শেষের পাতা
কলকাতার চিঠি
বিলকিস বানুরা ভারতীয় আইন ব্যবস্থায় আস্থা হারাবেন না কেন?
জয়ন্ত চক্রবর্তী
১৯ আগস্ট ২০২২, শুক্রবার
কলকাতার চিঠিতে হঠাৎ বিলকিস বানু কেন? বিস্মিত হবেন না। পরপর দুটি খবর আমাকে এতটাই বিচলিত করেছে যে এই কলাম লেখার তাগিদটা ত্যাগ করতে পারলাম না। তাছাড়া হতে পারে বিলকিস বানুর নামটা গোধরা ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, কিন্তু এর আবেদন তো সর্বজনীন। সবরমতির তীরে বসে কেউ যেমন এই ঘটনায় একাত্ম অনুভব করবেন, তেমনই পুণ্যতোয়া গঙ্গার ধারের মানুষেরও একাত্ম হতে বাধা কোথায়? আমরাই বলি না বিশ্ব এখন গ্লোবাল ভিলেজ হয়ে গেছে। তাই আজকের কলামে সেই বিলকিস বানু। নামটা শোনা শোনা মনে হচ্ছে? হতেই পারে। মাত্র কুড়ি বছরে কে আর কবে স্মৃতি বিলুপতায় ভুগেছে? বিলকিস বানু হলো সেই রমণী যিনি গোধরা দাঙ্গার সময় দুষ্কৃতদের হাতে গণধর্ষিত হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তার পরিবারের সাত জন ছুরির আঘাতে ছিন্নভিন্ন হন। ভারতীয় আদালত তাদের মধ্যে ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় এই ঘৃণ্য অপরাধের জন্য। এই পর্যন্ত পড়ে আপনি ন্যায়বিচারের পক্ষে হাততালি দিতে পারেন।
বিলকিস বানু বলেছেন, ভারতীয় আইন ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা জন্মে গেল। কুড়ি বছর পরেই মুক্ত হয়ে গেল ঘাতক ও নরখাদকের দল। ২০০২ সালে গোধরা দাঙ্গার সময় এক শ্রেণির উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিলকিস বানুর বাড়িতে ঢুকে তার যৌবনকে শুধু কলুষিত করেনি, পরিবারের সাত সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে। গোধরা দাঙ্গার পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন মামলা চলার পর বিলকিস বানু ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত ১১ জন যাবজ্জীবন দণ্ড পায়। স্বাধীনতা দিবসের পুণ্যলগ্নে এই আসামিদের মুক্তি দেয়া হয়। অমৃতের জীবনের স্বাদ দেয়া হয়। ২০০২ সালের ঘটনাটি অনেকেরই মনে আছে। কারণ, মামলাটি চিহ্নিত হয়েছিল বিলকিস বানু ধর্ষণ মামলা নামে। অমৃত বিষের পাত্রে পরিবেশিত হতেই শিউরে উঠেছেন বিলকিস। তার মনে পড়ে গেছে বর্বরতার সেই দুঃস্বপ্নের দিনটিতে। সেদিনের বর্বরতার শাস্তি মাত্র কুড়ি বছরের? বিলকিসের জীবন থেকে যে যৌবনের সোনা ঝরা দিনগুলো কেড়ে নেয়া হয়েছিল, তার ঘনিষ্ঠজনদের রক্তে রাঙা হয়ে যাওয়া বিলকিস কীভাবে ভুলবেন হর হর মহাদেবও ধ্বনি দেয়া দুষ্কৃতদের। স্বয়ং মহাদেবও হয়ত সেদিন কৈলাধে মর্তের এই অনাচার দেখে পাশ ফিরে শুয়েছিলেন বিরক্তিতে। বিলকিস বানুর শরীরে দগদগে ঘায়ের মতো সেই স্মৃতি। এরপর তিনি যদি আইনের ওপর আস্থা ফিরিয়ে নিতে চান তাহলে কি তাকে দোষ দেয়া যায়? না, দোষ দিতে হয় ভারতের সিউড়ো সেকুলারিজমকে। যে কারণে গোধরা কাণ্ডের খলনায়করা কারাগার থেকে মুক্ত হন, সেই একই কারণে বারাণসী থেকে শঙ্করাচার্য আনন্দ স্বরূপ ঘোষণা করেন ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর সংবিধান।
২০২৩ সালে এই সংবিধানের খসড়া প্রকাশ করা হবে। তিনি এই সংবিধান এর রূপ রেখা যা প্রকাশ করেছেন তাতে বলা হয়েছে, ২০২৭ সালের মধ্যে ভারতকে স্বাধীন হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হবে। এই রাষ্ট্রের রাজধানী হবে বারাণসী। এই রাষ্ট্রে মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের কোনো ভোটাধিকার থাকবে না। যদিও তারা চাকরি ও অন্যত্র যে সুযোগ-সুবিধা পায় তা পাবে। স্বাধীন হিন্দু রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সামরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে। মোট ৫৪৩ জন সংসদ সদস্য থাকবেন স্বাধীন হিন্দু রাষ্ট্রে। খসড়া সংবিধানের প্রচ্ছদে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র ছাপা হয়েছে যেখানে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান রাষ্ট্রগুলোকে অখণ্ড ভারতের অংশ বলে দেখানো হয়েছে। প্রচ্ছদ সম্পর্কে খসড়ায় বলা হয়েছে, একদা এরা ভারতের অংশ ছিল আবার তারা ফিরে আসবে। নির্বাচিত কলামের পাঠকরা, দুটো ঘটনা বিচ্ছিন্ন হলেও কোথাও কি একটা যোগসূত্র পেলেন? আজ যে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ সমগ্র বিশ্বকে কুরে কুরে খাচ্ছে। বিলকিস বানু কিংবা হিন্দু রাষ্ট্রের অঙ্গীকার তার আগাম সংকেত নয়তো? ভারতে ধর্মের ভিত্তিতে রাজনীতির প্রবক্তরা কি বলেন? ধর্মনিরপেক্ষতা ভাঁড় মে যায়, আমরা বরং এক অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখি যেখানে হিন্দু হলেই মিলবে ব্যভিচারের অধিকার। তথাকথিত হিন্দুত্ববাদীরা, একবার কী ভেবে দেখবেন, আগুন নিয়ে খেলা করার পরিণতি কি মারাত্মক হতে পারে! এই আগুনে আপনিও দগ্ধ হতে পারেন!
মন্তব্য করুন
শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]