প্রথম পাতা
সা ক্ষা ৎ কা র
বিপর্যয় ঠেকাতে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২২ মে ২০২২, রবিবারকরোনা মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, পরিবহন ব্যয়, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে ব্যয় বেড়েই চলেছে। যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের দাম বৃদ্ধিতেও সার্বিক অর্থনীতিতে বহুমুখী প্রভাব পড়েছে। এরই মধ্যে চাল, ডাল, আটা, ময়দা, তেল, চিনিসহ প্রায় দেড় ডজন নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। পার্শ্ববর্তী শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থাও টালমাটাল। এসব অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঠেকাতে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। সামর্থ্যের বাইরে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে না। সবকিছু কন্ট্রোল করার এখনো সময় আছে। দেশের সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এসব কথা বলেন।
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের রপ্তানি বাড়ছে। তবে রেমিট্যান্স ১৮ শতাংশের মতো কমেছে।
রপ্তানি আয় বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমদানি ও রপ্তানির মধ্যকার ব্যবধান বেড়ে যাচ্ছে। যে কারণে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই চলেছে। এর বাইরে বিদেশি বিনিয়োগ একেবারেই কম। এটি বাড়াতে হবে। এ জন্য অনেক পদক্ষেপ নিতে হবে। সেগুলো কতটুকু নেয়া সম্ভব তাও দেখার বিষয়। তিনি বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এখন রিজার্ভ ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। আগেই এ বিষয়ে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন ছিল। রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল না। এখন তা প্রমাণিত হচ্ছে। কারণ রিজার্ভ হচ্ছে বিপদের বন্ধু। বর্তমানে ডলার সংকট মোকাবিলা করতে প্রথমে আমদানির ওপর চাপ কমাতে হবে।
তিনি বলেন, অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত করতে এলসি মার্জিন আরোপ সঠিক হয়েছে। বিলাস বহুল ও একেবারেই অপ্রেয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে ব্যাংক ঋণও বন্ধ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, গত আগস্ট থেকেই রিজার্ভ ও রেমিট্যান্স কমছে। ওই সময়ে সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। আমদানি, রপ্তানি, হুন্ডি যে কোনোভাবেই টাকা পাচার হোক না কেন তা বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। দেশে এবং বিদেশে দুইভাবেই কাজ করতে হবে। রেমিট্যান্স প্রবাহ ব্যাংকিং চ্যানেলে আনা সম্ভব হলে সংকট মোকাবিলা করা সহজ হবে।
তিনি বলেন, আমরা এখন বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জে পড়েছি। বৈশ্বিক বিষয়টি হলো- করোনার কারণে ধীর হয়ে পড়া অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হয়েছে। এর মধ্যে যুদ্ধের কারণে দাম বাড়ছে। এতে করে আমদানি খরচ বেড়েছে।
সালেহ উদ্দিন বলেন- পরিবহন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ, সেবাসহ সব খরচ বেড়েছে। অথচ আয় সেভাবে বাড়েনি। বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। বাজার ব্যবস্থাকে সহজ করতে হবে। কোনো সিন্ডিকেট বা ম্যানুপুলেশন থাকবে না। কৃষিসহ যেকোনো পণ্য উৎপাদনকারীকে যথাযথ মূল্য দিতে হবে।
সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যহীনতা, বাজার তদারকির অভাব, সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেয়া এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে দুর্বল ব্যবস্থাপনা মূল্যস্ফীতির কারণ।
সালেহ উদ্দিন বলেন, চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে হবে। আমদানি যৌক্তিক করণের চেষ্টা করতে হবে। এই যে অনেক যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আসছে। এমনকি বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়- এমন ভোগ্যপণ্যও আনা হচ্ছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা এখন করছে। এটাও দেরি হয়ে গেছে। যে আমদানি দেখানো হচ্ছে তা যথাযথ কিনা যাচাই করতে হবে। আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং তথা পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা তদারক করতে হবে। যে পরিমাণ জিনিস আসার কথা, তা প্রকৃতপক্ষে আসছে কিনা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও কাস্টমসকে তদারক করতে হবে। সময়মতো পদক্ষেপ নিতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কিছুটা কমবে। পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলঙ্কার কী অবস্থা হয়েছে সবার জানা। সালেহ উদ্দিন বলেন, খাদ্যদ্রব্যের সরকারি মজুত ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। বিশেষ করে চাল, গম, ডাল এ ধরনের পণ্যের মজুত বাড়াতে হবে। ব্যবসায়ীরা যেন সুযোগ নিতে না পারে তা খেয়াল রাখতে হবে। বাজার তদারকি করতে হবে। তাতে দর নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
শ্রীলঙ্কার পরিণতির জন্য যেসব বিষয় দায়ী, সেগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিয়ে এখান থেকে বাংলাদেশকে শিক্ষা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি অনেক মজবুত। তবে অত্যন্ত সতর্ক থাকবো। এ বিষয়ে সালেহ আহমেদ বলেন, বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শ্রীলঙ্কা অতিরিক্ত বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে। আবার ঋণের অর্থ যে খাতে ব্যয় করেছে সেখান থেকে তেমন লাভ আসেনি। আমাদেরও অনেক বড় প্রকল্পের সুবিধা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এসব বিষয়ে এখনই নজর দিতে হবে। বিশেষ করে প্রকল্পের ব্যয় যেন মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে না যায়। যেটা আমাদের এখানে হচ্ছে। প্রকল্পের ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে। প্রকল্পের অর্থ খরচের জবাবদিহি কম। এছাড়া সময়মতো প্রকল্পের কাজও শেষ হয় না। এ বিষয়ে এখনই সতর্ক হতে হবে বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর। বড় প্রকল্পের কারণে এখন বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের দায় আগের চেয়ে বেড়েছে। পরিশেষে তিনি বলেন, সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করার এখনো সময় আছে। সামর্থ্যের বাইরে কোনো কিছু করা যাবে না। অর্থাৎ কোনো বড় প্রকল্প নেয়া যাবে না। সকল পক্ষ মিলে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া হলে দেশের অর্থনীতি সঠিক পথেই থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ।