প্রথম পাতা
সরজমিন: হটস্পট কাওরান বাজার
তিন মিনিটে পাঁচ গাড়িতে ছোঁ
ফাহিমা আক্তার সুমি
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, সোমবার
তিশা রহমান। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। রাত ন’টায় অফিস শেষে বাসায় ফেরার জন্য বের হন। রাস্তা পারাপার হয়ে ফুটপাথ ধরে হাঁটছিলেন তিনি। এ সময় কবলে পড়েন ছিনতাইকারীর। তার হাতে থাকা ফোন পেছন থেকে টান মারে অল্প বয়সী এক কিশোর। এ সময় তিনি পেছনে ঘুরে তাকান। বুঝতে পেরে ফোনটি শক্ত করে ধরে রাখেন। এ সময় ছিনতাইকারী ফোন ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে পালায়। ওই নারী তাকে ফলো করে সামনের দিকে এগিয়ে যান। তার পেছনে পেছনে দৌড়ে আবার রাস্তার অপর পাশে চলে আসেন। সেখানে গিয়ে দেখেন মেট্রোরেলের লেনের নিচে ওত পেতে আছে ৬-৭ জনের একটি দল। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ওই কিশোর। তিশা বলেন, ওঁৎ পেতে থাকা কিশোর গ্যাংয়ের এই সদস্যদের টার্গেট মোবাইল ছিনতাই করা। দেখি তারা বাসের জানালা দিয়ে যাত্রীদের আবার কখনও পথচারীদের ফোন টার্গেট করে থাবা দিচ্ছে। ৬-৭ জনের ওই দলটি তিন মিনিটে পাঁচ গাড়িতে ছোঁ মেরেছে।
তিনি বলেন, আমি যখন ফুটপাথ থেকে হাঁটছি তখন বুঝতে পারি হাতে থাকা ফোনটির ওপরে একটি টান পড়ে। এরপর হালকা ঘুরে তাকিয়ে দেখি ১৩-১৪ বছর বয়সী একটি ছেলে। সে ফোনটি ধরে আছে। আমিও শক্ত করে ফোনটা নিজের আয়ত্তে নিয়ে নেই। তখন সে দৌড়ে চলে যায়। আমিও তার পিছনে দৌড়ে আবার রাস্তা পার হই। তাকে ফলো করতে থাকি। ছেলেটি কাওরান বাজারের মেট্রোরেলে লেনের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে একই বয়সী ৬-৭ জনের একটি দল দুই রাস্তার মাঝে মেট্রোরেলের লেনের নিচে ওঁৎ পেতে আছে। আমার ফোন টান দেয়া ছেলেটিও যুক্ত হয় তাদের সঙ্গে। এরমধ্যে আমি তেজগাঁও থানার ডিউটি অফিসারকে ফোন দেই। পাঁচমিনিটের মধ্যে দু’জন পুলিশ সদস্য চলে আসেন। তখনও আমি ছিনতাইকারীদের লক্ষ্য করছি। তারা কখনও পথচারীদের টার্গেট করছেন আবার কখনও বাস যাত্রীদের। কিছুক্ষণ পরপর বাসের জানালা দিয়ে দৌড়ে ছোঁ মারছে। তিন মিনিটের মধ্যে পাঁচ গাড়িতে ছোঁ মারতে তাদের দেখা যায়। পুলিশ আসার ঠিক দুই মিনিট আগে তাদের দলের দু’জন ছাড়া বাকি সবাই দৌড়ে চলে যায়। মনে হয়েছিল তারা কারও ফোন নিয়ে দৌড়ে পালিয়েছে। আমি দেখিয়ে দিলে পুলিশ সদস্যরা এসে বাকি দুইজনকে ধরে ফেললেন। কিন্তু যে আমার ফোন ধরে টান দিয়েছে সে বাকিদের সঙ্গে চলে যায়। তিনি বলেন, যেখান থেকে আমার ফোনটা টান দেয় সেখানে রাস্তার বেহাল দশা। পায়ের দিকে তাকিয়ে ছাড়া হাঁটলে বিপদ। যথেষ্ট আলো ছিলো না। আমি ইচ্ছে করলে ছিনতাইকারী শার্টের কলার ধরে রাখতে পারতাম। কিন্তু ওই অন্ধকারে এবং রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে আমি নিজেই হোঁচট খেয়ে ড্রেনের মধ্যে পড়বো। আরেকটি ভয় ছিল যদি ছুরিকাঘাত করে। যেটা প্রতিনিয়ত ঘটছে। পুলিশ ওই দুইজনকে ধরে আমাকে ডাকে। তার মধ্যে একজনের শার্ট খুলতে বললো। শার্ট খুলতেই দেখা যায় ৬-৭ জায়গা ছুরিতে কাটা। কাটা জায়গায় বড় বড় সেলাই দেয়া। এটাও ওদের একটা ফাঁদ। পুলিশ কিছুক্ষণ তাদের ধরে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করে। আমি রাত দশটা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকি। এর কিছুক্ষণ পরে আবার দৌড়ে যাওয়া সেই পাঁচজন মেট্রোরেলের লেনের নিচে দাঁড়িয়ে মানুষকে টার্গেট করতে থাকে। পরে কাওরান বাজারের সার্ক ফোয়ারার দিকে চলে যায়। আমি আবার পুলিশকে ফোন দিয়ে ওদের অবস্থান জানাই। রাস্তা থেকে হেঁটে আসবো নিজের জীবনের নিরাপত্তা নেই। এর আগে গত বছরের শুরুতে নিউ মার্কেট এলাকায় ঠিক এভাবে ফোন টান দিলে ছিনতাইকারীকে দৌড়ে ধরে পুলিশে দিয়েছিলাম। এসব জায়গায় অনেক নিরাপত্তা দরকার।
ফার্মগেট থেকে কাওরান বাজারের সার্ক ফোয়ারা মোড় হয়ে এফডিসি ক্রসিং, সাতরাস্তা মোড় এবং ট্রাকস্ট্যান্ড হয়ে তেজগাঁও রেলগেট পর্যন্ত রীতিমতো ছিনতাইকারীদের উৎপাত দেখা যায়। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত এসব এলাকায় চলে ছিনতাইয়ের রাজত্ব। জানা গেছে, ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা বাসের যাত্রীদের মোবাইল ফোন টান দিয়ে ভোঁ দৌড় দেয়া এখানকার নিয়মিত ঘটনা। একটু রাত বাড়লে হেঁটে আসা পথচারীদের কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দলবেধে আটকে ধরে। এদিক-সেদিক করলে ছুরি দিয়ে আঘাত করতে একটুও সময় নেয় না ভয়ঙ্কর এই ছিনতাইকারীরা।
গত রোববার কাওরান বাজারের সরজমিন দেখা যায়, সন্ধ্যা থেকে রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম। দুইপাশের গাড়ি থমকে আছে। সেই সঙ্গে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও মেট্রোরেলের কাজ চলছে। হঠাৎ চোখ যায় মেট্রোরেলের লেনের নিচে। ওয়াসা ভবনের কাছে থাকা ওভার ব্রিজের খানিকটা সামনে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৫-৬ জন উঠতি বয়সী তরুণ। তাদের মধ্যে খানিকটা তাড়াহুড়ো। এরই মধ্যে কাওরান বাজারের সার্ক ফোয়ারা মোড়ে সিগন্যাল ছেড়ে দেয়। কিছুক্ষণ পরে এই চক্রের দুইজন রাস্তায় নেমে যায়। জ্যাম থাকায় ধীরে ধীরে বাস চলছিল। বাসের জানালা দিয়ে মোবাইল ফোন টার্গেট করে একজন ছোঁ মারে। এরপর সঙ্গে থাকা অপরজন আরেকটি গাড়িতে ছোঁ মারছে। লেনের নিচে থাকা কয়েকজনও ওঁৎ পেতে আছে। সেখান থেকে একজন দৌড়ে গিয়ে একটি প্রাইভেটকারের জানালার গ্লাসে হাত দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। এরই মধ্যে লেনের উপর থেকে আরও দুইজন রাস্তায় নেমে পড়েন। তারাও চলতি গাড়ির মধ্যে থেকে দৌড়ে বাসের জানালা দিয়ে ছোঁ দিচ্ছে। ফুটপাথ থেকে হেঁটে যাওয়া পথচারীরা আতঙ্কিত হচ্ছেন। এই চক্রের সদস্যরা আবার কখনও কখনও সুযোগ বুঝে পথচারীদের পিছু ছুটছে। এ সময় আশেপাশে পুলিশের কোনো টহল গাড়ির দেখা মেলেনি। ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শীলা বলেন, আমি আর আমার এক বন্ধু এখানে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। আমি শাহবাগে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম। রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম থাকায় ভিতর থেকে আমরা হেঁটে চলে আসি। এখানে এসে থমকে যাই। হঠাৎ দেখি ৫-৬ জন ছেলে গাড়ির পিছে ছোটাছুটি করছে। এটা দেখে এখানে দাঁড়িয়েছি। তারা কিছুক্ষণ পরপর দেখি বাসের জানালা দিয়ে থাবা মারছে। একটি বাস রেখে আরেকটি বাসের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। বাস ছেড়ে চলে যাচ্ছে আবার আরেকটি বাস টার্গেট করছে।
দীর্ঘদিন ধরে ওয়াসা ভবনের অপর পাশে ফুটপাথে চায়ের দোকান করেন মো. সুজন। তাকে প্রায়ই দেখতে হয় ছিনতাইয়ের কোন না কোন ঘটনা। তিনি বলেন, এই ধরনের ঘটনা এখানে প্রায়ই ঘটে। ছিনতাইকারীদের পিছনে দেখি লোকজন দৌড়ায়। মাস খানেক আগে এক মহিলা ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এ সময় তার মোবাইল টান দিয়ে নিয়ে যায়। ওই মহিলা ছিনতাইকারীর পিছনে পিছনে দৌড়ে গেলেও পরে তাকে আর খুঁজে পাইনি। আমার দেখামতে, ফার্মগেট থেকে সোনারগাঁওয়ের মোড় পর্যন্ত অতিরিক্ত ছিনতাই হয়। একসপ্তাহ আগে আমার ছোট ভাই রাত নয়টার পরে বাংলামোটর থেকে হেঁটে সোনারগাঁও মোড়ে আসে। তাকে পাঁচ-সাত জনের একটি দল ছুরি ধরে ঘিরে রাখে। এ সময় তার ২০ হাজার টাকার মোবাইল ফোন এবং কাছে থাকা নগদ ৫ হাজার টাকা নিয়ে যায়। যখন ছুরি ধরে তখন আমার ভাই জীবনের ভয়ে সবকিছু দিয়ে দেয়। যাওয়ার সময় তাকে ছুরি দিয়ে মাথায় আঘাত করে। প্রতিদিনই এই জায়গাগুলোতে এই ধরনের ঘটনা ঘটে।
তেজগাঁও থানার এএসআই ইকবাল বারী বলেন, জানুয়ারি মাসে ছিনতাইয়ের ঘটনায় দুইটি মামলা হয়েছে। ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটাতে পারে এই সন্দেহে পুলিশ ধরে নিয়ে এসে মামলা দিয়েছে ২২ জনের মতো। এই জোনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এরিয়া সোনারগাঁ মোড়, কাওরান বাজার থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত। একটি ইন্টারন্যাশনাল বাজার এখানে লাখ লাখ মানুষের যাতায়াত থাকে। আর এই এরিয়া থেকেই এই ধরনের অপরাধীদের ধরা হয়। অন্য এরিয়ায় এত বেশি নেই। বিশেষ করে কাওরান বাজার এরিয়াটা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
ডিএমপি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) একেএম হাফিজ আক্তার জানান, বিশেষ করে রাতে যারা বাসে আসে তারা বেশি ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে। এই ধরনের ছিনতাইকারীরা জামিনে বের হয়ে বা পলাতক থেকে আবার ঘটনাগুলো ঘটায়। ঢাকা শহরে ছিনতাইকারীরা বার বার গ্রেপ্তার হচ্ছে। ঢাকা রাতে বা ভোররাতের দিকে অরক্ষিত থাকে। যাত্রীরা যারা আসেন তারা যদি বাসস্ট্যান্ডে বা টার্মিনালে নামেন তারা একটু সকালের পরে গেলে সবচেয়ে বেশি ভালো হয়। আমাদেরও পুলিশিং ব্যবস্থা থাকে কিন্তু যেখানে পুলিশ থাকে না সেখানে কিন্তু এই সকল ঘটনা বেশি ঘটে।
তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অপূর্ব হাসান মানবজমিনকে বলেন, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি এসকল অপরাধ দমনে। পুলিশের তৎপরতায় এখন আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। কাওরান বাজারে একসময় পুলিশ ফাঁড়ি ছিল না এখন সেখানে বাজারকেন্দ্রিক আলাদা একটি ফাঁড়ি আছে। সেখানে পুলিশের অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন রয়েছে।