মৃত্যুর পর পথ হারায় হাসপাতালটি। দ্বন্দ্বের কারণে এম আর খানের মেয়েকেও হাসপাতালে ঢুকতে না দেয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। সম্প্রতি ভুল চিকিৎসায় নবজাতকসহ প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনায় আবারো আলোচনায় আসে এই স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রটি।
সূত্র বলছে, বর্তমানে হাসপাতালের পরিচালনা পর্ষদে ২৩ জন সদস্য রয়েছেন। এদের মধ্যে চারজন চিকিৎসক এবং বাকি ১৯ জন ব্যবসায়ী ও অন্যান্য পেশাজীবী। সেখানে কর্মরত অনেক চিকিৎসকের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এখন হাসপাতালটির লক্ষ্য শুধু বিপুল মুনাফা করা।
জাতীয় অধ্যাপক ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এম আর খানের হাত ধরে ২রা মে ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠা পায় সেন্ট্রাল হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠাতাদের আরেকজন ছিলেন ডা. মতিউর রহমানও। তিনি বর্তমানে চেয়ারম্যান। প্রথমে ছোট ভবন নিয়ে শুরু করলেও এখন ১২ তলা ভবনে ২৫৯ বেডের অনুমোদন নিয়ে হাসপাতালটি পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর প্রায় দেড় দশক শিশু ও মাতৃ চিকিৎসাসেবায় সুনাম অর্জন করেছিল বেসরকারি এ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রটি। ২০১৬ সালে ডা. এম আর খান মারা যাওয়ার পর রোগী ও তাদের স্বজনরা হাসপাতালের বিরুদ্ধে অপেশাদারিত্ব এবং ভুল চিকিৎসার বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে। তবে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা, অপচিকিৎসা ও চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ উঠতে শুরু হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা জানান, একুশে পদকপ্রাপ্ত ডা. এম আর খানের মৃত্যুর পর সেন্ট্রাল হাসপাতাল থেকে তার নাম মুছে ফেলার চেষ্টা চালায় পরিচালনা পর্ষদের একটি অংশ। অতি মুনাফার লোভে রোগীবান্ধব সেবাকেন্দ্রটিতে অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করা হয়। চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ এনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলাও হয় বেশ কয়েকবার।
জানা গেছে, সেন্ট্রাল হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন কুমিল্লার প্রসূতি মাহবুবা রহমান আঁখি। এর মধ্যে ৯ই জুন প্রসব ব্যথা উঠলে ওই প্রসূতিকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে আনা হয়। ভর্তি করা হয় ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে। যদিও সেদিন ওই চিকিৎসক হাসপাতালে ছিলেন না, যা রোগীর স্বজনদের কাছে গোপন করা হয়। উল্টো আঁখির স্বামী ইয়াকুব হোসেনকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, সন্তান প্রসবের চিকিৎসা সম্পর্কিত সবকিছু ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনেই হচ্ছে! পরিবারের অনুমতি না নিয়েই মধ্যরাতে আঁখির অস্ত্রোপচার করা হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পর মারা যায় তার নবজাতক। এদিকে অস্ত্রোপচারের পর প্রসূতির অবস্থারও অবনতি হয়। পরদিন বিকালে তাকে ভর্তি করা হয় পাশের ল্যাবএইড হাসপাতালে। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ই জুন মাহবুবা রহমান আঁখির মৃত্যু হয়। চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ এনে ধানমণ্ডি থানায় মামলা করেন আঁখির স্বামী ইয়াকুব। এতে আসামি করা হয় ডা. সংযুক্তা সাহা, হাসপাতালটির গাইনি বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসক, ব্যবস্থাপকসহ কয়েকজনকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানান, রোগীবান্ধব হাসপাতালটিকে বানানো হয়েছে প্রতারণার প্রতিষ্ঠান হিসেবে। সেন্ট্রাল হাসপাতালের বিরুদ্ধে বহু বছর ধরে বিভিন্ন অভিযোগ এসেছে। এখানে রোগীদের গোপনীয়তা রক্ষা করা হয় না। বিশেষায়িত সেবার নামে মোটা অঙ্কের বিল করা হয়। সাধারণত যে একবার এ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গিয়েছেন তিনি আর দ্বিতীয়বার যান না। বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে অভিযানও চালানো হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, হাসপাতালের পরিচালনা পর্ষদ দুই ভাগে বিভক্ত। পরিচালনা পর্ষদের দ্বন্দ্ব ও অতিরিক্ত মুনাফার লোভে হাসপাতালের সেবার মান নিম্নগামী হয়েছে।
সেন্ট্রাল হাসপাতালের অনিয়মের বিষয়ে এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. শেখ দাউদ আদনান মানবজমিনকে বলেন, ওই হাসপাতালের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত করছে মন্ত্রণালয়। অধিদপ্তরের এই বিষয়ে কিছুই করণীয় নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন। মালিকানা নিয়ে যে দ্বন্দ্বের কথা বলা হচ্ছে তা নিয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।
এদিকে নবজাতকের মৃত্যুর পর গত ১৬ই জুন সেন্ট্রাল হাসপাতাল পরিদর্শন করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় হাসপাতালটির বিরুদ্ধে বেশ কিছু বিধিনিষেধ জারি করা হয়। এর মধ্যে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ও জরুরি সেবার মান সন্তোষজনক না হওয়া পর্যন্ত হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লিখিত অনুমোদন ছাড়া বিশেষজ্ঞ সেবা দিতে পারবেন না ডা. সংযুক্তা সাহা। এ ছাড়া ভুক্তভোগী পরিবারের চিকিৎসা ব্যয় বহন, ওই রোগীর সব চিকিৎসক ও চিকিৎসাসংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্র বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) পাঠানো, আদালতে চলমান মামলায় অভিযুক্ত চিকিৎসকদের খরচ বহনসহ বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।
সেন্ট্রাল হাসপাতালে ২০১৭ সালের মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হাসপাতালটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলে গ্রেপ্তার হন বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এমএ কাসেম। অভিযোগে বলা হয়, ডেঙ্গু হলেও ওই ছাত্রীকে দেয়া হয় ক্যান্সারের চিকিৎসা। সে কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে। ২০১৮ সালে একটি ১৯ মাস বয়সী শিশু ভুল চিকিৎসার কারণে মারা যায়। এতে রোগীর স্বজনরা হাসপাতালের কর্মচারীদের লাঞ্ছিত ও হাসপাতাল ভাঙচুর করে।
এদিকে, ২০শে জানুয়ারি ২০২১-এ, এম আর খানের মেয়ে ডা. ম্যান্ডি করীম একটি সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছিলেন। সেন্ট্রাল হাসপাতালের ট্রাস্টি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে বলে জানান ডা. ম্যান্ডি করীম। ডা. এম আর খানের ও তার নিজের শেয়ার রয়েছে উল্লেখ করে তিনি ওই সময়ে দাবি করেন, তা সত্ত্বেও হাসপাতালে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না তাকে। তিনি বলেছিলেন তাকে ভয় দেখানো হয়েছিল যদিও তার বাবা এবং তার হাসপাতালে যথাক্রমে ৫৩,০০০ এবং ৯,০০০ শেয়ার ছিল। ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও চেয়েছিলেন এম আর খানের মেয়ে।
সেন্ট্রাল হাসপাতালের বর্তমান এই অবস্থাকে কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের গভর্নিং বডির সদস্য ডা. নিরুপম দাস মানবজমিনকে বলেন, ডা. এম আর খান স্যার মারা যাওয়ার পর হাসপাতালটির পতন শুরু হয়। মনে হচ্ছে ঠিকমতো সার্ভিস দিতে পারছে না। মানুষকে গুণগত সেবা নিশ্চিত করতে পারছে না। এখানে সেবার চেয়ে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য বেশি দেখা যাচ্ছে। ডা. এম আর খান স্যার যখন জীবিত ছিলেন তখন সেন্ট্রাল হাসপাতালের সুনাম ছিল। এখন হাসপাতালটির লক্ষ্য শুধু বিপুল মুনাফা করা। তিনি বলেন, অনিয়ম মেনে নিতে না পারায় প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অনেকেই বোর্ড ছেড়েছেন। সেন্ট্রাল হাসপাতালের বিরুদ্ধে গত কয়েক বছর ধরে নানা অনিয়ম ও অবহেলার অভিযোগ উঠেছে।
সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসা অবহেলা, রোগীদের প্রতারিত করার অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে হাসপাতালটির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এম এ কাসেম মানবজমিনকে বলেন, সেন্ট্রাল হাসপাতাল সব সময়ে গুণগত সেবা দিচ্ছে। তিনি বলেন, এখনো আমাদের সুনাম আছে। সার্বিক বিষয় নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত শেষ হলে আপনাদেরকে নিয়ে সম্মেলন করে সবকিছুই জানানো হবে। এর বেশি আর এই মুহূর্তে মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।