ঢাকা, ১ জুলাই ২০২৫, মঙ্গলবার, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৪ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

বিশ্বজমিন

নিউ ইয়র্ক টাইমসের কলাম

ইউরোপ একটি বড় ভুল করছে

অ্যান্টন জ্যাগার

(২১ ঘন্টা আগে) ৩০ জুন ২০২৫, সোমবার, ১২:৫৯ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ১২:০৩ পূর্বাহ্ন

mzamin

ব্রাসেলস থেকে ট্রেনে বের হলে যেটা আগে চোখে পড়ে, সেটা হলো অডি কারখানা। ধূসর, আয়তাকার ভবনের সমন্বয়ে তৈরি এই কারখানাটি দীর্ঘদিন ধরে বেলজিয়ামের অন্যতম বৃহৎ গাড়ি উৎপাদন কেন্দ্র ছিল। ঝকঝকে আর উৎপাদনশীল এই জায়গাটি ইউরোপের রাজধানীর জন্য উপযুক্ত এক প্রতীক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এ বছরের শুরুতে তা ইউরোপব্যাপী ছড়িয়ে পড়া শিল্প সংকটে পড়ে অকস্মাৎ বন্ধ হয়ে যায়। একসময়কার চকচকে দেওয়ালে এখন ইতিমধ্যেই গ্রাফিতির দাগ লেগেছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অডি কারখানার গল্প হয়ে উঠেছে পুরো ইউরোপের গল্প। দুটোই এখন ভাগ্যহত, আর একবিংশ শতাব্দীর নতুন ভূ-অর্থনৈতিক স্রোতে ভেসে যাওয়ার ঝুঁকিতে। ব্রাসেলসে এই সংকটের প্রতিক্রিয়ায় নেওয়া হয়েছে সময়োপযোগী এক পরিকল্পনা- মন্ত্রীদের দাবি অনুযায়ী, গাড়ি তৈরির এই কারখানাটিকে অস্ত্র উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এই রূপান্তর, সমর্থকদের মতে, ইউরোপের কৌশলগত স্বনির্ভরতা নিশ্চিত করবে এবং তৈরি করবে ৩,০০০ নতুন চাকরি।

ইউরোপজুড়ে নীতিনির্ধারকরা এখন এক কৌশলে একমত। তাহলো- এক ঢিলে দুই পাখি মারা। একদিকে, সামরিক ব্যয়ের মাধ্যমে রাশিয়ার হুমকি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে এবং আমেরিকার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ইউরোপ তার পরাশক্তির মর্যাদা অর্জন করতে পারবে। অন্যদিকে, চীনা প্রতিযোগিতা আর জ্বালানি ব্যয়ের চাপে বিপর্যস্ত ইউরোপীয় শিল্প খাত পাবে নতুন জীবন। এই ভাবনায় সামরিক খাতে অর্থ ঢালাই হবে ভূ-রাজনৈতিক দুর্বলতা ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা মোকাবেলার উপায়।

কিন্তু এই আশাগুলো খুব সম্ভবত বিভ্রমেই পরিণত হবে। ইউরোপের সামরিকীকরণ উদ্যোগ আকার এবং দক্ষতা- দুটোর দিক থেকেই দুর্বল এবং নিজস্ব লক্ষ্য পূরণে যথেষ্ট নয়। বরং এর চেয়েও বড় ঝুঁকি হলো, এই কৌশল ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সামনে না এগিয়ে পেছনে ঠেলে দিতে পারে। নতুন এক যুগের সূচনা নয়, হঠাৎ করে অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় ঝাঁপিয়ে পড়া হয়ে উঠতে পারে এক ঐতিহাসিক ভুল।

ইউরোপের এই নতুন নীতিকে সাধারণত একটি পুরোনো নামেই ডাকা হয়। তাহলো মিলিচারি কীনসিয়্যানিজম। মূলত, ২০ শতকের মাঝামাঝি অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে সামরিক ব্যয় বাড়ানোর যে কৌশল বিভিন্ন সরকার নিয়েছিল, সেটাই বোঝানো হয় এই শব্দে। প্রথমে নাৎসি জার্মানিতে এর শুরু, পরে আমেরিকা তা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেয়। সাম্প্রতিককালে এই শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে পুতিনের রাশিয়ান যুদ্ধ অর্থনীতির বেলায়। তবে ইউরোপের বর্তমান বাস্তবতা আদৌ এই শ্রেণীকরণে পড়ে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। কারণ এক, এই মহাদেশ কেবল ১৯৮৯ সালের আগের সামরিক ব্যয়ের হারেই ফিরে যাচ্ছে। যেমন ১৯৬০-এর দশকে জার্মানির সামরিক ব্যয় জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ ছিল; আর চ্যান্সেলর ফ্রেডরিক মেৎসে সম্প্রতি ৩.৫ শতাংশ লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন। এটিকে বিপুল কোনো পরিবর্তন বলা চলে না- আর যেটাকে ‘জেইটওয়েন্ডে’ বা ‘যুগান্তর’ বলা হচ্ছে, তা মোটেও এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
এই কৌশলের সামাজিক সুবিধাগুলো- অর্থাৎ কীনসিয়্যানিজম- তাও অস্পষ্ট। জার্মানি কিছুটা ঋণ নীতিতে শিথিলতা আনলেও, অধিকাংশ ইউরোপীয় নীতিনির্ধারক বাজেট ঘাটতি বাড়াতে রাজি নন। সামরিক খাতে অর্থ ব্যয় করা মানে হবে অতি প্রয়োজনীয় সমাজকল্যাণ, অবকাঠামো ও জনসেবার খাত থেকে অর্থ কেড়ে নেওয়া। এক্ষেত্রে ইউরোপীয় কৌশলের সঙ্গে তুলনা করলে রিগান যুগের আমেরিকাই বেশি মানানসই- যেখানে সামরিক ব্যয় বাড়ানো আর সমাজ কল্যাণ কমানো ছিল একে অপরের সহচর।

এই বিষয়টিই তুলে ধরেছেন অডি কারখানাকে অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রে রূপান্তরের প্রবক্তা বেলজিয়ামের প্রতিরক্ষামন্ত্রী থিও ফ্রাংকেন। তিনি বলেছেন, একটি রাষ্ট্র যদি ঘাটতি কমিয়ে সামরিক ব্যয় বাড়াতে চায়, তবে সমাজকল্যাণ খাতে কাটছাঁট করতেই হবে। ‘সোশ্যাল সিকিউরিটি অনেক বেশি স্ফীত’ তার মন্তব্য, ‘২০০ বিলিয়নের বাজেট থেকে কয়েক বিলিয়ন কেটে নেওয়া অমানবিক নয়, তাই না?’ অথচ এই ধরনের চিন্তাভাবনাই সামাজিক অস্থিরতা বাড়িয়ে ইউরোপজুড়ে ডানপন্থার উত্থান ঘটাচ্ছে এবং ইউরোপীয় সংহতিকে হুমকির মুখে ফেলছে।

সামরিকায়নের আরও সমস্যাও রয়েছে। সাবেক অনেক শিল্প খাত এখন যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়বে- যা কোনোভাবেই গাড়ি বিক্রির মতো নির্ভরযোগ্য মুনাফার উৎস নয়। তদুপরি, সামরিক বাজেট বাড়ালে যে সামরিক শক্তি বাড়বেই, তা নয়। অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম টুজ যেমন উল্লেখ করেছেন, ইউরোপীয়রা সম্মিলিতভাবে নিজেদের ‘জোম্বি সেনাবাহিনীতে’ প্রচুর অর্থ ঢাললেও এর ফলাফল খুব কমই পাওয়া যায়- না জনশক্তি, না উপকরণে। ইউরোপের কোনো কোম্পানি পর্যন্ত সেরা দশ প্রতিরক্ষা কোম্পানির তালিকায় নেই।

এর ওপর আছে ইউরোপের চিরায়ত সমস্যা- সমন্বয়ের অভাব। ট্যাংক আর অন্যান্য সরঞ্জাম এমনিতেই ব্যয়বহুল। তার ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিকেন্দ্রীকৃত সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ার ফলে খরচ বেড়ে যাবে। যেমন ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য গোলাবারুদ উৎপাদনে যে বিলম্ব হয়েছে, তাতে এই ব্যর্থতা চোখে পড়ে। সবকিছুর ওপরে, এই সামরিক ব্যয়ের প্রাথমিক সুবিধাভোগী হবে আমেরিকান কোম্পানিগুলো- ইউরোপীয় কারখানাগুলো চালু হতে সময় লাগবে। বড় এক ব্যঙ্গাত্মক বাস্তবতা-  ইউরোপের অর্থ দিয়ে লাভবান হবে আমেরিকা।

লজিস্টিক্যাল সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি ইউরোপে সামরিকায়নের সাংস্কৃতিক সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে সাংবাদিক আনাতোল লিভেন বলেছিলেন, কেউ যদি ভাবেন ইউরোপ আবার প্রুশিয়ান সামরিক শক্তিতে ফিরবে, তবে তিনি ‘জার্মান কোনো ডিসকো ক্লাবে কখনও যাননি।’ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শান্তিপ্রবণ মানসিকতা আরও বেড়েছে। অনেক দেশ ২০০০ সালের পর বাধ্যতামূলক সামরিক সেবা বাতিল করেছে, আর এখন নাগরিকদের সামরিক সেবার প্রতি আগ্রহ জাগাতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে। এক জার্মান পডকাস্টার যেমন বলেছিলেন: ‘মরে যাওয়ার চেয়ে বেঁচে থাকা ভালো।’

তবু ইউরোপীয় নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, এই পুনঃসামরিকায়নই একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশের শর্ত। সম্প্রতি ন্যাটো সম্মেলনে প্রায় সব সদস্য দেশ আগামী দশকে সামরিক ব্যয় জিডিপির ৫ শতাংশে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেÑ যদিও এর মধ্যে ১.৫ শতাংশ যাবে প্রতিরক্ষা-সম্পর্কিত অবকাঠামো ও গবেষণায়। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানে যুদ্ধ সহ বিশ্বজুড়ে বাড়তে থাকা সংঘাতই, তাদের মতে, ইউরোপকে আবার এক ‘যোদ্ধা মহাদেশে’ পরিণত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখায়। এই কৌশল, তারা দাবি করছেন, সামরিক স্বনির্ভরতা ও অর্থনৈতিক পুনরুত্থান- দুই-ই নিশ্চিত করবে।
কিন্তু বাস্তবে, এই দুই লক্ষ্যই অর্জন অসম্ভব। বর্তমান পথ ধরে এগোলে ইউরোপ সামরিক কীনসিয়্যানিজমের কোনো সামাজিক সুবিধা পাবে না। আবার পরাশক্তি হিসেবে যথোপযুক্ত প্রতিরক্ষা কৌশলও গড়ে তুলতে পারবে না। বরং এর ফলে দেখা দেবে উভয় সংকট। একদিকে হবে দুর্বল অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, যার ভবিষ্যৎ নেই। আর অন্যদিকে বিপুল অর্থ যাবে প্রতিরক্ষা খাতে, যা ইউরোপকে বিশ্বের বড় খেলোয়াড়দের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার যোগ্যতা দেবে না।
ব্রাসেলসে একবার ছোট্ট সফর করলেই এই বাস্তবতা চোখে পড়ে- অডি কারখানাটি এখনো ফাঁকা পড়ে আছে।

(লেখক অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের শিক্ষক। তার এ লেখাটি নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনুবাদ)

 

বিশ্বজমিন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

বিশ্বজমিন সর্বাধিক পঠিত

রাশিয়ার নিরাপত্তা কাউন্সিলের ডেপুটি চেয়ারম্যান/ একাধিক দেশ ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র দিতে প্রস্তুত

নেতানিয়াহুর ভূয়সী প্রশংসা করলেন ট্রাম্প/ ইরানের ৩ পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলা

যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ ইসরাইলের, প্রত্যাখ্যান তেহরানের/ ইরানে তীব্র হামলা চালানোর নির্দেশ

১০

যুক্তরাষ্ট্রের হামলার জবাবে ইরান/ সকল বিকল্প উন্মুক্ত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status